বাংলাদেশের ইতিহাসে গৌরবময় এক অধ্যায়ের নাম মুক্তিযুদ্ধ এবং বাঙালির আবেগ-অনুভূতির এক বিশাল জায়গা জুড়ে আছে মুক্তিযুদ্ধের অবস্থান। তাই স্বাভাবিকভাবেই সেই আবেগ বিভিন্নভাবে প্রকাশিত হয়েছে সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রায় সকল শাখায়। বিশ্বের অনেক দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস, বিপ্লব ইত্যাদি শিল্পের অন্যান্য মাধ্যমের সাথে তাদের চলচ্চিত্রেও গুরুত্বসহকারে প্রতিবিম্বিত হয়েছে। সেই তুলনায় বাংলাদেশে সত্যিকার অর্থে একটি মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রের জন্য আমরা এখনো অপেক্ষায় আছি। শুধু মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রের কথাই বলছি কেন, স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে বন্ধ হয়ে যাওয়া সিনেমা হল এবং গত কয়েক বছরে নির্মিত চলচ্চিত্রের সংখ্যার দিকে তাকালেই আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী সময়ে কিছু ভালো চলচ্চিত্র নির্মিত হলেও, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে উল্লেখ করার মতো কয়েকটি চলচ্চিত্র বাদে এফডিসি কেন্দ্রিক নির্মিত মূলধারার চলচ্চিত্রগুলো একটি নির্দিষ্ট ফর্মুলার কাছে বন্দি হয়ে পড়ে। নকল সিনেমার ভীড়ে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের নিজস্ব কোনো চেহারাই দাঁড়ায়নি।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর, পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিসর্জনের নীলনকশার মাধ্যমে সাহিত্য-সংস্কৃতির বিকাশের পথও রুদ্ধ করে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। তবু কিছু মানুষ থাকে যারা শত বাধা বিপত্তিতেও মাথা নোয়ায় না, আপোষ করেনা। সেই গণতন্ত্রহীন বৈরী সময়ে সেই রকম কিছু তরুণ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও সুস্থ চলচ্চিত্র চর্চার স্বপ্ন নিয়ে একটা পরিবর্তনের তাগিদ থেকেই বিভিন্ন চলচ্চিত্র সংসদের সাথে যুক্ত হয়ে তারা একটি আন্দোলনের সূচনা করেন।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর, পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিসর্জনের নীলনকশার মাধ্যমে সাহিত্য-সংস্কৃতির বিকাশের পথও রুদ্ধ করে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। তবু কিছু মানুষ থাকে যারা শত বাধা বিপত্তিতেও মাথা নোয়ায় না, আপোষ করেনা। সেই গণতন্ত্রহীন বৈরী সময়ে সেই রকম কিছু তরুণ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও সুস্থ চলচ্চিত্র চর্চার স্বপ্ন নিয়ে একটা পরিবর্তনের তাগিদ থেকেই বিভিন্ন চলচ্চিত্র সংসদের সাথে যুক্ত হয়ে তারা একটি আন্দোলনের সূচনা করেন। একসময় ঐ তরুণরা চলচ্চিত্র পরিচালক আলমগীর কবিরের তত্ত্বাবধানে ও বাংলাদেশ ফিল্ম ইন্সটিটিউট ও আর্কাইভের উদ্যোগে একটি ফিল্ম এপ্রিসিয়েশন কোর্সে অংশগ্রহণ করেন। সেই কোর্সের অংশ হিসেবে এক তরুণ ‘হুলিয়া’ নামের একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন যার মাধ্যমে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের এক বিকল্প ধারার শুরু হলো। এ ধারার চলচ্চিত্র শুধুই দৈর্ঘ্যের কারণেই বিকল্প নয়, তা নির্মাণশৈলী, ফরম্যাট ও বিকল্পধারার প্রদর্শনীর কারণেও বিকল্প। ১৬ মিমি ফরম্যাটে নির্মিত বিকল্পধারার এই চলচ্চিত্রগুলো বিভিন্ন ফিল্ম সোসাইটির মাধ্যমে প্রদর্শিত হতো সিনেমা হলের বাইরে বিভিন্ন জেলা শহরের অডিটোরিয়ামে, বিশ্ববিদ্যালয়ে, মফস্বলের বাজারে আবার কখনোবা খোলা মাঠে। যার সৃষ্টির মাধ্যমে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতে এই বিকল্প ধারার সৃষ্টি হলো, তিনি আজকের বাংলাদেশের খ্যাতিমান