সোমবার, নভেম্বর ২৫

বাঁচা-মরার উপাখ্যান : সঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়

0

বাইরে ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি পড়ছে পোস্ত দানার মতো। রথীনের এখনো ঘুম ভাঙেনি। মায়ের ডাকাডাকিতে কিছুটা জোর করেই সে বিছানা ছেড়ে উঠে বসে। আর কিছুক্ষণ ঘুমাতে পারলে বেশ হতো। ঘড়ির কাঁটা থেমে নেই, সে নিজের মতো করে সময়ের জানান দিচ্ছে। সকাল আটটা। অন্যদিন হলে এতক্ষণ সূর্যের তীক্ষ্ণ আলো রোদ হয়ে ছড়িয়ে পড়তো গোটা উঠান জুড়ে। বিছানা ছেড়ে ঘরের বাইরে উঠানে নেমে আসে রথীন। মা গোয়াল ঘর পরিষ্কার করছে। ব্রাশে টুথপেস্ট লাগিয়ে দাঁত মাঁজতে মাঁজতে রথীন চলে যায় পাড়ার জগধাত্রী মেলায়। এখানে একটা সরকারি টিউবওয়েল আছে, মুখ ধুয়ে ঘরে ফিরে আসে। গোয়াল ঘর পরিষ্কার করা হয়ে গেলে মাটির উনানে কাঠের জাল দিয়ে আগুন ধরানোর চেষ্টা করে রথীনের মা। ভিজে স্যাঁতস্যাঁতে কাঠ গুলো সহজে জ্বলতে চায় না, তাই বার বার ফুঁকনলে ফুঁ দিতে থাকে। ঘরময় ধোঁয়ায় ভরে উঠে।

সাত-সকালে শান্তি করে যে একটু চা খাব তার জো নাই। বাবাকে কতবার বলেছি একটা গ্যাস নিতে। সে কথা কানে নিলে তো। মাকে শোনাতে কথাটা ছুড়ে দিল রথীন। থেমে থাকেনি তার মাও।

—বলি কথায় কথায় বাবাকে না বলে নিজে রোজকার করে একটা ডবল সিলিন্ডার গ্যাস কিনে নিয়ে আয়।

—ঐ তো! বাবাকে কিছু বললেই তোমার গায়ে আবার ফোস্কা পড়ে!

—পড়বেক নাই, এই বয়সেও মানুষটা দিনরাত এক করে খেটে মরছে। আর তুই চাকরি চাকরি করে দিন পার করছিস। বাপের সাথে কাজে হাত লাগালে বাপটা যে একদন্ড রেহাই পায় সে চেষ্টা করলে তো পারিস।

—সকালে কানের কাছে ঘেনর ঘেনর, ভালো লাগে না।

একরাশ বিরক্তি প্রকাশ করে হনহনিয়ে ঘরের বাইরে বেরিয়ে যায় রথীন। মা ডাকে, মায়ের ডাক কানে যায় না রথীনের।

সেই কোন ভোরে ঘুম থেকে উঠে গোয়াল ঘর থেকে গরুগুলো বাইরে বের করে তালপাতার চালা ঘরে বেঁধে দু চার আঁটি গোটা খড় খুলে দেয় মদন খুড়ো। এটা তার প্রতিদিনের কাজ। আজও তার ব্যাতিক্রম হয়নি। একটা দুটো তো আর নয়, শখের হেলে জোড়া বাদ দিয়েও একটা গাই বাছুর ও বকনা মিলে পাঁচটি গরু আছে তার।

সেই কোন ভোরে ঘুম থেকে উঠে গোয়াল ঘর থেকে গরুগুলো বাইরে বের করে তালপাতার চালা ঘরে বেঁধে দু চার আঁটি গোটা খড় খুলে দেয় মদন খুড়ো। এটা তার প্রতিদিনের কাজ। আজও তার ব্যাতিক্রম হয়নি। একটা দুটো তো আর নয়, শখের হেলে জোড়া বাদ দিয়েও একটা গাই বাছুর ও বকনা মিলে পাঁচটি গরু আছে তার।

