ইশরাত খানুম আমাদের বাড়ি ছেড়ে পাকাপাকিভাবে চলে যাবার পর আমার গুজবসন্ধান-পটীয়সী খালা, যিনি অলিগলির প্রত্যেকের খুঁটিনাটি তথ্য-অতীত ইতিহাস, ঘটনা ইত্যাদির নিয়মিত খোঁজ রাখতেন, আমাকে ঐ নারীর আদ্যোপান্ত জীবনকাহিনী খুলে বলেন।
ব্যস্ত তেহরান শহরের ছাদঘরের কার্নিশের ছায়ায় বসে গ্রীষ্মের কোনো একদিন কথার ফাঁকে জেনেছিলাম ইশরাতের কথা; অবশ্য সেসব কথা তার সাথে আমাদের পরিচয় হওয়ার অনেক আগের ঘটনার পূর্ব পরম্পরা।
‘তুই হয়তো জানিস না মেয়েটা অল্পবয়সে ছিল গ্রামের ছোটো একটা ক্লিনিকের পরিচ্ছন্নতাকর্মী’, হুট করেই বললেন খালা।
‘ও! জানতাম না তো!’
‘হুম, সে যেখানে কাজ করত ঐ এলাকার এক দেউলিয়া মহাজনের নিষ্কর্মা-অলস পুত্র একদিন ঘটনাক্রমে ক্লিনিকে এসে একহারা গড়নের যুবতী ইশরাতের সৌন্দর্য দেখে কিছুক্ষণের জন্য ‘হা’ হয়ে থাকে। মুশকিল হলো, ছেলেটা ছিল ছোটোখাটো একটা প্রতারক। সেদিনের পর থেকে নানারকম ছুতো-বাহানা-অজুহাতে সে প্রায় প্রতিদিনই ক্লিনিকে এসে মেয়েটার সাথে ভাব জমাতে শুরু করল। অল্প কয়েকদিনের মধ্যে ইনিয়ে-বিনিয়ে মধুরতম মিথ্যার স্বস্তা ফুলঝুরি দিয়ে মেয়েটিকে সে তার প্রতি দুর্বল করে ফেলল; হয়তো বলেছিল-তার হাসি কত সুন্দর, চোখ কত মোহময় ইত্যাদি ইত্যাদি; প্রতারকের শব্দভাণ্ডারে তো ফাঁপা শব্দের ঘাটতি নেই! আর এদিকে মেয়ে একে তো ছিল বিবাহযোগ্যা, তার ওপরে যারপরনাই নিঃসঙ্গ; সাথে বাবা-মা’র নিয়মিত খোঁটা আর বকাঝকা ছিল বাড়তি পাওনা। অতএব, ধূর্তের সন্তর্পণ বুননে তৈরি মোহময় প্রতারণার জালে দ্রুত আটকে গেল সে। শুধু বিয়ের প্রলোভনই নয়, বিয়ের পর তাকে তেহরানে নিয়ে এসে এখানকার চাকচিক্য আর জৌলুশময় নতুন জীবন উপহার দেওয়ার স্বপ্ন দেখিয়ে যে সমস্ত সুযোগ নেওয়া যায়, তার সবগুলোই প্রতারকটি নিয়েছিল।
এদিকে মেয়ে একে তো ছিল বিবাহযোগ্যা, তার ওপরে যারপরনাই নিঃসঙ্গ; সাথে বাবা-মা’র নিয়মিত খোঁটা আর বকাঝকা ছিল বাড়তি পাওনা। অতএব, ধূর্তের সন্তর্পণ বুননে তৈরি মোহময় প্রতারণার জালে দ্রুত আটকে গেল সে। শুধু বিয়ের প্রলোভনই নয়, বিয়ের পর তাকে তেহরানে নিয়ে এসে এখানকার চাকচিক্য আর জৌলুশময় নতুন জীবন উপহার দেওয়ার স্বপ্ন দেখিয়ে যে সমস্ত সুযোগ নেওয়া যায়, তার সবগুলোই প্রতারকটি নিয়েছিল।
প্রতি শুক্রবার দুজনের দেখা হতো; বাসায় কেউ ‘কোথায় যাচ্ছিস’ জানতে চাইলে ইশরাত চটজলদি উত্তর দিত ‘হ্যামলেট’ এলাকার এক বান্ধবীর সাথে জরুরি কাজ আছে। আসলে তারা দেখা করত জনসমাগমহীন অনেক দূরের এক বিস্তীর্ণ মাঠে। ওখানে ছেলেটি আগে থেকেই অপেক্ষায় থাকত; আর মেকি রোম্যান্টিকতার ভান ধরে হয়তো গাছের নিচে চাদর বিছিয়ে টেপরেকর্ডারে পুরনো গানের ক্যাসেট চালিয়ে দিত; সাথে থাকত আরকের রস; এবং আয়োজনের এক পর্যায়ে অতঃপর শরীর থেকে শরীরে আদিম, যৌথ আদান-প্রদান। এরই ফাঁকে ফাঁকে মধুরতম স্বরে মিথ্যা বুলি আওড়াতে আওড়াতে ছেলেটি বারবার বিয়ের প্রতিশ্রুতির জাল বুনে যেত।
