ভূমিকা:
বাউল মোহাম্মদ ফারুক শাহ বসত করেন মৌলভীবাজারের রাজনগর থানার দাসপাড়া গ্রামে। ছিয়াত্তর বছরের সাধক জীবনে তিনি মিডিয়া চেনেন না। আয়োজন করে কেউ তাঁর ছবি ওঠায়নি, তাঁর নামে দুই কলম লেখেনি। নিজের হাতে বানানো খেলনার মতো ছোট্ট একটা দোতারা হাতে ফকির বেশে দেশে দেশে ঘুরে বেড়ান। তাঁর বিবেচনায়, সাধনার এই জগতে থাকতে হবে আড়াল। আপে আল্লাহ নিরঞ্জন তো নিজের ও তাঁর সৃষ্টির মাঝে বিশাল আড়াল রেখেছেন। মারফত তো এই শিক্ষাই দেয়, প্রতিটা জীবসত্তা ও জড়সত্তার মাঝে স্রষ্টার সিফত লুকিয়ে আছে। তার ভেতর যে গান লুকিয়ে আছে, যে সত্য আড়ালে পড়ে আছে, তাকে বুঝতে চেষ্টা করা। ধারণ করা। মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি তাঁর ‘মসনবী’ শরিফের কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, আমি কোরআনের মজ্জা শুষে নিয়ে হাড়গুলো রেখে দিয়েছি কাঠমোল্লাদের জন্য।
গান বিষয়ে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ইমাম গাজালী (রাঃ) এর ‘কিমিয়ায়ে সাআদত’, দেওবন্দ এর আশরাফ আলী থানভি (রাঃ) এর ‘নসরুততিব ফি যিকরিল হাবীব’ ইত্যাদি কিতাবে উনারা কোরআন ও হাদিসের দলিল দিয়ে এবং কিছু শর্ত সাপেক্ষে গানকে স্পষ্টভাবে বৈধ বা জায়েজ ঘোষণা করে গেছেন। মারফতের একটা ভাষা আছে। এই ভাব-ভাষা ধরার জন্য যে এলেম থাকা দরকার তা হাছিল করার জন্য আমাদের আলেম সমাজের সময় আছে কি? এই তরফে কত রুটিরুজি, সুবিধা জড়িত।
পৃথিবীতে মানুষ যত বাড়বে, গাছ-বৃক্ষ-পশু-পাখি তত কমবে। গান যত কমবে, ওয়াজ-মাহফিলে লোক সমাগম তত বেশি হবে। তাই আলেম সমাজ গানকে (মারফতের কালামকে) এত ভয় পায়। সে জন্যই তো তারা গানের উপর নাজায়েজ সিল মেরে কবর দিতে চান।
গান এবং বাজনা এই দুইটা করতে হলে তো আল্লাহ ও তাঁর রসুলের যে মহিমা এইটা বুঝতে হবে। আল্লাহর যে হকিকত, নবীর যে হকিকত, আল্লাহ ও নবীর মধ্যে যে রহস্য, গানের বিষয়ে এইগুলা থাকতে হবে। হাল-অবস্থা থাকতে হবে। হাল-অবস্থা বলতে কোনো লোভ-লালসা, কাম-কাতরতা থাকবে না। তিনি বলেন, যারা গানকে নাকচ করে দিতে চান তাদের কাছে আমি ফারুক শাহ মিনতি করছি, আপনারা অইসব মহাত্মনদের কিতাবগুলা পড়ে গানের বিষয়ে রায় দিবেন।
ফারুক শাহর জীবন তো পথেই কেটেছে। তাই রাত হলে কোথাও না কোথাও ঠাঁই নিতেন। চুল-দাড়ি-গোঁফ কিংবা বেশবাস তো বাউলের। তাই আশ্রয়ও দিতেন গানের রসিকরা। সাথের সম্বল তো ছেঁড়া-ফাড়া একটা ব্যাগ ও খেলনা দোতারাটা। আশ্রয়দাতা গান শুনতে চাইতেন। দুই-একটা গানেই তারা সাধককে চিনতে পারত। একটু সুযোগ পেলেই চুরি করত গানের খাতা। এইভাবে চৌষট্টি বছরের সাধক জীবনে গানের খাতা চুরি হয়েছে আট-নয়টা। দুঃখে, অভিমানে বর্তমানে তিনি গান লেখাই ছেড়ে দিয়েছেন।
ফারুক শাহ কথা বলেন নরম আর মিষ্টি সুরে এবং শুদ্ধ ভাষায়। পিতা শাহধন পীর ছিলেন অনেক বড়ো সাধক ও মহাজন। মা মোছাম্মৎ আমেরুন নেছা ছিলেন সাধক বাবার যোগ্য সাধন সঙ্গিনী।
ফারুক শাহর মতো তাঁর পিতাও নিজের হাতে দোতারা বানাতেন। প্রিয় শিষ্য-ভক্তদের সবকের প্রথমদিনই হাতে তুলে দিতেন নিজের স্বপ্ন দিয়ে গড়া নতুন একটা দোতারা। নানা দেশ থেকে পীর-ফকির-ভক্তরা আসতেন তাঁর বাবার কাছে। রাতভর চলত গান। মাত্র বারো বছর বয়সের সময় তাঁর বাবার আসরে গাওয়া নিচের গানটি তাকে পাগল করে।