চায়ের সাথে দুটো বাসি রুটি মুখে দিয়ে ধান বীজের বস্তাটা মাথায় তুলে একটা কোদাল নিয়ে বৃষ্টির জলে ভিজতে ভিজতে শিশুবাঁধের পথ ধরে হনহনিয়ে হেঁটে চলে মদন খুড়ো। ঘণ শালবনের বুক চিরে লাল মোরামের যে রাস্তাটা চলে গেছে বহুদূরে, অনেকটা পথ যাবার পর সেই রাস্তারই বাঁপাশে শিশুবাঁধ। আর সেই শিশুবাঁধের পুবপাড়ের নিচে চারদিক জঙ্গলে ঘেরা যে জমিগুলো আছে সেখানে মদন খুড়োর বিঘে দেড়েক জমি আছে। জমির মাথায় পৌঁছে বীজধানের বস্তা ও কাঁধের কোদালটা নামিয়ে রেখে মদন খুড়ো ছুটে গিয়ে আশ্রয় নেয় শিশুবাঁধের পাড়ে তেঁতুল গাছের তলায়। বৃষ্টিটা আজ আর ছাড়াবে বলে মনে হয় না। ভোর রাত থেকেই ঝিরঝির লাগিয়ে রেখেছে। কচড়ে গুঁজে রাখা বিড়ির বান্ডিল ও দেশলাই বের করে, একটা বিড়ি নিয়ে মুখে দেয়। দেশলাইকাঠি জ্বালিয়ে বিড়ি ধরায়। এদিক ওদিক তাকিয়ে চারিদিকটা একবার দেখে নেয় মদন খুড়ো। না গণেশ বাবাজীরা এখানে কেউ নেই। আজ বেশ কয়েক বছর হয়ে গেল ঝাড়খন্ডের দলমা পাহাড় কিংবা উড়িশ্যার ময়ুরঝরনা থেকে বাবাজীদের আগমন ঘটে এই জঙ্গলে। বাবাজীরা দলবেঁধে আসে আবার ফিরেও যায়। এক দু’জন আবার থেকেও যায় পারমেন্টলি। গাঁয়ের সবাই বলাবলি করছিল একটা একানে দাঁতাল হাতি নাকি এ জঙ্গলের এ প্রান্ত ও প্রান্ত রাজাধিরাজের মতো ঘুরে বেড়ায়। একটা পায়ে নাকি ঘা হয়ে গেছে, খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলে। ভীষণ রাগী। সামনে পড়লে রক্ষা পাওয়া মুশকিল। বড়োজোড়ার বিটেয় নাকি তিন জনকে খুন করেছে। তবে মদনখুড়ো ভালো করে খবর নিয়েছে এ জঙ্গলে এখন তিনি নাই, সোনামুখীর রানির জঙ্গলে আছে। মোবাইল ফোনে এখন সবসময় হাতির খবরের আপডেট থাকে। বিট অফিস থেকে একটা ফোনের নাম্বার দিয়েছে সেই নাম্বারে ফোন করলেই বলে দেয় হাতি কোথায় আছে। তবু চারপাশটা ভালো করে দেখে নেয় মদনখুড়ো। বুনোহাতির ব্যাপারে রাজ্য সরকার নানা পদক্ষেপ ঘোষণা করেছে। ফসলের ক্ষতিপূরণ তো ছিলই, তার সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন হাতির হানায় কারো মৃত্যু হলে দু-লাখ টাকা ও পরিবারের একজনের চাকরি।

এ বছর সবার শেষে আজ রোয়া পোঁতার কাজ শেষ করবেক মদনখুড়ো। সেই মতো চারজন মুনিষ ও চারজন কামিন বলা আছে। তাদেরই প্রতীক্ষায় মদনখুড়ো শিশুবাঁধের পাড়ে বসে আছে।

গতকাল সারাদিন নিজের হাতে লাঙল চালিয়ে জমিতে কাদা করেছে মদনখুড়ো। সব মিলিয়ে সাড়ে তিন বিঘা জমি আছে তার। আরও পাঁচ কাঠা ছিল ওই পিচরাস্তার ধারে, বিক্রি হয়ে গেছে।

জাতে বামুন মদনখুড়ো। তবু নিজের হাতে লাঙলের বোঁটা ধরে। এই নিয়ে গাঁয়ের পাঁচজন পাঁচ কথা বলাবলি করে। কোনো কথায় কান দেয় না মদনখুড়ো। গত বছর বাউরি পাড়ার গৌতমকে লাঙলে মুনিষ রেখেছিল, গৌতম ভালো লাঙল চালায়। কিন্তু গরুগুলোকে খুব বেশি মারধর করে। একদিন মদনখুড়োর শখের হেলে জোড়াকে পাচনে করে এমন মেরেছিল, গোটা গায়ে কালশিটে দাগ পড়ে গিয়েছিল। সেইদিনই মদনখুড়ো গৌতমকে জবাব দিয়েছিল, সেই থেকে নিজেই লাঙল চালায় মদনখুড়ো। আর গরুগুলোকে এমন বশ করেছে যে ডাইনে বামে যা বলে হেলে জোড়া তেমন চলে। গরুগুলোকে বড়ো ভালোবাসে মদনখুড়ো।