পরিচালক তানভীর মোকাম্মেল। যিনি তাঁর নিজস্ব শৈলীতে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে নিয়ে গেছেন এক অনন্য উচ্চতায় এবং যার চলচ্চিত্র দেশের সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও এখন সমাদৃত। বিকল্প ধারার চলচ্চিত্র হিসেবে তানভীর মোকাম্মেল প্রথম কাজ শুরু করলেও এ ধারার চলচ্চিত্র হিসেবে মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম চলচ্চিত্র হলো ‘আগামী’, যার পরিচালক বাংলাদেশের আরেকজন খ্যাতিমান পরিচালক মোরশেদুল ইসলাম। তানভীর মোকাম্মেল ও মোরশেদুল ইসলাম দুজনেই আলমগীর কবিরের পরিচালনায় এই ফিল্ম এপ্রিসিয়েসন কোর্সের ছাত্র ছিলেন। তাদের সাথে আরও যারা এই কোর্সে অংশগ্রহণ করেছিলেন তাদের মধ্যে তারেক মাসুদ ও প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা মানজারে হাসীন মুরাদ অন্যতম।
‘আগামী’ ও ‘হুলিয়া’র মাধ্যমে শুরু হওয়া বিকল্পধারার চলচ্চিত্রগুলোর অন্যতম বিষয় ছিল মুক্তিযুদ্ধ। রাজনৈতিকভাবে প্রতিবাদী এইসব চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী স্বাধীনতাবিরোধীদের উত্থান ও সুবিধাবাদীদের পুঁজির পাহাড়ের বিপরীতে মুক্তযোদ্ধাদের মানবেতর জীবনযাপন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে স্থান পেয়েছে। এই তরুণ পরিচালকেরা বিকল্পধারার চলচ্চিত্রগুলোর মাধ্যমে জাতির ঘুমন্ত চিন্তায় ও মননে আঘাত হেনেছেন, আঘাত করেছেন জাতির আড়ষ্ট চিন্তার মর্মমূলে। নতুন প্রজন্মের মাধ্যমেই প্রবাহিত করতে চেয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে। নির্মলেন্দু গুণের কবিতার চিত্রনাট্যে নির্মিত তানভীর মোকাম্মেলের চলচ্চিত্র ‘হুলিয়া’ ঠিক মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র না হলেও, তাতে মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী সময়ের রাজনৈতিক ঘটনাবলী বিধৃত হয়েছে। যেখানে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শাসকের বাঙালিদের প্রতি শোষণ ও নির্যাতনের চিত্র ফুটে উঠেছে সিনেমার নিজস্ব ভাষায় ও বিভিন্ন মান্তাজের মাধ্যমে।
নির্মলেন্দু গুণের কবিতার চিত্রনাট্যে নির্মিত তানভীর মোকাম্মেলের চলচ্চিত্র ‘হুলিয়া’ ঠিক মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র না হলেও, তাতে মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী সময়ের রাজনৈতিক ঘটনাবলী বিধৃত হয়েছে। যেখানে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শাসকের বাঙালিদের প্রতি শোষণ ও নির্যাতনের চিত্র ফুটে উঠেছে সিনেমার নিজস্ব ভাষায় ও বিভিন্ন মান্তাজের মাধ্যমে।
১৯৫৮ সালের আইয়ূব খান সামরিক আইন জারি করে সমস্ত বাঙালির উপরই যেন এক হুলিয়া জারি করেন। একজন বাম নেতার উপর জারি করা হুলিয়া এবং এর তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে নির্মলেন্দু গুণ তার আলোচিত কবিতা হুলিয়া লেখেন। ১৯৮৫ সালে তানভীর মোকাম্মেল এই কবিতাটির চলচ্চিত্রায়ন করেন, যখন স্বাধীন বাংলাদেশ ছিল আরেক সামরিক শাসকেরর অধীনে। সেই দমবন্ধ সময়ে তানভীর মোকাম্মেল তার নির্মাণ ‘হুলিয়া’কে যেন একটি অস্ত্র হিসাবেই ব্যাবহার করলেন। ‘হুলিয়া’ শুধু বিকল্পধারার চলচ্চিত্রের অগ্রপথিক নয়, বাংলাদেশের প্রথম একটি পুর্ণাঙ্গ কবিতার চলচ্চিত্ররূপও; যেখানে কবিতার ভাষা প্রকাশিত হয়েছে চলচ্চিত্রের নিজস্ব ভাষায়। সিনেমাটির শুরুতেই দেখা যায় মাথায় হুলিয়া নিয়ে একজন বিপ্লবী তার নিজের গ্রামে ফেরার পথে স্টেশনের চায়ের দোকানে নামেন। ক্যামেরার প্যানিং এর মাধ্যমে চায়ের দোকানে বসা বাম রাজনীতিবিদ, দোকানের দেয়াল, টেবিল হয়ে তা একসময় দেয়ালে ঝোলানো জিন্নাহর ছবিতে স্থির হলে ব্যাকগ্রাউন্ডে একটি গ্লাস ভাঙার শব্দ শোনা যায় এবং চায়ের দোকানের মালিক বলেন ‘ভাঙলিতো গ্লাসটা?’