টিটো পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। তার স্বপ্ন বড়ো হয়ে সে বড়ো মাপের একজন সাইন্টিস্ট হবে। নতুন নতুন গ্রহ-উপগ্রহ আবিষ্কার করবে। নতুন নতুন কেমিক্যাল আবিষ্কার করবে। নতুন নতুন ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি, সরঞ্জাম তৈরি করবে। যা বিশ্ববাসীকে তাক লাগিয়ে দেবে। যা কেউ কখনো কল্পনায় আনতে পারে না—সেটাই করবে টিটো। তার মনের মাঝে এমনই এক শক্তিশালী বীজের অঙ্কুরোদগম হয়েছে। তাই তার বাবাকে বিভিন্ন বিজ্ঞান বিষয়ক কল্পবিজ্ঞানের বইগুলো আনতে বলে। বাবাও টিটোর চাহিদা মতো বই সংগ্রহ করে দেন। বইমেলা ছাড়াও বিভিন্ন অনলাইন শপে বইয়ের অর্ডার করেন। প্রতি মাসেই টিটোর নামে কিছু না কিছু বই আসবেই।
এক রাতে টিটো গ্রহ-উপগ্রহ বিষয়ক একটা সায়েন্স ফিকশন বই পড়ছিল। বইটি তার কাছে এতোই ভালো লাগছিল যে, বইয়ের গল্পগুলোর মাঝে হারিয়ে গেল। সে ছোট্ট একটা স্পেসশিপে চড়ে বসে আছে। সেই নীলচে রঙের স্পেসশিপে একটা মাত্র সিট। কোনো চালক নেই। নিজস্ব গতিতে ছুটে চলেছে গ্রহ-উপগ্রহ, ধুমকেতু, গ্যালাক্সি, ছায়াপথ মাড়িয়ে। কোথায় যাচ্ছে টিটো জানে না। আশপাশে কেউ নেই, যার কাছে জেনে নেবে। কিন্তু তার মনের মাঝে জানার আগ্রহ জড়ো হতেই উত্তর এলো, তুমি টিকট্রিয়ান নামক উপগ্রহে যাচ্ছ।
এই স্পেসশিপের কোনো ডানা নেই। ঠিক যেন একটা বড়ো চালকুমড়া। দুই ঘণ্টা সময় টিটোর কাছে মনে হলো দুই মিনিট। কে যেন তার কানে কানে বলছে, ওই যে সামনে তাকাও। স্পেসস্টেশনে চলে এসেছে। এটাই টিকট্রিয়ান উপগ্রহ।
আশপাশে কেউ নেই অথচ কে কথা বলল! মনে মনে ভাবছে আর ভয়ে ভয়ে চারদিকে তাকাচ্ছে। আবার টিটোর কানে ভেসে এলো, তোমার ভয় নেই। তোমার কিচ্ছু হবে না। আমি টিকট্রিয়ান উপগ্রহ হতে ডকরেন ট্রিট বলছি; আমার কাছে আসতে আর মাত্র দুই ঘণ্টা সময় লাগবে। এলেই তুমি দেখতে পাবে। শোঁ শোঁ গতিতে ছুটে চলেছে স্পেসশিপ। এই স্পেসশিপের কোনো ডানা নেই। ঠিক যেন একটা বড়ো চালকুমড়া। দুই ঘণ্টা সময় টিটোর কাছে মনে হলো দুই মিনিট। কে যেন তার কানে কানে বলছে, ওই যে সামনে তাকাও। স্পেসস্টেশনে চলে এসেছে। এটাই টিকট্রিয়ান উপগ্রহ। সামনের দিকে তাকিয়েই বিস্ময়ে টিটোর চোখজোড়া ছানাবড়া হয়ে গেল। হাজার হাজার ব্যাঙ দাঁড়িয়ে আছে। নানান বর্ণের পোশাক পরে। ভাবল, এ কোন ব্যাঙের রাজ্যে এলাম! যত দূর চোখ যায় শুধু ব্যাঙ আর ব্যাঙ। ব্যাঙগুলো প্রায় ছাগলের সমান। কিন্তু কোনো ব্যাঙের মুখ দেখা যাচ্ছে না। কারণ, সবাই উলটোদিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। পেছন দিকটা দেখেই অনুমানে ব্যাঙ ভেবেছে টিটো। সেই ব্যাঙের সারিগুলোর কাছাকাছি যেতেই দাঁড়িয়ে গেল স্পেসশিপ। তখনই টিটোর কানে আওয়াজ এলো, টিটো নেমে পড়ো। টিটো নামার জন্য পা বাড়াতেই আপনা-আপনি দরজা খুলে গেল।
টিটোর পা টিকট্রিয়ান উপগ্রহে পড়তেই, দেহের ভেতর কেমন একটা অজানা পুলক অনুভব করল। শিহরিত হলো মন-মস্তিষ্ক। আর সঙ্গে সঙ্গে বেজে উঠল অকল্পনীয় বাঁশির সুর। এরপর নানান বাদ্যযন্ত্রের বাজনা। বাজনাগুলো পৃথিবীর সকল বাজনার চাইতে ভিন্ন। এমন সময় ব্যাঙগুলো ঘুরে দাঁড়াল টিটোর দিকে মুখ করে। ব্যাঙগুলো তার সামনে সোজা হয়ে দাঁড়াতেই, এতোটা আশ্চর্য হলো যে—মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলল টিটো। বেশকিছু সময় তালগাছের মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আর মনে মনে অস্পষ্ট সুরে বলে উঠল, এ কী দেখছি আমি! পেছন থেকে ব্যাঙের মতো দেখতে লাগলেও মুখমণ্ডল অবিকল মানুষের মতো! এরা কী তবে ব্যাঙমানুষ!