আকাশটা মুখ ভার করে আছে, যে কোনো সময় বৃষ্টিটা বাড়তে পারে। মুনিষ কামিনগুলো ঠিক সময় মতো এসে রোয়া পোঁতার কাজ শুরু করেছে। ঘড়ির কাঁটা থেমে নেই, বেলা গড়িয়ে এখন দশটা। মদনখুড়ো বাড়ির পথে হাঁটা দেয়। আজ যজমান ঘর থেকে কোনো ডাক আসেনি, তাই পুজোর ঝামেলা নেই। প্রায় ত্রিশ চল্লিশ ঘর যজমান আছে তার, ডাক এলেই ধুতি পাঞ্জাবি পরে ছুটতে হয়।

আকাশটা মুখ ভার করে থাকলেও বৃষ্টি পড়াটা বন্ধ হয়েছে। রথীন বাড়ি ফিরে আসে। মাকে খাবারের কথা বলে চটজলদি বালতি মগ নিয়ে হাজির হয় জগধাত্রী মেলার কলতলায়। তাড়াতাড়ি স্নান সেরে ফিরে আসে। মুখে সামান্য কিছু দিয়ে বেরোতে যাবে এমন সময় মদনখুড়ো ঘরে ঢুকল। বাবার মুখোমুখি হয়ে একবার থমকে দাঁড়াল রথীন, হয়তো বাবাকে কিছু বলবে। কিন্তু পরক্ষণে কী মনে করে বাবাকে কিছু না বলে পাশ কাটিয়ে হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল। রথীনের বাবা ও মা একে অপরের দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। মুখে কিছু না বললেও চোখের চাউনিতে অনেক কথার বিনিময় হয়ে গেল।

রথীনকে সেই কথা পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিল। সেই থেকেই বাপ বেটার সম্পর্কটা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। ছেলের কথা ভেবে কষ্ট পেয়েছিল মদনখুড়ো, একলা মনের দুঃখে শিশুবাঁধের পাড়ে তেঁতুলতলায় বসে বোবা কান্না কেঁদেছিল। তবে শেষ চেষ্টা একটা করেছিল।

স্বামী স্ত্রী, এক ছেলে আর এক মেয়ে নিয়ে অভাব অনটনের মাঝেও বেশ সুখেই কাটছিল দিনগুলো। কিন্তু সেই সুখ বেশিদিন স্থায়ী হল না। রথীন মাধ্যমিকে কয়েকটা বিষয়ে লেটার মার্কসসহ ফাস্ট ডিভিশনে পাশ করল। জেদ ধরল সায়েন্স নিয়ে পড়বে, কিন্তু ছেলেকে সায়েন্স নিয়ে পড়াবার মতো ক্ষমতা মদনখুড়োর নেই। রথীনকে সেই কথা পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিল। সেই থেকেই বাপ বেটার সম্পর্কটা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। ছেলের কথা ভেবে কষ্ট পেয়েছিল মদনখুড়ো, একলা মনের দুঃখে শিশুবাঁধের পাড়ে তেঁতুলতলায় বসে বোবা কান্না কেঁদেছিল। তবে শেষ চেষ্টা একটা করেছিল। পিচরাস্তার ধারের ওই পাঁচ কাঠা জমিটা বিক্রি করে। কিন্তু তাতেও বাঁধ সাধল। হঠাৎ করেই রথীনের মামা একটা বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে একদিন হাজির হলো বাড়িতে। বাপের একমাত্র ছেলে, সরকারি চাকুরে। বাবা মা অমায়িক লোক। খুবই পরিচিত। এমন পাত্র কী আর হাতছাড়া করা যায়। দেখাশোনার পর্ব শেষ, ঠিক হয়ে গেল বিয়ের দিন। ছেলের ঘর থেকে দেনা পাওনার কথা না উঠলেও মেয়েকে তো আর খালি হাতে পাঠানো যায় না। শেষমেশ রাস্তা ধারের পাঁচ কাঠা জমি বিক্রির টাকায় বৈশাখের এক শুভ লগ্নে বিয়ে হয়ে গেল মদনখুড়োর একমাত্র মেয়ের।