। তানভীর মোকাম্মেল এই গ্লাস ভাঙার শব্দের সাথে জিন্নাহর ছবির ক্লোজআপের শট জুড়ে দিয়ে দেশভাগের মতো ইতিহাসের এক বেদনাদায়ক অধ্যায়ের উল্লেখ করেন সিনেমার অনবদ্য এক ব্যাকরণে। ‘হুলিয়া’য় ক্যামেরার নান্দনিক মুভমেন্ট, আবহ সংগীত এবং অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অভিনয়শৈলীতে কবিতা ও চলচ্চিত্রের দারুণ এক যুগল মিলন ঘটে। এই চলচ্চিত্রে পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাশাসকদের স্বৈরতন্ত্র, রাজনীতি ও বৈষম্যমূলক শাসননীতি প্রকাশিত হয় বিভিন্ন মান্তাজের মাধ্যমে।
‘আগামী’ ও ‘হুলিয়া’র পথ অনুসরণ করে তখন পরপর কয়েকটি বিকল্পধারার চলচ্চিত্র নির্মিত হয় এবং বেশিরভাগই মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র, তার মধ্যে মোস্তফা কামাল পরিচালিত ‘প্রত্যাবর্তন’, হারুনর রশীদ পরিচালিত ‘গৌরব’, জামিউর রহমান লেমন পরিচালিত ‘ছাড়পত্র’, খান আখতার হোসেনের ‘দুরন্ত’, আবু সায়ীদের ‘ধুসর যাত্রা’, হাবিবুল ইসলাম হাবিবের ‘বখাটে’, এনায়েত করিম বাবুলের ‘পতাকা’ অন্যতম। ১৬ মিমি ক্যামেরায় আশি ও নব্বই দশকে নির্মিত ‘আগামী’ ও ‘হুলিয়া’সহ এইসব চলচ্চিত্রের দৈর্ঘ্য ১৫ মিনিট থেকে এক ঘন্টা পর্যন্ত ব্যাপৃত ছিল। বিকল্পধারার চলচ্চিত্রের শুরুটা দারুণভাবে হলেও কর্পোরেট পুঁজির বিকাশ ও টেলিভিশন চ্যানেলের ক্রমবিকাশে প্যাকেজ নাটক নির্মাণের প্রতি নির্মাতাদের ঝোঁকের কারণে বিকল্পধারার চলচ্চিত্র নির্মাণ কিছুটা বাধাগ্রস্থ হয়। তবে তানভীর মোকাম্মেল, মোরশেদুল ইসলাম এখনো এই বিকল্পপথেই হাঁটছেন। তারেক মাসুদ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চলচ্চিত্র নির্মাণ করে গেছেন। তারেক মাসুদের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রামাণ্যচিত্র ‘মুক্তির গান’, ‘মুক্তির কথা’ এবং স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘নরসুন্দর’ এবং পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘মাটির ময়না’ বিষয় বৈচিত্র্যে ও নির্মাণে অনন্য। বাংলাদেশ শর্ট ফিল্ম ফোরাম ও বিভিন্ন চলচ্চিত্র সংসদের সাথে জড়িত নির্মাতা জাহিদুর রহিম অঞ্জন, নূরুল আলম আতিক, আকরাম খান, এন রাশেদ চৌধুরী সংখ্যায় কম হলেও গুনগত মানের দিকে কয়েকটি সমৃদ্ধ চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন এবং তা অব্যাহত রেখেছেন। এর মধ্যে সম্প্রতি নুরুল আলম আতিকের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’ মুক্তি পেয়েছে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ছোটোগল্প ‘রেইনকোট’ অবলম্বনে জাহিদুর রহিম অঞ্জন নির্মাণ করেছেন মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র ‘মেঘমল্লার’, হাসান আজিজুল হকের উপন্যাস অবলম্বনে আকরাম খানের ‘নকশী কাঁথার জমিন’ চলচ্চিত্রটি মুক্তির অপেক্ষায়। ‘আগামী’র পরে মোরশেদুল ইসলাম নির্মাণ করেন মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘শরৎ ৭১’, ‘সূচনা’ এবং পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘খেলাঘর’, ‘আমার বন্ধু রাশেদ’, ‘অনিল বাগচির একদিন’। ‘আগামী’ ও ‘হুলিয়া’র মাধ্যমে বিকল্পধারার চলচ্চিত্রের একটি আন্দোলন শুরু হলেও, তার আগে সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশের বিকল্পধারার চলচ্চিত্রের সূচনা হয়েছিল ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন জহির রায়হানের চলচ্চিত্র ‘স্টপ জেনোসাইড’ নির্মাণের মাধ্যমে। ঐ সময় আলমগীর কবিরের ‘লিবারেশন ফাইটার্স’ ও বাবুল চৌধুরীর ‘ইনোসেন্ট মিলিওনার্স’ নামের দুটো চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশে আলমগীর কবির মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক চলচ্চিত্র ‘ধীরে বহে মেঘনা’ নির্মাণ করেন, যে চলচ্চিত্রটি আলমগীর কবিরের চিত্রনাট্যে জহির রায়হানের পরিচালনা করার পরিকল্পনা ছিল কিন্তু জহির রায়হানের দুঃখজনক অন্তর্ধানে তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। এরইসাথে বিকল্পধারার চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে হারুনর রশীদের ‘মেঘের অনেক রং’ চলচ্চিত্রটির উল্লেখ না করলে তা অসম্পূর্ণই থেকে যাবে।
‘হুলিয়া’র পর তানভীর মোকাম্মেলের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নির্মিত কাহিনিচিত্রের মধ্যে ‘নদীর নাম মধুমতী’, ‘জীবনঢুলী’, ‘রাবেয়া’ অন্যতম এবং তার সর্বশেষ কাহিনিচিত্র ‘রুপসা নদীর বাঁকে’ও উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ। ‘নদীর নাম মধুমতি’ চলচ্চিত্রে অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও রূপক ও মান্তাজের সফল প্রয়োগ হয়েছে, যেমন খাঁচা থেকে মুক্ত কবুতরকে আকাশ উড়িয়ে দেওয়া, ক্লোজআপে মুরগি জবাইয়ের দৃশ্যের সময় পাকসেনাদের ঢাকা আক্রমণের খবর এবং জবাইকৃত মুরগির ছটফটানি ও রক্তদৃশ্যের পর পাকসেনা কর্তৃক গণহত্যার দৃশ্যের মন্তাজ যা এক গভীর বেদনাবিধুর দৃশ্যের সৃষ্টি করে। মুক্তিযোদ্ধা বাচ্চুর মনে রাজাকার পিতার স্নেহ ও দেশপ্রেমের ভাবনার সংঘাত বোঝাতে মধুমতির ঢেউয়ে মাঝিহীন নৌকার দোলার মন্তাজে চলচ্চিত্রের নিজস্ব ভাষারই স্বার্থক প্রয়োগ হয়েছে।
যেমন খাঁচা থেকে মুক্ত কবুতরকে আকাশ উড়িয়ে দেওয়া, ক্লোজআপে মুরগি জবাইয়ের দৃশ্যের সময় পাকসেনাদের ঢাকা আক্রমণের খবর এবং জবাইকৃত মুরগির ছটফটানি ও রক্তদৃশ্যের পর পাকসেনা কর্তৃক গণহত্যার দৃশ্যের মন্তাজ যা এক গভীর বেদনাবিধুর দৃশ্যের সৃষ্টি করে। মুক্তিযোদ্ধা বাচ্চুর মনে রাজাকার পিতার স্নেহ ও দেশপ্রেমের ভাবনার সংঘাত বোঝাতে মধুমতির ঢেউয়ে মাঝিহীন নৌকার দোলার মন্তাজে চলচ্চিত্রের নিজস্ব ভাষারই স্বার্থক প্রয়োগ হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলতে গিয়ে তানভীর মোকাম্মেল বার বার ফিরে গেছেন নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদীর কাছে, কারণ নদী মিশে আছে বাংলার মনুষের দৈনন্দিন জীবনাচারণে। সময়প্রবাহের সাথে সাথে নদীও তার বুকে ইতিহাসের অনেক আনন্দ -বেদনা ধারণ করে আজও বহমান। একাত্তরের গণহত্যার শিকার মানুষের মৃতদেহ নদী বহন করে নিয়ে গেছে কত বেদনায়, দেশহারা শরনার্থীদের কত অশ্রুই না নদীর জলের সাথে মিশে আছে। তাই মুক্তিযুদ্ধের কথা বলতে গিয়ে তানভীর মোকাম্মেলেকে বার বার নদীর কাছে ফিরে আসতেই হয়, যেভাবে ‘নদীর নাম মধুমতি’ চলচ্চিত্রে মুক্তিযোদ্ধা বাচ্চু তার রাজাকার পিতাকে হত্যা করে ফিরে আসে মধুমতী নদীর কাছেই। দু হাত আঁজলা করে নদীর জলে মুখে ধুয়ে যেন সে পবিত্র হয়। নদীর কিনারে নতজানু হয়ে মুক্তিযোদ্ধা বাচ্চু যেন নদীর কাছেই তার ঋণ স্বীকার করে। এক্সট্রিম লং শটে বাচ্চুর দৌড়ে যাওয়ার সাথে নদীর পটভুমি ও ভোরের সূর্যোদয় নতুন দিনের মুক্তির বার্তাই দেয়। এই নদীর পারে বসেই কাঁধে অস্ত্র নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা বাচ্চুকে বাঁশি বাজাতে দেখা যায়। বাচ্চু যখন তার রাজাকার পিতার চিঠি ছিঁড়ে নদীতে ফেলে দেয়, তখন নদীর ঢেউ এসে এই ছেঁড়া চিঠির টুকরোগুলো ভাসিয়ে নিয়ে যেন বাচ্চুকেই যন্ত্রণামুক্ত করে।