আমি বললাম, ‘সারশূন্য আশ্বাসেই মেয়েটি কাবু হয়েছে।’
‘অবশ্যই! আমি গ্রামে থাকতে নিজেই একবার এমন ফাঁদে পা দিয়েছিলাম। ঐ নাজুক বয়সে, যখন বাবা-মা’র খোঁটা কিংবা অযাচিত বিষণ্ণতায় বিরক্ত সব মেয়েই পুরুষসঙ্গী খোঁজে, একটু উষ্ণতার জন্য মেয়েরা অনেক ধরনের ভুল করে বসে’।
‘তারপর কি হলো?’ আশ্চর্য হয়েই জিজ্ঞেস করলাম, কারণ একজন ধর্মপ্রাণ মুসলিম নারী হয়েও খালা এত সাবলীলভাবে পুরুষ-সংক্রান্ত বিষয়ে যে ভাবতে পারেন তা আমার ধারণার বাইরে।
‘কয়েক সপ্তাহ পর, হঠাৎ এক সকালে ঐ রাজপুত্র ইশরাতকে জানালেন যে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ কাজে দিন কয়েকের জন্য তেহরানে যাবেন, কাজটা সেরে দু-চার দিনের মধ্যেই ফিরবেন। সেদিনই ছিল দুজনের শেষ দেখা’।
‘ইশরাত নিশ্চয়ই খুব ভেঙে পড়েছিল’
‘সেটাই কি স্বাভাবিক না?’
‘তারপর?’
‘সেই থেকে সমস্যার কেবল শুরু’
‘সমস্যা?’
‘দগদগে ঘায়ে লবণ পড়ার আতঙ্ক নিয়ে ইশরাত টের পেল তার শরীরের ভেতর নতুন প্রাণের স্পন্দন’
‘মানে? প্রেগন্যান্সি?’
‘হুম, বিচ্ছিন্ন গ্রামের কট্টর মুসলিম পরিবারে বেড়ে ওঠা ঐ বয়সের একটি মেয়ের জন্য এরচেয়ে ভয়ংকর খবর আর হয় না। বাপ-মা জেনে ফেলবে– সার্বক্ষণিক এই শঙ্কা আর জীবনের ভয় যেন তার প্রতিটা মুহূর্তকে গ্রাস করে ফেলে। যে ক্লিনিকে সে কাজ করত, ওখানে একজন তরুণ ডাক্তার মিলিটারি সার্ভিসের অংশ হিসেবে দুবছরের জন্য ডিউটিতে ছিলেন। তার কাছেই একদিন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে ইশরাত সব খুলে বলল’।
‘তাতে কোনো লাভ হয়েছিল?’
‘হ্যাঁ, সৌভাগ্যবশত ডাক্তার ছিলেন মানবিক। সেদিন ভদ্রলোক পাশে না দাঁড়ালে, গ্রামের ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কজাত অনাগত সন্তানের কথা ঘুণাক্ষরে যদি জানতে পারত, সমাজের মুখে চুনকালি দেওয়ার অপরাধে পাথর ছুঁড়ে পিটিয়ে মেয়েটাকে হত্যা করত’।
‘তারপর কি হলো?’
‘ডাক্তারের মনে ধারণা জন্মাল পুরো ঘটনাটিই হয়তো ঈশ্বরপ্রেরিত দৈববাণী। সে বেশ সাহস দেখিয়ে দুদিন পর ইশরাতের বাবা-মা’র সাথে দেখা করে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসে।’
‘তারা নিশ্চয়ই মুহূর্তেই রাজি হয়ে গেল।’
‘রাজি মানে?! ডাক্তার ছেলেকে মেয়ে-জামাই হিসেবে পাওয়া মানে আকাশের চাঁদ হাতের মুঠোয়!’