সায়েন্স নিয়ে ভর্তি হতে না পেরে একেবারে ভেঙে পড়েছিল রথীন, ভেবেছিল পড়া ছেড়ে দেবে। মায়ের কথায় শেষমেষ আর্টস নিয়েই ভর্তি হয়েছিল একাদশ শ্রেণিতে। মনকে শক্ত করে কিছুটা জোর করেই পড়ায় মন দিল, কিন্তু আগের মতো কনফিডেন্স আর ফিরে পায়নি সে। উচ্চমাধ্যমিকে সেকেন্ড ডিভিশনে পাশ করে কলেজে পাস কোর্স নিয়ে ভর্তি হলো। দেখতে দেখতে সময় গড়িয়ে তিনটে বছর পার, রথীন বি.এ পাশ করে পড়া ছাড়ল। একের পর এক চাকরির পরীক্ষায় পাশ করলেও ইন্টারভিউএ উত্তীর্ণ হতে পারেনি। কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রথীন একটা ব্যাপার পরিষ্কার বুঝতে পেরেছিল, যে চাকরি পেতে গেলে হয় মামা, কাকা, দাদা না হয় বাপের টাকা থাকতে হবে। যার কোনোটাই নেই রথীনের। ছিল বলতে রাস্তা ধারের পাঁচ কাঠা জমিটা, সেটাও চলে গেছে দিদির বিয়েতে। আর এখন যেটুকু জমি আছে তার সবটাই রেললাইনের ওপারে জঙ্গল দিকে। বিক্রি করব বললেও কেউ নিতে চায় না।

গ্রামের ছেলে বাচ্চুদা, পার্টি পলিটিক্স করে, এম, এল, এ মন্ত্রীদের সাথে জানাশোনা আছে। রথীন বাচ্চুদাকে খুব করে ধরেছে, একটা চাকরি তার চাই। মাঠ ঘাট চাষবাস, জল-কাদা একদম ভালো লাগে না রথীনের। বাচ্চুর মোটর বাইকের পেছনে চেপে সব সময় ছুটছে এখান সেখান। সেও এখন পার্টির একজন সক্রিয় সদস্য।

চাকরিটা প্রায় পেয়েই গিয়েছিল রথীন, একটুর জন্য হাত ছাড়া। থানা থেকে সিভিক পুলিশের নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি বেরিয়েছিল। গ্রাম থেকে দুজনের কোটা ছিল। বাচ্চুদার চেষ্টায় তিন নম্বরে নাম ছিল রথীনের। বাচ্চুদা বলেছিল, শুধু পার্টি করলেই হয় না রে রথীন, তার সঙ্গে টাকারও দরকার। এখন তো সবাই পার্টি করে। মুখের সামনে টাকার বান্ডিল ছুড়ে মারতিস দেখতিস তিন নম্বর থেকে তর তর করে তোর নামটা লাফিয়ে এক নম্বরে উঠে আসত।

হতাশায় বিকারগ্রস্ত রথীনের সব রাগ গিয়ে পড়ে বাপের উপর। চাষবাস, গরু, আর পূজাপাঠের বাইরে কোনো কিছু ভাবতে পারেনি লোকটা।

ঘরে ফিরে এক পেট ভাতে-মুড়িতে খেয়ে নিমগাছের তলে বসে বিড়িতে সুখটান দেয় মদনখুড়ো। শরীরটা ভালো লাগছে না। গায়ে গতরে ব্যথা ব্যথা লাগছে, গা একটু গরম। তাহলে কি জ্বর আসবে? কে জানে। এই ক’টা দিন তো আর কম খাটালি হয়নি। তার উপর সময়ে অসময়ে বৃষ্টির জলে ভিজেছে। সে যাই হোক আর বসে থাকে না মদনখুড়ো। এক এক করে গোঁজ থেকে গরুগুলোকে খুলে ডোবার জলে ভালো করে গা ধুইয়ে দেয়। বিকালে আবার হেলে জোড়ার কাঁধে, শিংয়ে তেল দিতে হবে। এই ক’দিন শখের হেলে জোড়ার তো কম খাটালি যায়নি, লাঙল টেনে টেনে গরুগুলোর কাঁধের চামড়া উঠে গেছে। অবলা জীব মুখে কিছু বলতে পারে না, কষ্ট পেলে মুনিবের মুখের দিকে শুধু চেয়ে থাকে আর চোখ দিয়ে জল ঝরায়। তবে কাঁধে শিংয়ে তেল দেওয়া মানে গরুগুলোও জানে এখন মাস চারেক বিশ্রাম।