হ্যাঁ, টিটো। তুমি ঠিক ধরেছো। এদের ব্যাঙমানুষ বা ফ্রগম্যান বলতে পারো। ব্যাঙের মতো চার হাত-পা আছে। কিন্তু ঘাড় থেকে পুরো মুখমণ্ডল মানুষের মতো দেখতে। অর্থাৎ এরা ফ্রগম্যান। আমাদের এই রাজ্যকে ফ্রগম্যানের রাজ্য বলে থাকি। তোমাদের পৃথিবীতে তোমরা মানুষ যেমন সেরা, আমাদের এই টিকট্রিয়ানে ফ্রগম্যানই সেরা। তোমাদের যেমন পরিবার আছে, সমাজ আছে। ঠিক আমাদেরও পরিবার আছে, সমাজ আছে। তোমরা যেমন জমি চাষাবাদ, চাকরি, ব্যাবসা-বানিজ্য করো, আমাদের এই ফ্রগম্যান সমাজেও তাই করে।
টিটো যখন যা ভাবছে, তারই উত্তর কে যেন দিচ্ছে অদৃশ্য হয়ে। তাতেই টিটোর আরও বিস্ময়টা তরতরিয়ে বেড়ে যাচ্ছে। তাই এবার টিটো জোর গলায় বলল, সেটা বুঝেছি। কিন্তু কে কথা বলছো? সামনে এসো।
এবার টিকট্রিয়ান উপগ্রহের ডকরেন ট্রিট, টিটোর সামনে দৃশ্যমান হলো। তারপর এগিয়ে এসে বলল, হ্যালো বন্ধু, কেমন আছ? আমাদের টিকট্রিয়ানে তোমাকে স্বাগতম।
টিটো অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, হ্যাঁ ভালো আছি। কিন্তু তুমিও তো দেখছি ফ্রগম্যান!
হ্যাঁ বন্ধু, আমাদের এই উপগ্রহের সকলেই দেখতে এমন। আজ থেকে পাঁচ লক্ষ বছর আগে নাকি তোমাদের মতোই ছিল। বায়ুচাপের কারণে ধীরে ধীরে এই রুপে পরিণত হয়। বর্তমানে আমাদের অধিকাংশ বিজ্ঞানীরাই এটা প্রমাণ করছেন। অধিক বায়ুচাপের ফলে ধীরে ধীরে আমাদের পূর্বপুরুষেরা কুঁজো হতে থাকে এবং একপর্যায়ে হাত দুটো পায়ের মতো মাটি স্পর্শ করে। ঠিক তোমাদের গ্রহের বানরের মতো। সেই থেকে আমাদের মাঝে একটা অলৌকিক শক্তি আসে। যেটা তুমি স্পেসশিপে ওঠার পর থেকেই লক্ষ করেছ। তুমি মনে মনে যা কল্পনা করছিলে, তার উত্তর পেয়েছিলে। বলো পেয়েছিলে কি না?