‘শেষতক মেয়েটার নিজের ভাগ্যই ওকে বাঁচাল’।
‘হুম, বলতে পার; কিন্তু ডাক্তার-স্বামীর সাথে ঐ সংসারের আয়ু ছিল মাত্র দুবছর’, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন খালা।
‘আচ্ছা, বাচ্চাটার কি হলো?’
‘গ্রামের অনেক মেয়েদের ক্ষেত্রে যা হয়, দুর্ভাগ্যজনকভাবে তারও গর্ভপাত হয়েছিল’
‘এটা তো ডাক্তার সাহেবের জন্য ভালোই হয়েছে। কোনো পুরুষ কি জেনে বুঝে জারজ বাচ্চার বাপ হতে চায়? বিশেষত জন্মদাতা যদি হয় ‘নারীপটানো’ আর চরিত্রহীন।’
‘তোমার কথাই ঠিক হয়তো; যা হোক, গেঁয়ো সমবয়সী মেয়ে যাদের প্রধান লক্ষ্যই থাকে ধনাঢ্য স্বামী খুঁজে নেওয়া, ইশরাতের দৈব সৌভাগ্যে তাদের খুব জ্বলুনি শুরু হলো। হতে পারে ওর ওপর তাদের সম্মিলিত ঈর্ষাজাত অভিশাপ ছিল’
‘ধারণা করছি, তেহরানে এসে তাদের দিনগুলো ভালো কেটেছে।’
‘তাদের জীবনের সেরা দিন ছিল এখানে। কিন্তু অপয়া ‘ইরানি রেভল্যুশান’ সব ডোবাল।’
বললাম, ‘আসলেই অপয়া। সেই সময়টাতে সবার জীবনেই কালো ছায়া নেমে এসেছিল।’
‘ইশরাত খানুম ওই সময়টার ভিকটিম। ওর স্বামী ছিল ‘ইরানি শাহ’-এর একনিষ্ঠ সমর্থক। চারপাশে যখন তার মতো অসংখ্য পেশাজীবীদের ধরে ধরে হত্যা করা হচ্ছে, গ্রেফতার হওয়ার আশংকায় সে সিদ্ধান্ত নিল দেশ ছাড়ার।’
‘গন্তব্য নিশ্চয়ই আমেরিকা?’
‘হুম, তার আগে অবশ্য কিছুদিনের জন্য দুজন জার্মানিতে চলে যায়; ওখানেই একসময় ডাক্তারসাহেব পড়াশুনার উদ্দেশ্যে গিয়েছিল।’
‘কিন্তু, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না ইশরাত আবার এই তেহরানে ফিরে এলো কিভাবে? কেনই বা এলো?’
‘আমেরিকায় থাকাকালীন তরুণ ডাক্তার স্বামীটি তার অফিসের সহকর্মী আমেরিকান সুন্দরী ডাক্তার, নার্সদের রূপে রীতিমত মোহগ্রস্ত হয়ে পড়ে। অনেক ইরানি পুরুষের মতো সেও মার্কিন সুন্দরীদের সাথে নিয়মিত ঘোরাফেরা, চুটিয়ে আড্ডা দিতে দিতে একটা সময় বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে যায়।
‘আমেরিকায় থাকাকালীন তরুণ ডাক্তার স্বামীটি তার অফিসের সহকর্মী আমেরিকান সুন্দরী ডাক্তার, নার্সদের রূপে রীতিমত মোহগ্রস্ত হয়ে পড়ে। অনেক ইরানি পুরুষের মতো সেও মার্কিন সুন্দরীদের সাথে নিয়মিত ঘোরাফেরা, চুটিয়ে আড্ডা দিতে দিতে একটা সময় বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে যায়। এদিকে, ইশরাত ছিল প্রায় নিরক্ষর এক গেঁয়ো মেয়ে যার কাছে আমেরিকার নতুন পরিবেশে টিকে থাকা হয়ে ওঠে ভীষণ কষ্টকর; এর মধ্যে স্বামীর নতুন আচরণ-ব্যবহারে তার মধ্যে সন্দেহ দানা বাঁধতে থাকে। স্বামীর বেশি রাত করে বাড়ি ফেরা, অফিসের কাজের চাপের অভ্যাসগত অজুহাত এসবের কারণ খুঁজতে গিয়ে একদিন সে তার নারীসঙ্গীদের ব্যাপারে জেনে যায়। ডাক্তারও পরিষ্কার বুঝে নেয় তার গেঁয়ো স্ত্রীটি কোনোভাবেই আধুনিক উন্নত সমাজে খাপ খাইয়ে নেওয়ার মতো স্মার্ট নয়। এক আমেরিকান সুন্দরী, যে সবদিক থেকেই যোগ্য, তার সাথে সম্পর্ক গভীর হতেই সে ইশরাতকে ডিভোর্স দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। নিজের কোনো সন্তান কিংবা বন্ধুবান্ধব না থাকার কারণে ইশরাতের সামনে তখন একটাই পথ খোলা দুরভাগ্যসমেত ইরানে ফিরে আসা। যদিও রেভল্যুশান-পরবর্তী সময়টায় একাকী একজন নারীর জন্য ইরানে বসবাস করা ছিল প্রায় আত্মহত্যার নামান্তর’।