গলার দড়ি খুলে গরুগুলোকে চরাতে নিয়ে যায় মদনখুড়ো। রেললাইন পেরিয়ে কাঠবনের ডাঙায়। গায়ে গতরে ব্যথার সাথে গায়ের গরমটা বেশ খানিকটা বেড়েছে। বসে থাকতে ভালো লাগে না মদনখুড়োর, সবুজ ঘাসের উপর শুয়ে পড়ে।

কৃষি বিজ্ঞান অফিসে বিজ্ঞপ্তি বেরিয়েছে পনেরজন লোক নিয়োগ হবে। প্রথমে কন্টাক্টচুয়েল পরে পারমেন্ট। খবর পেয়েই রথীন ছুটেছিল বাচ্চুদার কাছে। এই সু্যোগটা হাত ছাড়া করা যাবে না। সেই মতো বাচ্চু রথীনকে নিয়ে গিয়েছিল এম, এল, এর কাছে। তিনি পরিষ্কার জানিয়েছেন লাখ তিনেকের নিচে তিনি কিছু করতে পারবেন না। বাচ্চুদা এম, এল, এ কে জানায়, দাদা দলের ছেলে, বাড়ির অবস্থা একদম ভালো নয়। বাবা পুরোহিত ব্রাহ্মণ। দিন আনে দিন খায় অবস্থা। মেরে কেটে বড়োজোর একলাখ।

—ঠিক আছে তুই যখন বলছিস তাই হবেক।

ঘরে ফিরে মাকে বুঝিয়েছে রথীন, চাকরিটা হয়ে গেলে তাদের সুখের সংসার হবে। নতুন ঘর হবে। বাবাকেও মাঠে খেটে মরতে হবে না। একটা অজানা সুখের রঙিন স্বপ্ন ভেসে উঠে রথীনের মায়ের চোখে।

এদিকে আকাশটা ঘণ কালো মেঘে ঢেকে গেছে, যেকোনো সময় আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামবে মুষলধারায়। বলতে না বলতেই বৃষ্টি এসে গেছে, মদনখুড়ো একটা গাছের তলে দাঁড়িয়ে হুশহুশ বিড়ি টানছে। গরুগুলো শাল জঙ্গল থেকে বেরিয়ে ঘরের দিকে ছুট দিয়েছে। আর দাঁড়িয়ে থাকে না মদনখুড়ো, বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে হাঁটা দেয় বাড়ির পথে।

বেলা গড়িয়েছে অনেকটা, গরুগুলো কাঠবনের ডাঙা ছেড়ে কখন উঠে গেছে শাল বনের জঙ্গলে, সেদিকে খেয়ালই করেনি মদনখুড়ো। এদিকে আকাশটা ঘণ কালো মেঘে ঢেকে গেছে, যেকোনো সময় আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামবে মুষলধারায়। বলতে না বলতেই বৃষ্টি এসে গেছে, মদনখুড়ো একটা গাছের তলে দাঁড়িয়ে হুশহুশ বিড়ি টানছে। গরুগুলো শাল জঙ্গল থেকে বেরিয়ে ঘরের দিকে ছুট দিয়েছে। আর দাঁড়িয়ে থাকে না মদনখুড়ো, বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে হাঁটা দেয় বাড়ির পথে।

বাড়ি ফিরে মদনখুড়ো হেলে গরুগুলোর কাঁধে-শিংয়ে ভালো করে তেল দেয়, কপালে ও খুরে সিঁদুর লাগায়। এই এলাকার চাষিদের এ এক প্রাচীন প্রথা। যা দেখে সবাই বুঝে যায় মদনখুড়োর ধান রোয়া পোঁতার কাজ শেষ হয়েছে।

সকাল থেকে শরীরটা খারাপ তার উপর বৃষ্টির জলে ভিজেছে। গায়ে হাত পায়ে বেদম ব্যথা বাড়ার সাথে জ্বর, আর বসে থাকতে পারে না মদনখুড়ো। কাঁথা ঢাকা নিয়ে শুয়ে পড়ে। বৃষ্টি পড়া বন্ধ হলেও এখনও মেঘটা গুড় গুড় ডাক দেওয়ার সাথে বিদ্যুতের ঝলকানি দিচ্ছে। চারিদিকে জমাট বাঁধা ঘণ অন্ধকার। মদনখুড়ো জ্বরের ঘোরে বেহুশ। রথীন ছুটেছে ডাক্তারের কাছে।