‘নদীর নাম মধুমতী’তে নিহত রাজাকার পিতার বুকের রক্তধারা মুক্তিযোদ্ধা পুত্রের পা স্পর্শ করে যেন ক্ষমা প্রার্থনা করে। যদিও তিনি আসল পিতা নন। মুক্তিযোদ্ধা বাচ্চুর পিতা মারা যাবার পর চাচার সাথে তার মায়ের বিয়ে হয়, যেখানে শেক্সপিয়ারের হ্যামলেটের ছায়া দেখতে পাওয়া যায়। বিভিন্ন ধর্মীয় মিথ ও আখ্যানের প্রতিরূপ দিয়ে তানভীর ‘নদীর নাম মধুমতী’র পিতা-পূত্রের এ সম্পর্ককে ব্যখ্যা করেন, যেখানে দেশের কল্যাণে এক পূত্র তার পিতার জীবনকে উৎসর্গ করে। এইরকম মিথের ব্যবহার চলচ্চিত্রের নিজস্ব ভাষারই অংশ। উপমহাদেশের প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক ঋত্বিক কুমার ঘটক তার বিভিন্ন চলচ্চিত্রে আর্কিটাইপাল ইমেজ এবং মিথের ব্যবহার করেছেন। চলচ্চিত্রে এই মিথের ব্যবহার প্রসঙ্গে ঋত্বিক বলেন,
‘এর গভীরতম দিকটি, এর স্বরূপ বুঝতে comparative mythology আমাদের প্রচুর সাহায্য করে। শুধু সিনেমার নয়, সর্বকালের সব শিল্পেই। আমরা নব মনস্তাত্ত্বিকদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও গবেষণা থেকে শিল্প বিচারের কতকগুলো মূলসূত্র পাই, যাকেই comprative mythology আমাদের সামনে illustrate করে।’
তানভীর মোকাম্মেলের ‘জীবনঢুলী’তেও মিথের ব্যবহার দেখা যায়, যেখানে পূজার সময় ঢাক বাজাতে গিয়ে জীবনঢুলী জমিদার বাড়ির নারীর মাঝেই খুঁজে পায় তার মনের দুর্গা প্রতিমাকে, আবার এই নারীকে যখন পাকিস্তানি বাহিনীর দোসররা বন্দি করে এবং আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করে, তখন জীবনঢুলী তার ঢাক নিয়ে স্বাধীন ভূমিতে বিসর্জনের বাজনা বাজিয়ে তার প্রতিবাদ করে এবং ঐ নারীর প্রতি তার সম্মান জানায়। যে নারীর প্রাণ বিসর্জনের মাধ্যমে পাক অসুররা বধ হয়, সেই নারীর মাঝেই সে দুর্গা প্রতিমাকে আবিষ্কার করে। আবার জমিদার বাড়ির এই নারীকে রাজাকারেরা যখন ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যায়, তখন ব্যাকগ্রাউন্ডে শোনা যায়, ‘মাকে ভাসাইয়া জলে, কী ধন নিয়া যাইব ঘরে।’
ক্যাম্পঘরের খোলা জানালা দিয়ে জীবন যখন ঐ লাঞ্ছিত নারীর মুখ দেখে, তখন সে যেন ঐ প্রতিমায় আরেকবার মাতৃরূপ দেখতে পায়। এই তো তার দেশমাতৃকা। ঐ খোলা জানালা যেন মাতৃভূমির মুক্তির রূপক হিসাবে আসে। তানভীর মোকাম্মেলের ‘জীবনঢুলী’তে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের নিম্নবর্গের হিন্দুদের উপর নির্যাতন এবং খুলনার চুকনগরের নির্মম গণহত্যার বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বিধৃত হয়েছে, উঠে এসেছে শরণার্থীদের দেশ ছাড়ার চিত্রও। জীবন কৃষ্ণ দাস সেই গণহত্যা থেকে বেঁচে ফেরা এক তরুণ ঢাকি, যে ঢাক মিশে আছে বাংলার সংস্কৃতিতে, লোক-ঐতিহ্যে। তাই পাকসেনা ও তাদের এদেশিয় দোসরদের এই ঢাক সহ্য হয় না। রাজাকারদের মনোরঞ্জনের জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত জীবনের হাতে তুলে দেওয়া হয় বিহারীদের ড্রাম। নীরবে কেঁদে ফেরে জীবন। আমরা স্মরণ করতে পারি সেই দৃশ্যের, যেখানে ঘরের চালের ফুটো দিয়ে ঢাকের উপর বৃষ্টির ফোটা পড়ে এক কাব্যময় দৃশ্যের সৃষ্টি হয়, এক মনখারাপ করা শব্দের সৃষ্টি হয়, যে বেদনার শব্দ প্রতিনিয়ত বেজে চলছে জীবনের বুকেও; কারণ সে প্রতিনিয়ত দেখছে রাজাকারদের নৃশংসতা, নারীদের অপমান। তার চোখের সামনেই এক মাকে রাজাকারদের উদ্দেশ্যে করে আহাজারি করতে শুনেছে, ‘তোমরা একজন একজন করে আগমন কর বাবারা, আমার মেয়েটা ছোটো।’
এইসব দেখে নিম্নবর্গের সামান্য ঢাকিবাদক জীবন বড়ো অসহায় ও বিপণ্ণ বোধ করে! তার বেদনার অশ্রু বুকের ঢাকে বেজে যায় অবিরত। তাই স্বাধীন ভূমিতে সে আপ্রাণ বাজিয়ে চলে তার ঢাক, যে দৃশ্যের মাধ্যমে শেষ হয় চলচ্চিত্র ‘জীবনঢুলী’।
চোখের সামনেই এক মাকে রাজাকারদের উদ্দেশ্যে করে আহাজারি করতে শুনেছে, ‘তোমরা একজন একজন করে আগমন কর বাবারা, আমার মেয়েটা ছোটো।