বললাম, ‘পরিষ্কার মনে আছে সেই দিনগুলোর কথা। নারীদের জন্য এক দুর্বিষহ সময়। তোমার মনে পড়ে কিরকম জোর করে মেয়েদেরকে ‘ইসলামিক হিজাব’ পরতে বাধ্য করা হতো? কেউ পরতে না চাইলে তার ওপর নেমে আসত নির্যাতন। পিটিয়ে, থুথু ছুঁড়ে পশুর মতো টেনে নেওয়া হতো ‘মনকারাত’ নামের জায়গায় যেখানে চলত অপমানের পরবর্তী ধাপ’।
‘বেচারি ইশরাতকে শেষতক এমন গারদেই ফিরতে হলো! ডিভোর্স আর দেনমোহর বাবদ অল্প কিছু জমানো টাকা শেষ হয়ে যাওয়ায় বেঁচে থাকার একান্ত প্রয়োজনে তাকে চাকরি খোঁজার যুদ্ধে নামতে হয়েছিল’।
‘সে কখনও নিজের গ্রামে ফিরে যাবার কথা ভাবেনি?’
‘প্রশ্নই আসে না! প্রথম কথা, তার বাপ-মা জানত সে আমেরিকায় সুখে আছে। দ্বিতীয়ত, সন্তানহীনা তালাকপ্রাপ্তা মেয়েকে কট্টর গ্রামবাসীরা পতিতা ঠাউরাবে। তার কাছে একটা পথ খোলা ছিল, আগের চাকরিতে ক্লিনারের কাজে ফিরে যাওয়া’।
‘সে আর বিয়ে করেনি?’
‘কয়েকবার’
‘মানে?!’
‘শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্যে ‘সিয়েঘে’ বা ‘মুত্-আ’ (অস্থায়ী) বিয়ে করে কয়েকজন পুরুষের সাথে তার সংসার করতে হয়েছে’
‘এদের মধ্যে একজন পুরুষও পুরোপুরি স্থায়ীভাবে স্বামী হিসেবে থাকল না?’
‘আরে বোকা, ‘মুত্-আ’ বিয়ের নতুন বাজারে যেখানে অল্প সময়ের জন্য বহু নারীকে স্ত্রী হিসেবে ব্যবহার করা যাচ্ছে, সেখানে স্বেচ্ছায় কোনো পুরুষ কি কেবল একজন নারীর সাথে স্থায়ী বিয়ের অঙ্গীকার করতে যাবে?’
ওই সময় ইরানে ‘আইনগতভাবে গ্রহণযোগ্য’-ধরণের পতিতাবৃত্তি বেড়ে যাওয়াতে ‘শাহার-ই-নো’ নামের নিষিদ্ধপল্লিগুলো বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়; আর জৈবিক তাড়নায় মরিয়া পুরুষেরা রাস্তায় রাস্তায়, কখনও বা নিঃসঙ্গ অসহায় নারীর খোঁজে মাজারে-উপাসনালয়ে ঘুরত। উদ্দেশ্য ছিল, ইরান-ইরাক যুদ্ধে বিধবা হওয়া নারীদেরকে ‘মুত্-আ’ বিয়ের মাধ্যমে নিজেদের ‘সিয়েঘ’ বা অস্থায়ী স্ত্রী বানানো।
‘পেশাজীবী সিয়েঘ’-দের যখন রূপ-যৌবনের আর অবশিষ্ট থাকত না, ক্ষণিকের স্বামী তথা খদ্দেররাও বাজারের নতুন মুখ খুঁজে বেড়াত। ইশরাত খানুমও একসময় টের পেলো, তার চাহিদা কমে আসছে।
খালা ব্যাখ্যা করলেন, ‘পেশাজীবী সিয়েঘ’-দের যখন রূপ-যৌবনের আর অবশিষ্ট থাকত না, ক্ষণিকের স্বামী তথা খদ্দেররাও বাজারের নতুন মুখ খুঁজে বেড়াত। ইশরাত খানুমও একসময় টের পেলো, তার চাহিদা কমে আসছে। প্রতি শুক্রবার সে কিছু রুটি-পনির পোটলায় বেঁধে, গায়ে চাদর জড়িয়ে ‘শাহ আব্দুল আযিম’ মাজারের উদ্দেশ্যে বাস ধরত, ওখানে পৌঁছে অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকত কোনো অনভিজ্ঞ মোল্লা অথবা উৎসাহী পুরুষের খোঁজে, যে তাকে অল্প সময়ের জন্য হলেও নিজের ‘মুত্-আ’ স্ত্রীরূপে গ্রহণ করবে। কিন্তু দ্রুতই সে আবিষ্কার করলো বাজারের নতুন মেয়েগুলোর আকর্ষণ আর ছলাকলার কাছে তার অবয়ব বড়ই বেমানান’।
‘তার তো ডিপ্রেশনে চলে যাওয়ার কথা!’