হ্যাঁ, পেয়েছিলাম। টিটো বলল।
তার কথা তোমরা কিন্তু বুঝতে পারো না। হাজার হাজার মাইল দূর থেকে তোমার সকল প্রশ্ন আমি শুনেছি। তুমিও আমার কথা শুনেছ। তুমি যখনই স্পেসশিপে চড়ে বসো, তখনই তোমাকে সেই ক্ষমতা দেওয়া হয়।
আমি তোমার মনের ভেতরে উদয় হওয়া সকল প্রশ্নই শুনতে পাই। আর তা বায়ুর মাধ্যমে। এই গ্রহের সবাই বায়োনিক ক্ষমতার অধিকারী। কেউ জোরে কথা বললে বুঝতে পারে না। কিন্তু মনে মনে কথা বললেই বুঝতে পারে। তোমাদের পৃথিবীতে যারা কথা বলতে পারে না, তারা যেমন ইশারায় কথা বলে, ঠিক তেমনটি। তার কথা তোমরা কিন্তু বুঝতে পারো না। হাজার হাজার মাইল দূর থেকে তোমার সকল প্রশ্ন আমি শুনেছি। তুমিও আমার কথা শুনেছ। তুমি যখনই স্পেসশিপে চড়ে বসো, তখনই তোমাকে সেই ক্ষমতা দেওয়া হয়। যা এখন পর্যন্ত তোমার কাছে আছে। তাই আমার প্রত্যেকটা কথা তুমি শুনতে পাচ্ছো। তোমার কাছে মনে হচ্ছে, আমরা জোরে জোরে কথা বলছি। কিন্তু তা মোটেও নয়। আমরা কেউ জোরে কথা বলছি না।
তাই? আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল টিটো।
হ্যাঁ, তাই। তোমাকে বায়োনিক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। তাই তুমি শুনতে পাচ্ছ। আসল কথায় আসি। তোমাকে যে জন্য পৃথিবী থেকে আমাদের গ্রহে আনা হয়েছে। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই তোমার মস্তিষ্কে একটা চার্জিত ব্যাটারি সেট করা হবে। সেই ব্যাটারির সাহায্যে তুমি, তোমাদের পৃথিবীতে যারা বোবা তারা তোমার কথা শুনতে পারবে। আর তাদের কথাও তুমি শুনতে পাবে। এই চার্জিত ব্যাটারির নাম টটিসং। একবার চার্জ করলে পাঁচ বছর ধরে চার্জ থাকবে। প্রতি পাঁচ বছর পর তোমাকে আমাদের গ্রহে আনা হবে। চার্জ করার পর, তোমাকে আবার পৃথিবীতে প্রেরণ করা হবে। তুমি ছাড়া এই ব্যাটারিটা পৃথিবীর কেউ দেখতে পাবে না। তোমাকে আমাদের খুবই পছন্দ তাই এই ক্ষমতাটা দিচ্ছি। তোমাকে আমরা আমাদের বিশ্বস্ত বন্ধু বলে গ্রহণ করেছি। আশা করি, তুমি আমাদের কথামতো চলবে। এই ব্যাটারির কথা কাউকেই বলতে পারবে না। কাউকে বললেই সাথে সাথে তোমার কাছ থেকে এই ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হবে। এখন তুমি বলো, এটা চাও কী চাও না?
হ্যাঁ, হ্যাঁ। আমি চাই। আমাকে দাও। উৎফুল্ল হয়ে নিতে চাইল টিটো।
ওকে বন্ধু, খুশি হলাম। ওই চলে এসেছে টটিসং ব্যাটারি। এখন তোমাকে কয়েক মিনিটের জন্য অচেতন করা হবে। এতে ভয়ের কিছু নেই। জেগে থাকলে হয়তো ভয় পাবে। সেই জন্য অচেতন করা হচ্ছে। এটা স্থাপন করা খুব সহজ। এতে তিল পরিমাণও ব্যথা পাবে না। কিন্তু স্থাপনের সময় নড়াচড়া করলে সমস্যা হতে পারে।
ঠিক আছে বন্ধু। যেভাবে ভালো হয়, সেটাই করো।
পাঁচ সদস্যের ফ্রগম্যানের একটা দল এলো টিটোর কাছে। এরপর টিটোকে একটা বেডে শুইয়ে অচেতন করা হলো। কয়েকমিনিটের মধ্যে মাথার পেছনে টটিসং ব্যাটারিটা সেট করে দিলো। অল্পক্ষণের মধ্যে ধীরে ধীরে হুশ ফিরে এলো টিটোর।
তখন ডকরেন ট্রিট বলল, টিটো তোমার কাজ সম্পূর্ণ হয়ে গেছে। এখন আমাদের রাজ্যটা তোমাকে ঘুরিয়ে দেখানো হবে। তারপর যে স্পেসশিপে চড়ে এসেছ সেটাই তোমাকে রেখে আসবে।
একটা বড়ো স্পেসশিপে চড়ে বসল টিটো, ট্রিট আর কয়েকজন তাদের সঙ্গী। প্রায় ঘণ্টাখানেক সময়ের মধ্যে পুরো ফ্রগম্যান রাজ্য ঘুরে এলো টিটোরা। রাজ্যের সেরা সেরা ল্যাবরেটরি, মিউজিয়ামসহ আদিগন্ত বিস্তৃত ও অদ্ভুত প্রাকৃতিক দৃশ্য। আশ্চর্যজনক সকল সৃষ্টি দেখে শুধু অবাকই হয়নি, অনেক কৌতুহলও জন্মেছে টিটোর মনে।
সেই এক সিটের স্পেসশিপে চড়ে বসল আবারও টিটো। আলোর গতিতে ছুটছে স্পেসশিপ। টিটো নিজেকে এখন ফ্রগম্যান ভাবছে। আর নিজের দিকে বারবার চেয়ে চেয়ে দেখছে। এবার টিটো সত্যি সত্যিই ফ্রগম্যান হয়ে যাচ্ছে। সেটা বুঝতে পেরে সজোরে চিৎকার দিয়ে ওঠে টিটো— না, না, আমি ফ্রগম্যান হতে চাই না। আমি ফ্রগম্যান হয়ে থাকলে পৃথিবীর কেউ আমাকে মেনে নেবে না…
জন্ম ২৫ অক্টোবর, ১৯৯০ সালে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার পারচৌকা গ্রামে। পেশায় শিক্ষক।