সকাল হতেই পুব আকাশের কোণে যথারীতি সূর্যটা খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। এখনও ঘুম ভাঙেনি মদনখুড়োর। কাল সারাটা রাত জ্বরের তরাসে থরথর করে কেঁপেছে। রথীন ও তার মা মাথার সিতেনে বসে সমানে জলপটি দিয়ে গেছে। বেলা বাড়ার সাথে সাথে বিছানা ছেড়ে উঠে বসে মদনখুড়ো।

সোনালি বিকেলের রোদ গায়ে মাখে মদনখুড়ো। কিছু দূরেই গোঁজে বাঁধা আছে গরুগুলো। সারাদিন গোটা খড় খেয়ে যাচ্ছে, ছানি কেটে দিতে পারেনি। জ্বরটা ছাড়লেও গা হাতপায়ে এখনো ব্যথা যায়নি। রথীনের মা রথীনের চাকরির বিষয়ে সব কথা জানায় মদনখুড়োকে। সব কথা শুনে বেশ দোটানার মধ্যে পড়ে যায় মদনখুড়ো। এক লাখ!কথাটা শুনতে ছোটো হলেও তার পরিধি যে কত বড়ো তা আর কেউ না জানুক মদনখুড়ো ভালো মতন জানে। কিন্তু কোথা থেকে আসবে একলাখ টাকা? ব্যাংকে হাজার পনের আছে, মরাই বাঁধা ধানগুলো বিক্রি করলে হাজার বারো আর রথীনের মায়ের যা গয়না আছে বিক্রি করলে মেরে কেটে হাজার কুড়ি, সব মিলিয়ে সাঁয়ত্রিশ হাজার। কিন্তু একলাখ হতে তো এখনো বহুদূর। নানান ভাবনা মনের মধ্যে ঘুরপাক খায়। মনের ভাবনাগুলো জটিল অঙ্ক হয়ে দাঁড়ায়, যার সমাধান করতে পারে না মদনখুড়ো। পশ্চিম আকাশের কোলে সূর্যটা মুখ লুকায়, সন্ধ্যা নেমে আসে, গোঁজে বাঁধা গরুগুলো গোয়ালে ঢোকার জন্য ডাক দেয়, এক দৃষ্টিতে গরুগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখে মদনখুড়ো। একলাখ টাকার জটিল অঙ্কের হিসাবটা সুন্দর মিলে যায়।

আশ্বিনের কুড়ি পার। আর ক’টা দিন, তারপরেই দুর্গাপুজো। চারিদিকে একটা পুজো পুজো গন্ধ ভাসছে বাতাসে। ধান জমির মাঝখানে যে দু-একটা উঁচু ঢিবি আছে সেখানে বাতাসের দোলায় কাশফুল মাথা নাড়ে। ধান গাছের শীষ থোড় মেলে উঠতে শুরু করেছে সবে। অন্যান্য বছর এতদিনে বাবা গণেশের দল হানা দিত। এবছর এখনো অবধি তেনাদের আগমনের কোনো খবর নেই। শুধু ল্যাংড়া একানে হাতিটা মাঝে মাঝে হানা দিচ্ছে। তবে দু-একজনের জমিতে হানা দিলেও মদনখুড়োর জমিতে এখনো পা দেয়নি। জঙ্গলের জলা জমিতে ধানের ফলন ভালো হয়, তবে খামারে ওঠার নিশ্চয়তা নেই। সে না থাকুক বুনো হাতির পেটে গেলেও তো বনবিভাগ থেকে ক্ষতিপূরণ হিসাবে একটা টাকা চাষির ব্যাংক একাউন্টে ঢোকে।

বিকালে ধান জমিগুলো এক চক্কর দিয়ে বাড়ি ফিরেছে মদনখুড়ো। ফাঁকা গোয়াল ঘরটার দিকে তাকালেই বুকের ভেতরটা কেমন হু হু করে ওঠে। কান্না পায়। বড়ো কষ্ট লাগে। লাগুক কষ্ট, সে কষ্ট সওয়া যাবে। রথীনটার জন্য কখনো কিছু করতে পারেনি মদনখুড়ো। এই প্রথম সব কিছু বেচেবুচে একলাখ টাকা জোগাড় করে ছেলের হাতে তুলে দিয়েছে। সবকিছু ঠিক হয়ে গেছে, পুজোর পরেই রথীন চাকরি পাবে। আগামীর স্বপ্ন ভেসে ওঠে মদনখুড়োর দু’চোখে।