প্রায় আড়াইহাজার বছর আগের গ্রীক নাট্যকার সোফোক্লিসের নাটক ‘আন্তিগোনে’র ছায়া অবলম্বনে তানভীর মোকাম্মেল নির্মাণ করেন চলচ্চিত্র ‘রাবেয়া’। রাবেয়াতে মুক্তিযুদ্ধের পাশাপাশি নারীমুক্তির বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিধৃত হয়েছে। রাজনৈতিক লড়াইয়ে মৃত ভাই পলিনিসেসের লাশ দাফন করা নিয়ে আন্তিগোনের মামা ক্রেয়নের অনৈতিক সিদ্ধান্তের সাথে তার নৈতিক লড়াই শুরু হয়। অকাট্য যুক্তি উপস্থাপন করে আন্তিগোনেকে বেছে নিতে হয়েছিল মৃত্যুর পথ কিন্তু ক্রেয়ন রাজনৈতিক কারণে, শক্ত হাতে প্রজা শাসনের দোহাই দিয়ে পলিনেসেসের লাশকে খোলা আকাশের নিচে ফেলে রেখে কাক শকুনের খাবারে পরিণত করার অপেক্ষায় ছিলেন। তানভীর মোকাম্মেল আন্তিগোনের এই কাঠামোকে স্থাপন করলেন তার রাবেয়া সিনেমায়। এখানে আন্তিগোনের ছায়ায় রাবেয়া চরিত্রে বন্যা মির্জা এবং ক্রেয়নের ছায়ায় রাজাকার এমদাদ কাজীর চরিত্রে আলী যাকের অনবদ্য অভিনয় করেছেন। পুরো চলচ্চিত্র শক্তিশালী সংলাপের গাঁথুনির মাধ্যমে বিভিন্ন যুক্তি তর্ক উপস্থাপনের মাধ্যমে এগিয়ে গেছে। পিতৃতান্ত্রিক ও বৈষম্যমূলক সমাজ ব্যাবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে রাবেয়াকে তার অধিকার আদায়ের লড়াই করতে হয়েছে। চলমান মুক্তিযুদ্ধের সাথে রাবেয়ার এই যুদ্ধও নারীমুক্তির যুদ্ধ। এই চলচ্চিত্রেও তানভীর বিভিন্ন ধর্মীয় মিথ ও আখ্যানকে ব্যাবহার করেন সমাজে চলমান ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরূদ্ধে, যে ধর্মকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করতে চেয়েছিল পাক হানাদার বাহিনীর এদেশিয় দোসররা। বাঙালির মনে ভয় ধরিয়ে দেওয়ার জন্য গেরিলা যুদ্ধে নিহত মুক্তিযোদ্ধা খালেদের লাশকে নদীর বাধে ফেলে রাখার নির্দেশ দেয় পাক কমান্ডার এবং এই নির্দেশ পালনে কার্যকরী ভূমিকা রাখেন খালেদের ফুফা রাজাকার এমদাদ কাজী কিন্তু তাতে বাধা হয়ে দাঁড়ায় খালেদের বোন রাবেয়া, কারণ মৃতদেহের সৎকার মৃতের অধিকার ও একটি পবিত্র কাজ। কিন্তু পাকিস্তানি সেনাবাহিনীরা লক্ষ লক্ষ বাঙালিকে হত্যা করে ফেলে রেখেছিল রাস্তায়, পুকুরে, ডোবায় কিংবা ভাসিয়ে দিয়েছিল নদীর জলে। ‘জীবনঢুলী’তে তানভীর মোকাম্মেল মুক্তিযোদ্ধা খালেদের লাশের পাশাপাশি নদীতে ভাসমান ও খোলা মাঠে রক্তাক্ত লাশের ছবি দৃশ্যায়িত করেন, যা দেখানো হয় এক বয়াতীর চোখে। মুক্তিযোদ্ধা খালেদের লাশ দাফন করা নিয়ে রাবেয়া ও তার ফুফার যুক্তিতর্কের কথোপকথনের দৃশ্যায়নে তানভীর সিনেমার অনবদ্য এক ভাষার প্রয়োগ করেছেন যা তানভীর মোকাম্মেল তার বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে নিজেও ব্যাখ্যা দিয়েছেন। যেমন রাবেয়া যখন তার ভাইয়ের লাশ দাফন করতে গিয়ে রাজাকারদের হাতে ধরা পড়ে এবং তার ফুফার সামনে দাঁড়ায়, তখন রাবেয়ার ফুফা রাজাকার এমদাদ কাজী বারান্দার সিঁড়ির উপরে ছিলেন, রাবেয়া যখন তার যুক্তি দিয়ে এমদাদ কাজীকে কুপোকাত করছে তখন রাবেয়া সিঁড়ি ভেঙে ধীরে ধীরে উপরের দিকে ওঠে অর্থাৎ সে যুক্তিতে জিতছে এবং একই সাথে এমদাদ কাজী সংলাপ বলতে বলতে নিচের দিকে নামেন অর্থাৎ এমদাদ কাজী হেরে যাচ্ছেন। এই যুক্তি তর্কে তানভীর মোকাম্মেল বিভিন্ন মিথের উদাহরণ নিয়ে আসেন যা সংলাপে ও বন্যা মির্জার অভিনয় শৈলীতে আরও অনবদ্য হয়। এমদাদ কাজীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিচ থেকে রাবেয়ার এই যে ঊর্ধ্বমুখি আরোহন তা এক অর্থে সকল কূপমণ্ডুকতা ও কুসংস্কারের বেড়াজাল ছিন্ন করে নারীমুক্তির বারতাও বটে। আবার রাবেয়ার এই আরোহনের বিপরীতে এমদাদ কাজীর অবরোহন এবং টপশটে দেখানো খর্বকায় শটে তার বামন ভাবনাই রূপক হিসেবে আসে। রাবেয়া চলচ্চিত্রটি সংলাপ প্রধান। রাবেয়া, বয়াতী ও এমদাদ কাজীর ধার্মিক চাচার সাথে এমদাদ কাজীর দীর্ঘ সংলাপে ধর্মীয় কুসংস্কার ও