‘একপর্যায়ে সে বুঝল, যথেষ্ট হয়েছে। বেশ কবছর বিচিত্র জঘন্য ধরণের নোংরা নারীবাজদের ক্ষণিক আনন্দ দিতে দিতে পুরুষ জাতটার প্রতি বিতৃষ্ণ আর মানসিকভাবে অসুস্থ, ক্লান্ত হয়ে পড়ল; সিদ্ধান্ত নিল, ধর্ষকামী পুরুষ শিকারীদের থেকে বাঁচতে সে শহরে কোথাও পূর্ণকালীন গৃহপরিচারিকার কাজ নেবে’।
‘তখনই আমাদের বাসায় এসে ওঠে, তাই তো?’
‘ঠিক তাই। তোমার মায়ের মৃত্যুর পর, তোমার বাবা বিয়ে করতে রাজি না হওয়ায় ঘরদোর দেখাশোনা আর তোমার যত্নের জন্য একজন লোকের প্রয়োজন দেখা দেয়। বাজারের এক পরিচিত ব্যক্তি তাকে ইশরাতের সন্ধান দেয়’।
আমাদের বাড়িটা ছিল বাজারের পাশে, সাধারণ গড়পড়তা এলাকার ভেতর। বাবা যখন ডেকে বললেন, একজন গৃহপরিচারিকা বাড়ির নিচতলার রুমে থাকবেন, আমাদের দেখভালের পাশাপাশি মা’র অবর্তমানে গৃহস্থালির কাজকর্ম করবেন, আমরা ঠিক বুঝিনি এর অর্থ কি। বাড়িতে সার্বক্ষণিক একজন কাজের লোক থাকার ব্যাপারটা কিঞ্চিৎ স্ট্যাটাসের বিষয়। আমাদের এলাকায় কারো বাড়িতে এমন নজির ছিল না। প্রতিবেশী মহিলারা শুধু যে নিজের ঘরের কাজ নিজে করতেন তাই না, প্রয়োজনে পাশের বাড়ির কাজেও হাত বাড়াতেন। আমাদের মা-ও সমস্ত ধোয়ামোছা-ঘরগোছানো-রান্নাবান্না একাই করতেন। আমরা হয়তো মাঝেমধ্যে গলির দোকানে দৌড়ে গিয়ে পাউরুটি-কলা-সবজি ইত্যাদি কিনে আনতাম। মায়ের মৃত্যুর পর আমাদের তিন ভাইয়ের জীবন কেমন যেন ছন্নছাড়া হয়ে গেল। কেউ কোনো নিয়মের ধার ধারত না। বাসা থেকে প্রতিদিন সকালে বাবা কাজের উদ্দেশ্যে বাজারের দিকে রওনা হবার পর আমরা নিজের খেয়াল-খুশিমতো একেকজন এক এক সময়ে ঘুম থেকে উঠতাম। যখন যেমন খুশি, যার যার মর্জিমতো ব্রেকফাস্ট, দুপুরের খাবার, ডিনার হতো। প্রায় প্রত্যেক দিন যে যার ইচ্ছেমতো সময়ে বাসা থেকে বেরোত, বাসায় ফিরত। দিনের বেলা কোনো কাজ থাকলে আমিও বেরোতাম, না থাকলে গলির পরিচিত চায়ের দোকানে বসে বন্ধুদের সাথে চুটিয়ে আড্ডা চলত। সতেরো বছর বয়সী আমার মেজো ভাই জাফর পুরনো সেকেন্ডহ্যান্ড বিভিন্ন জিনিস ফেরি করে বেড়াত; ছোটো ভাই গোলাম সন্ধ্যা হবার আগমুহূর্ত পর্যন্ত পাড়ার ছেলেদের সাথে গলির মোড়ে শখের ফুটবল খেলত।