নীল আকাশের বুকে টুকরো টুকরো মেঘের ছোটাছুটি, শান্ত সুন্দর একটা সকাল। মদনখুড়ো বনের মাঠ গেছে। রথীন সাত সকালে বাড়ির বাইরে। রথীনের মা রান্না ঘরে মুড়ি ভাজছে। এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে রথীন বাড়ি ফিরেই গোয়াল ঘরে ঢুকল। গোয়াল ঘরে ঢুকে সে এদিক ওদিক কি যেন খোঁজাখুঁজি করতে লাগল। গোয়াল ঘরের মাচায় তুলে রাখা গরু বাঁধা দড়ি গুলো থেকে একটা দড়ি নিয়ে সোজা উপর কোঠায় উঠে গেল। রথীনের মা ব্যাপারটা লক্ষ্য করে কিছু বুঝে উঠতে না পেরে মুড়ি ভাজা বন্ধ করে রথীনকে ডাক দিল— রথীন, রথীন!

রথীনের কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে তার মা উপর কোঠায় উঠে মেঝে ঘরের দরজা খুলতেই হতবাক। যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত। রথীনের মা দেখল রথীন গলায় দড়ি লাগিয়ে ঝুলছে। আর্তনাদ করতে করতে রথীনের মা রথীনের পা দুখানি জড়িয়ে ধরে উপর দিকে তুলে রইল।

—ও মাগো, ও বাবাগো, এ আমার কি সব্বনাশ হল গো, রথীন, এই রথীন, সাড়া দে বাবা।

রথীনের মায়ের আর্তনাদ শুনে পাড়ার সব ছুটে এলো। পাড়ার দু একজন সঙ্গে সঙ্গে দড়ি খুলে রথীনের ঝুলন্ত শরীরটা নিচে নামাল। কেউ চোখে মুখে জল দিল, কেউ পাখার বাতাস করতে লাগল। সঙ্গে সঙ্গে পাড়ার ছেলেরা রথীনকে নিয়ে ছুটল হাসপাতালে।

সবেমাত্র সবুজ ধানে সোনালি রঙের পাক ধরেছে। এই ক’টা দিন জমিগুলো একটু চোখে চোখে রাখতে হবে। বলা যায় না গরু-মোষে না ঘেঁটে দিয়ে যায়। এখন তো মাঠ ফাঁকা নেই, যত রাজ্যের গরু-মোষ সব জঙ্গলে চরতে আসে। মদনখুড়ো শিশুবাঁধের পাড়ে তেতুঁল তলায় বসে বিড়িতে সুখটান দিচ্ছে, আর ভাবছে রথীনের কথা। রথীনটা আজ ভীষণ খুশি হবে। এতক্ষণ হয়তো কৃষিবিজ্ঞান অফিস থেকে সুখবরটা নিয়ে বাড়ি ফিরেছে। মদনখুড়ো আর দেরি করে না, হাঁটা দেয় বাড়ির পথে।

পাড়ার মুখে ঢুকতেই থতমত খেয়ে যায় মদনখুড়ো। অন্যদিনের চেয়ে পাড়াটা আজ যেন কেমন থমকে আছে। গরাইদের একটা বউ মদনখুড়োর দিকে চেয়ে আছে এক দৃষ্টিতে। মুখে কোনো সাড়া নেই। কিছুটা এগোতেই মদনখুড়োর চোখে পড়ে তার বাড়ির সামনে পাড়ার সব জটলা পাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি, রথীণের চাকরির খবরটা তাহলে সবাই জেনে গেছে। এক পা এক পা করে এগোতে এগোতে মদনখুড়ো বাড়ির দরজায়, তাকে দেখে রথীনের মা আর্তনাদ করে আছড়ে পড়ল বুকে।