জীবনদর্শনের বিভিন্ন দিক উঠে আসে। বিভিন্ন দৃশ্যের মাঝে এমদাদ কাজীর পাগল ছোটো ছেলের উপস্থিতি যেন দৃশ্যগুলোর আন্ডারলাইন হিসাবে ব্যবহৃত হয়। যেমন এমদাদ কাজীর ভ্রান্ত ধারণাকে বয়াতী যখন তার দর্শন ও ধর্মচিন্তা দিয়ে নাকচ করে দিচ্ছে, তখন পাগল ছেলেটির মাউথ অর্গানের সুর এই বক্তব্যের উপর গুরুত্বারোপ করে। আমরা স্মরণ করতে পারি ‘নদীর নাম মধুমতী’ চলচ্চিত্রের সেই মানসিক ভারসাম্যহীন মেয়েটির কথা। যুদ্ধে পরিজন সবাইকে হারিয়ে, পাক আর্মিদের দ্বারা নির্যাতিত এই মেয়েটির সবাইকে মৃত মানুষ মনে হয়, তাই বাচ্চুদের দেখে মেয়েটি চিৎকার করে বলে, ‘এই মানুষ, এই মানুষ, তোমরা শুয়ে পড়, তোমরা শুয়ে পড়, মৃত মানুষদের দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক না।’
এই রকম চরিত্রদের তানভীর মোকাম্মেলের বিভিন্ন চলচ্চিত্রে দেখা যায়, যারা যাত্রার বিবেকের মতো মাঝে মাঝে উপস্থিত হয়, যেমন দেখা গিয়েছিল ‘চিত্রা নদীর পারে’ এবং ‘জীবনঢুলী’তেও।
পাক আর্মিদের দ্বারা নির্যাতিত এই মেয়েটির সবাইকে মৃত মানুষ মনে হয়, তাই বাচ্চুদের দেখে মেয়েটি চিৎকার করে বলে, ‘এই মানুষ, এই মানুষ, তোমরা শুয়ে পড়, তোমরা শুয়ে পড়, মৃত মানুষদের দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক না।’
তানভীর মোকাম্মেলের ‘রূপসা নদীর বাঁকে’ চলচ্চিত্রের কেন্দ্রীয় চরিত্র মানব মুখোপাধ্যায়, দক্ষিণাঞ্চলের বাম রাজনীতিবিদ বিষ্ণু চট্টপাধ্যায়ের ছায়াছবি হয়েই যেন ইতিহাসের নানা বাঁক থেকে আমাদের ভ্রমণ করিয়ে আনেন। ‘রূপসা নদীর বাঁক’ থেকে আমরা ফিরে যাই স্বদেশী আন্দোলন, বিশ্বযুদ্ধ, মন্বন্তর, তেভাগা আন্দোলন, দেশভাগ, খাপড়া ওয়ার্ড হত্যাকাণ্ড, ভাষা আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান এবং মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল দিনে। ইতিহাসের বাঁক থেকে উঠে এসে বিষ্টু ঠাকুর যেন মানব মুখোপাধ্যায়ের মাঝে হয়ে ওঠেন কমরেড ঠাকুর। বিষ্ণু চট্টপাধ্যায় আজীবন শাসকের শোষনের বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকে পরিচিতি পেয়েছিলেন বিষ্টু ঠাকুর হিসাবে। স্বদেশী আন্দোলন থেকে শুরু করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ছিল তার সরব উপস্থিতি। কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে, জমিদারতন্ত্রের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে, লাঠিয়াল ও পুলিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে, হাজার হাজার কৃষক শ্রমিক নিয়ে শোভনার প্রজাবান্ধি বাঁধ নির্মাণ করে তিনি আজও কিংবদন্তি। ইতিহাসের বিভিন্ন বাঁক পেরিয়ে বাহান্নর ভাষা আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান শেষে আসে মহান মুক্তিযুদ্ধ। জেল ফেরত মানব মুখোপাধ্যায় সক্রিয় হয়ে যান মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন সাংগঠনিক কাজে। সঙ্গী তার সাইকেল। সবার নিষেধ সত্ত্বেও একদিন মুসলিমলীগের এলাকায় যাবার পথে, রাজাকারদের অস্ত্রে গুলিবিদ্ধ হন কমরেড মানব। রেললাইনের ওপর পড়ে থাকে তার নিথর দেহ। পাশে পড়ে থাকে চিরসাথী সাইকেল। টপ শটে দেখা যায় নিথর মানবের পাশে পড়ে থাকা সাইকেলের চাকা, যা ঘুরতে ঘুরতে এক সময় স্তব্দ হয়ে যায়। ক্যামেরা মানবের মৃতদেহের উপর থেকে লং-শটে সমান্তরাল রেল লাইনের উপর যখন স্থির হয়, তখন কেমন এক শূন্যতার অনুভুতি হয়। মানব মুখোপাধ্যায় সময়ের পরিভ্রমণ শেষে মিলিয়ে গেলেন অসীমে, শূন্যতায়। যে মানব মুখোপাধ্যায় তার সারাজীবন সমর্পণ করেছেন শ্রেণী সংগ্রামে, কৃষকদের কল্যাণে, স্বাধীনতা সংগ্রামে, সেই মানবের মৃতদেহ পড়ে থাকে রেল লাইনের উপর একজন ‘নাস্তিক’, ‘মালাউন’ কমিউনিস্ট অভিধা নিয়ে!