শুরুতে ইশরাত খানুম ছিল একান্ত নিরীহ, শান্ত, অনুগত এক নারী। দায়িত্ব নিয়ে সবার কাপড় ধোয়া, ইস্ত্রি করা, সবার জন্য রান্না করা, কিংবা যে কোনো গৃহস্থালি কাজ সে খুব মনোযোগ দিয়ে করত। কিন্তু, আমাদের খাপছাড়া দৈনন্দিন অনিয়মগুলো একসময় তার সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়। চারজনের জন্য দৈনিক চার ধরণের রান্না, তাও আবার ভিন্ন ভিন্ন সময়ে—স্বাভাবিকভাবেই তার ওপর বাড়তি কাজের চাপ তৈরি করে— ওর ব্যবহারে পরিবর্তনের মাধ্যমে সেটা টের পেলাম। সকাল আটটার মধ্যে সকালের নাস্তা তৈরি করে সে যেত দিনের বাজার করতে, ফিরে এসে দুপুরের রান্না শেষ করে যেত কাপড় ধুতে। আমরা সময়মত ঘুম থেকে না উঠলে খাবারগুলো টেবিল থেকে নিয়ে আবার হাঁড়িতে রাখতে হতো। এরপর আমরা যদি অসময়ে খাবার চাইতাম, ইশরাত রাগে গজগজ করে নিচুস্বরে বকে যেত। একদিন অবশ্য ফস্ করে বলে বসল ‘আমি রাজপ্রাসাদের পরিচারিকা নই যে ইচ্ছেমতো সবাই ফরমাশ খাটাবে’। বিকেলে জাফরের সাথে আলাপে বললাম, ‘আচ্ছা, ইশরাত তো আমাদের কাজের লোক; তাই না?’
‘হ্যাঁ, কেন?’
‘তাহলে আমরা যা করতে বলব, সে তো তা-ই করতে বাধ্য; ঠিক?’
‘আমার জানামতে, কাজের লোকের কাজই তো তাই।’
‘কিন্তু ও তো আমাদের কথা শোনে না।’
‘হুম, আসলেই শোনে না’, জাফরও একমত হলো।
‘সে ইদানীং বাবার কথাও শুনতে চায় না।’
‘সে একটা উদ্ভট ধরণের মহিলা।’
‘ঠিক তাই; অদ্ভুতুরে!’
দিন যত গেল, ইশরাতের একনায়কোচিত কণ্ঠস্বর যেন আরও বেপরোয়া হচ্ছিল। যেমন, সকালে আমাদের রুমে এসে চেঁচামেচি করে আরামের ঘুম ভাঙানো শুরু তো করলই, সাথে ওয়ার্নিং দিল, ঠিক সময়ে বিছানা না ছাড়লে নাস্তা পাব না। আমরা শুরুতে বিষয়টাকে একেবারেই আমলে নিইনি। কিন্তু সপ্তাদুয়েক ধরে ঠান্ডা চা আর বাসী পাউরুটি গলাধকরণ করার পর বাধ্য হয়েই আত্মসমর্পণ করলাম। দুপুর, রাতের খাবারের বেলায়ও একই ঘটনা ঘটল। বলা হলো, রাতে কেউ দেরিতে ফিরলে গরম খাবার পাওয়া যাবে না। আরও কিছুদিন পর ইশরাত খানুম সরাসরি আমাদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা শুরু করে; এবং অবশেষে সে রীতিমত স্বেচ্ছাচারী শাসক হয়ে উঠে। জাফর মুখ গোমরা করে বলল, ‘নিজের ঘরেই এখন আমরা পরাধীন’।
‘পছন্দের খাবারটাও আমরা নিজের সুবিধামতো সময়ে খেতে পারি না’, সায় দিয়ে জানালাম।
‘সে শুধু নিজের পছন্দের খাবার রান্না করে’। ছোটোভাই গোলাম আভিযোগ করল, ‘আগের মতো আমি সন্ধ্যায় গলির মোড়ে ফুটবল খেলতে পারি না।’
মাথা নেড়ে বললাম, ‘আমার তো নিজের চোখকেই বিশ্বাস হচ্ছিল না সেদিন, যখন দেখলাম সে বাবার চায়ের পটটা জানলা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল’। জাফরও একমত ‘বাবা তো কেবল চা’র ডেকচিতে সিগারেটের শেষ অংশটা রেখেছিল; এতে এমন দোষের কি?’ গোলাম বলল, ‘আমি তখন প্রচণ্ড ভয় পেয়েছি, আর একটু হলেই প্যান্টে হিসু করে দিতাম’।