না, রথীন মরেনি। এ যাত্রায় বেঁচে ফিরেছে হাসপাতাল থেকে। আসলে এম, এল, এ রথীনের মতো অনেকের কাছে চাকরি দেওয়ার নাম করে মোটা টাকা খেয়ে বসেছিল। সেই কথা ফাঁস হতেই এম, এল, এর বাড়ি ঘেরাও করে দলেরই একাংশ। ভাঙচুর চালায় বাড়িতে, এম, এল, এ বেপাত্তা। শুধু যে চাকরি হয়নি তাই নয়, তার সঙ্গে খোয়া গেছে সর্বস্ব। খবরটা রথীনের কানে আসতেই সে নিজেকে সামলাতে পারেনি। কোন মুখে বাপের সামনে দাঁড়াবে? সেই কথা ভেবেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলছিল বাবার মুখোমুখি হবে না আর।

ঘড়ির কাঁটা যেন থমকে গেছে, সময় যেন কিছুতে পেরোতেই চায় না। বাড়ির কারো মুখে একটু হাসি নেই। মেঘলা আকাশের মতো সবার মুখ ভার হয়ে আছে। রথীনটা সবসময় ঘরেই থাকে, লজ্জায় বাইরে বেরোয় না। গলায় দড়ির দাগটা এখনো মিলিয়ে যায়নি। রথীনের মা সব সময় ছেলেটাকে চোখে চোখে রাখে, বলা যায় না যদি আবার কিছু করে বসে। রথীনের কথা ভাবলেই মদনখুড়োর বুকটা কেঁপে কেঁপে উঠে, মনটা হাউ হাউ করে কাঁদে। মাথাটা ভারী হয়ে যায়, দপ দপ করে। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করে, পারে না। চোখগুলো ছলছল করে, বমি পায়। কিন্তু বমি হয় না। ভীষণ কষ্ট লাগে।

মাঠের পাকা ধান কাটা হয়ে পড়ে আছে মাঠেই। আঁটি করে বাঁধা পর্যন্ত হয়নি। কাজ করতে ভালো লাগে না। শরীরে আগের মতো আর জোর আসে না।

দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর কিছুটা জোর করেই বনের মাঠে যায় মদনখুড়ো।

এখনো সে ভাবে শীত না পড়লেও একটা শীতের আমেজ এসে গেছে। রোদের তেজ অনেক নরম হয়েছে। গায়ে রোদ মেখে ধানের আঁটি বাঁধতে থাকে মদনখুড়ো।

দেখতে দেখতে সূর্যটা ঘণ শালের জঙ্গলে হারিয়ে যায়। একদল নাম না জানা পাখি উড়ে যায় মদনখুড়োর মাথার উপর দিয়ে। সন্ধ্যা নেমে আসে। মাঠ থেকে উঠে শিশুবাঁধের পাড়ে তেঁতুল গাছটার তলে গিয়ে বসে মদনখুড়ো। বিড়ি ধরায়। ঝুঁঝকি ঝুঁঝকি অন্ধকার জমাট বাঁধতে থাকে। ঘরে ফেরার যেন কোনো তাড়া নাই মদনখুড়োর।

মড়মড় করে একটা গাছ ভাঙার শব্দ কানে এলো, সেদিকে চাইতেই মদনখুড়ো দেখতে পেল ল্যাংড়া একানে হাতিটা তার দিকেই এগিয়ে আসছে। উঠে দাঁড়ায় মদনখুড়ো। দৌড় দেয়, একটু দৌড়েই হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে। কী যেন ভেবে এক পা এক পা করে আবার পিছিয়ে যায় হাতিটার দিকে। হাতিটার একদম কাছে এসে চোখ বন্ধ করে ফেলে। চোখ বন্ধ করতেই জমাট বাঁধা অন্ধকার ভেসে উঠে। সেই অন্ধকারেই মদনখুড়ো পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে, রথীন চাকরির চিঠি হাতে একমুখ হাসি নিয়ে ছুটে আসছে।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম ১৯৮৮ সালের ২রা মার্চ পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার এক প্রত্যান্ত গ্রাম হামিরহাটীতে। পিতা রবিলোচন চট্টোপাধ্যায় একজন পুজারী ব্রাহ্মণ। সাহিত্যের প্রতি অগাধ ভালোবাসায় তিনি কলম ধরেন। প্রথমে কবিতা দিয়ে শুরু করলেও বর্তমানে তিনি মূলত গল্পকার। ‘দ্যা কোল্ডফিল্ড টাইমস’ পত্রিকায় প্রথম কবিতা এবং ‘লগ্নউষা’ পত্রিকায় প্রথম গল্প প্রকাশ পায়। বর্তমানে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় নিয়মিত ছোটোগল্প লিখে চলেছেন। নেশা- ভ্রমণ ও বই পড়া।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।