মুক্তিযুদ্ধের সাথে সাথে দেশভাগের বেদনাও তানভীর মোকাম্মেলকে প্রতিনিয়ত তাড়িয়ে ফিরেছে। তাই শুধু চলচ্চিত্র নয়, তানভীর মোকাম্মেলের রচিত কবিতা, উপন্যাসেও দেশভাগের গভীর বেদনার রূপ প্রতিফলিত হয়েছে। দেশভাগ নিয়ে তানভীর মোকাম্মেল একটি তথ্যচিত্র ‘সীমান্ত রেখা’ ও পূর্ণাঙ্গ কাহিনিচিত্র ‘চিত্রা নদীর পারে’ নির্মাণ করেন। এছাড়াও তার সর্বশেষ চলচ্চিত্র ‘রূপসা নদীর বাঁকে’ চলচ্চিত্রে দেশভাগ উঠে এসেছে নানা ব্যঞ্জণায়। এই যে নিজের মাতৃভূমি ছেড়ে শরণার্থীর জীবন তা দেশভাগের সময় থেকে মুক্তিযুদ্ধ হয়ে এখন পর্যন্ত বহমান। তানভীর মোকাম্মেলের মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রগুলোতেও শরণার্থীদের মিছিলের দৃশ্যও উঠে আসে গভীর বেদনায়। তাই ‘জীবনঢুলী’ চলচ্চিত্রে মাতৃভূমি ছেড়ে যাওয়া মানুষের দীর্ঘ লাইনের আবহসংগীতে ভেসে আসে গান, ‘মায়ের মাটির আঁচল ছেড়ে পথ করেছি সাথি/চোখের জলে নদী গড়ে দুখ সাগরে ভাসি’।
এই গানের কথাগুলো শরণার্থীদের বেদনার সাথে দারুণভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে যায়, যা তার অন্যান্য চলচ্চিত্রেও সমান গুরুত্ব পেয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের কাহিনিচিত্রের পাশাপাশি তানভীর মোকাম্মেল তিনটি প্রামাণ্যচিত্রও নির্মাণ করেন। প্রামাণ্যচিত্রগুলো হলো ‘স্মৃতি ৭১’, ‘১৯৭১’ ও ‘তাজউদ্দীন আহমদ : এক নিঃসঙ্গ সারথি’। বছরের পর বছরের পর দীর্ঘ গবেষণার ফসল এই প্রামাণ্যচিত্রগুলো নিয়ে আলাদা করে আলোচনার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। তানভীর মোকাম্মেলের মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক কাহিনিচিত্র ও প্রামাণ্যচিত্রগুলো বাংলাদেশের চলচ্চিত্রশিল্পকে সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি নতুন প্রজন্মেদের কাছে মহান মুক্তিযুদ্ধের এক প্রামাণ্য দলিল হয়ে থাকবে। শেষ করছি শরণার্থী নিয়ে তানভীর মোকাম্মেলের একটি কবিতার শেষের কয়েকটি লাইন দিয়ে, যা তার প্রামাণ্যচিত্র ‘১৯৭১’-এ ব্যাবহৃত হয়েছিল শরণার্থীর মিছিলের দৃশ্যে।
মাটির আদম যাবে মাটিতে মিশে
অবিনাশী সে তত্ত্ব মাখামাখি মানুষ ও কাদায়
ঈশ্বরহীন আকাশতলে মানবতা শুধু
হেটেছিল সাথী হয়ে বিক্ষত পায়
অন্তরে জপে এক আদিম বীজমন্ত্র
আধার ই শেষ কথা নয়
শিউলি ভোর আর সহৃদয় আশ্রয় রয়েছে কোথাও
তারা হেটেছিল নিঃশব্দে
শরণার্থী একাত্তর
তথ্যসুত্র :
১) মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র -অনুপম হায়াৎ, বঙ্গজ প্রকাশনী।
২) চলচ্চিত্র বিষয়ক ছোটো কাগজ প্রক্ষেপণ, সম্পাদনা এস ডি শ্যামল ও এ কে এম ইমরান, প্রকাশকাল : ২০০৪, শাবিপ্রবি।
পেশায় ব্যাংকার। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থ বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর। শাবিপ্রবির চলচ্চিত্র বিষয়ক সংগঠন চোখ ফিল্ম সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক হিসাবে চলচ্চিত্র বিষয়ক ছোটোকাগজ ‘প্রক্ষেপণ’ সম্পাদনায়ও যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে বিভিন্ন ওয়েব পত্রিকায় নিয়মিতভাবে চলচ্চিত্র বিষয়ক প্রবন্ধ ও গল্প লিখছেন।