ধীরে, কিন্তু নিশ্চিতভাবে, ইশরাত খানুম রগচটা-বদমেজাজী একজন মহিলায় পরিণত হলো। অনেকটা ‘শাহার-ই-নো’–এর সর্দারনীর মতো, যার সাথে কেউ তর্ক করার সাহস রাখে না। দেখতে দেখতে আমাদের বাড়িটা যেন মিলিটারি ব্যারাকের রূপ নিল। প্রতিদিন আমরা দ্রুত বিছানা ছেড়ে চোখেমুখে ঠান্ডা পানির ঝাপটা দিয়ে সকাল আটটার ভেতর চুপচাপ নাস্তা সেরে নিতাম। ইঁদুরের মতো সবাই চুপিসারে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ত। দুপুর আর রাতের খাবার খেতাম বোবার মতো, কোনো রকম টুঁশব্দ ছাড়া; ডিনার শেষে কিছুক্ষণ টিভি দেখে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তাম। বাবার কাছে এসব ব্যাপারে নালিশ করে কোনো লাভ হয়নি। উল্টো বলতেন, ‘পুরুষ মানুষই সবচে’ বড়ো শত্রু। তিনি নিজেও নতুন নিয়মে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। এক সন্ধ্যায় তাকে আমি অনুনয় করে বললাম, ‘এভাবে আর চলতে পারে না বাবা!’
‘কীভাবে বাপজান?’
‘ইশরাত খানুম আমদের সবাইকে মিলিটারি সৈন্যের মতো চালাচ্ছে’। আমাদের কথার মাঝখানে বাবা হঠাৎ চুপ হয়ে গেলেন। টের পেলাম আমার ঠিক পেছনেই ওই মহিলা এসে দাঁড়িয়েছে। যথারীতি কথায় তীব্র শ্লেষ মিশিয়ে ঝাঁঝালো গলায় বলল, ‘আমার সমালোচনা করতে তোমাদের বাপ-ব্যাটার লজ্জা করে না? সকাল থেকে রাত অব্দি আমি এই অভিশপ্ত বাড়িতে গাধার মতো খেটে যাই, বিনিময়ে এ-ই আমার প্রাপ্য!?’
আমি দ্রুত উঠে দাঁড়ালাম। তারপর চোখের পলকে দৌড়ে নিজের রুমে চলে আসি। এরপর যতই বিষয়গুলো নিয়ে ভেবেছি, বাবার জন্য তত আফসোস বেড়েছে। কেমন করে এত ভীতু, দুর্বল হয়ে গেল আমাদের বাবা?
এক পড়ন্ত বিকেলবেলা বাবা খুব খোশমেজাজে বাসায় ফিরলেন। সবার সাথে হাসি-ঠাট্টা করলেন, আমাদের সবার খোঁজ নিলেন। ঘটনা কী? সন্ধ্যার পর মনে হলো আমাদের ড্রইং রুম থেকে কারো কান্নার শব্দ আসছে। খুব সম্ভবত একজন মহিলা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
এক পড়ন্ত বিকেলবেলা বাবা খুব খোশমেজাজে বাসায় ফিরলেন। সবার সাথে হাসি-ঠাট্টা করলেন, আমাদের সবার খোঁজ নিলেন। ঘটনা কী? সন্ধ্যার পর মনে হলো আমাদের ড্রইং রুম থেকে কারো কান্নার শব্দ আসছে। খুব সম্ভবত একজন মহিলা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। জাফরকে ফিশফিশ করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘শুনতে পাচ্ছিস? মনে হচ্ছে কোনো মহিলা কাঁদছে’।
‘মহিলা!? ঠিক শুনেছিস তো?’
‘মহিলাই হবে, পুরুষ মানুষ ওভাবে কাঁদে না
‘তোর কি মনে হয়, বাবা কোনো মহিলাকে বাসায় নিয়ে এসেছে?
‘ধ্যাত্, বাবা ওরকম মানুষ না’
আমরা নিজেদের রুমে বিছানায় বসে কান পেতে ঘটনা বোঝার চেষ্টা করছি। বুঝতে পারছিলাম, বাবা ওই মহিলাকে সান্তনা দিচ্ছেন, কিন্তু তার কান্নার শব্দ অন্য সব শব্দকে ছাপিয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পর ড্রইংরুমের দরজা সজোরে বন্ধ করে কেউ যেন বারান্দায় এসে দাঁড়াল। জানলায় উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম কে ওখানে। পর্দার ফাঁক দিয়ে মনে হলো ইশরাত খানুম তার পরনের চাদর দিয়ে চোখ মুছছে।
পরদিন সকালে, যেন কোন জাদুমন্ত্রবলে বাড়ির অন্দরের ভোল পাল্টে গেল। ইশরাত পুরোপুরি ভিন্ন একজন মানুষে পরিণত হয়েছে। কোনো চিৎকার-চেঁচামেচি নেই। শান্ত-নিরিবিলিভাবে আর ধৈর্য নিয়ে সে স্বাভাবিকভাবে ঘরের সব কাজ শেষ করল। সন্ধ্যায় জাফর জিজ্ঞেস করল, ‘বুঝতে পারছিস কিছু?’ বললাম, ‘কোনো ধারণাই নেই’।
রাতে খাবার টেবিলে বাবাকে দেখলাম কিছু একটা নিয়ে চিন্তিত। আমরা চুপচাপ খাচ্ছি, আর বারবার আড়চোখে বাবার দিকে তাকাচ্ছি; হয়তো এখনই তিনি সব খুলে বলবেন। হঠাৎ গোলাম বলে উঠল, ‘ইশরাত আমার সাথে আজ অনেক ভালোভাবে কথা বলেছে’। ওর কথা শুনে বাবা বললেন, ‘ও আসলে অনেক ভালো একজন মানুষ’। আমি জানতে চাইলাম, ‘কিন্তু হঠাৎ তার এমন পরিবর্তন?!’
‘কারণ সে আমাদের বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে।’
‘চলে যাচ্ছে! কিন্তু কেন?’ আমরা সবাই হতচকিত।
‘হ্যাঁ, এটাই সবার জন্য ভালো।’
‘কিন্তু কোথায় যাবে ও?’, মনের খুশি চেপে জানতে চাইলাম।
‘বেহেজিশ্তি’ সামাজিক সহায়তা কেন্দ্রে। ওখানে আমার পূর্বপরিচিত একজন ভদ্রলোক কাজ করেন। ওখানে সে ভালোই থাকবে। আমি ওর জন্য কিছু টাকা আলাদা করে রেখেছি, কিছুদিন চলতে পারবে। ওখানকার লোকজন পরে কোথাও একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দেবে’।
অবস্থার হঠাৎ এমন নাটকীয় পরিবর্তনে আমরা একেবারে চুপ হয়ে গেলাম।
ইশরাত চলে যাবার পর পুরো বাড়িটা কেমন খাঁ খাঁ করছে। সিঁড়িঘর, দেওয়ালগুলোও কেমন চুপসে গেছে। আমরা কি ওকে তাড়িয়ে দিলাম? এখন অবশ্য ‘বেহেজিশ্তি’ সহায়তা কেন্দ্রে গিয়ে আমরা মাঝে মধ্যে ওর সাথে দেখা করে আসি। ওকে দেখে, ওর অবয়ব দেখে জানতে ইচ্ছে হয়, ইশরাত খানুমের মাথায় এখন কী চিন্তা ঘুরছে? ও কি ইরানের সব মেয়েদের কথা ভাবছে? কে জানে? দূরের শূন্য দিগন্তে ওর পলকহীন দৃষ্টি ভীষণ বিষণ্ণ আর মায়াময়।
লেখক পরিচিতি : ফেরদিন রাশিদী ইরানের একজন খ্যাতিমান গল্পকার। তার পুরস্কারপ্রাপ্ত গল্পগুলি হলো : ‘আশুরা’, ‘দ্য কবুতর’, ‘ফ্যানসিয়ার, এবং ‘ইশরাত খানুম’-সহ ইরানি টেলস। তিনি ইরানের ‘দ্য আউটকাস্ট’ এবং ‘শরিয়া আইন শেক্সপিয়র’, দুটি উপন্যাস প্রকাশ করেছেন। ফেরদিন রাশিদীর এই গল্পটি ‘ইরানিয়ান ডট কম’ থেকে নেওয়া হয়েছে।
জন্ম ২৪ নভেম্বর ১৯৭৮। নৃবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। ঢাকা, বোস্টন ও নিউইয়র্কে বেড়ে ওঠায় তাঁর আত্মগত স্বর ও শৈলীতে রয়েছে বিচিত্র অভিজ্ঞতা ও প্রসঙ্গের সমন্বয়। সাম্প্রতিক সময়ে অনুবাদ, সম্পাদনা ও সমকালীন সাহিত্য নিয়ে নিয়মিত লিখছেন কয়েকটি পত্রিকায়।