প্রাণ সখী গো, আমারে বন্ধুয়ার মনে নাই,
আমি বন্ধু হারা পাগল বেশে, কার কাছে দাঁড়াই।
আমার বত্রিশ বছর বাউল-সঙ্গ জীবনে বাউল মকদ্দস আলম উদাসী ছাড়া এমন গভীর সাধক আর দেখিনি। দীর্ঘ দেহের মানুষ ফারুক শাহর নাক-মুখ, দাড়ি-গোঁফ ও মাথার পিছন দিকের ছোট্ট খোঁপাটা দেখলেই লালনের কথা মনে পড়ে। তাঁর প্রাচীন দেহ, মুর্শীদের প্রতি ভক্তি ও ভাবের রসে টইটুম্বুর হৃদয় হলে কী হবে, তিনি অভাব আর পথের কষ্টে আজ ক্লান্ত। কথায় কথায় দম নেন। উন্নয়নের জোয়ারে ভাসতে থাকা আজকের এই বাংলাদেশে সবাই যখন পেট-পাছার চর্বি নাচিয়ে ঘুরছেন তখন তিনি মাথিউড়া, লোহাইওনি ইত্যাদি চা-বাগানের নির্জনে মোরাকাবায় বসেন মুর্শীদের রূপের সন্ধানে।
প্রথম বিয়ের কিছুদিন পরেই মা-ভাইয়ের জিম্মায় স্ত্রীকে রেখে তিনি বেরিয়ে পড়েছিলেন লম্বা সফরে। বছর দেড়েক পরে এসে দেখেন, চার মাসের এক মেয়ে সন্তানকে রেখে ভাবী চক্রান্ত করে অভাগীকে অন্য লাইনে ভাগিয়ে দিয়েছে। তাই তো তিনি তাঁর ওস্তাদ হাজী মোহাম্মদ শুকুর শাহ ওলির এই গান গাইতে গাইতে আবার বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন।
যে জ্বালা দিয়াছ বন্ধু রে,
অরে অ বন্ধু,
তনে তো কুলায় না।
স্ত্রী পালিয়ে যাওয়ার জন্যই হউক কিংবা নারী চরিত্রের জটিলতার কারণেই হউক এর পরেই তিনি লেখেন:
অরে, চিনি খাওরা রাক্ষসীরে মারো, যদি পারো,
রাক্ষসিনীর লম্বা ঠোঁটে,
মণিপুরের মধু লুটে,
কামের চুটে উথালে সাগর, যদি পারো,
চিনি খাওরা রাক্ষসীরে মারো।
রাক্ষসিনীর জিব্বা লম্বা,
বুকে তার দুইটা থুম্বা,
পেটে লম্বা আছে অজগর,
থাকে যদি আধ্য মন্ত্র,
ভাঙ্গিয়া লও দন্ত,
সাধন বলে থুম্বায় গিয়া ধরো, যদি পারো,
চিনি খাওরা রাক্ষসীরে মারো।
রাক্ষসিনী মায়াবিনী, রাক্ষসিনী কাম-কামিনী,
ডুব দ্যায়া মণি তুলতে যদি পারো,
থাকে যদি সাধন সম্বল,
পারবে না আর মারতে রে চুম্বল,
চালাও দমকল, অরে চালাও দমকল,
পানি তুলে ছাড়ো, যদি পারো,
চিনি খাওরা রাক্ষসীরে মারো।
রাক্ষসিনীর কামড় শক্ত,
চুমুকে টানিবে রক্ত,
তন্ত্রমন্ত্র হইবে অসার,
ফারুক শাহ কয়, ধরতে পারি রে দয়াল,
থাকে যদি সাথের জরি,
থাপা মারিয়া, যাব নিয়া,
মুর্শীদ মাওলার ধারো,
চিনি খাওরা রাক্ষসীরে মারো, যদি পারো।
প্রথমদিনই স্কুল থেকে পালিয়েছিলেন। আর বেঁধেও তাঁকে স্কুলে নিতে পারছেন না দেখে, মা তাঁকে অক্ষর জ্ঞান দিয়েছিলেন। বাবা নিজের হাতে বানানো দোতারা তুলে দিয়ে অন্তর উজাড় করে দিলেন এলেম। বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রথম মাসেই তিনি লেখেন:
বংলাদেশে স্বাধীনতা এনে দিলেন শহীদগণ,
তাঁদের কথা দিলে গাঁথা,
থাকবে মোদের সারাক্ষণ, সারাক্ষণ, সারাক্ষণ…।
প্রথম স্ত্রী পালিয়ে যাওয়ার পর ফারুক শাহ মা হারা দুধের শিশুকে বুকে নিয়ে কয় রাত ঘুমালেন। তারপর বুকের ধনকে তার দাদির হাতে তুলে দিয়ে পথে নামেন। পাগলের মতো ঘুরতে ঘুরতে কয়েক বছর পর গিয়ে উঠলেন ঢাকা মীরপুরের পীর মফিজ উদ্দীন আল চিশতিয়ার দরবারে। পীর বাবা তাঁর মাথায় হাত রাখতেই হুঁশ-জ্ঞান-স্মৃতি সব ফিরে আসে। ইচ্ছা ছিল সেখানেই বাকী জীবনটা কাটিয়ে দিবেন। বারো বছর পর বাবা চিশতীয়া হুকুম দিলেন, বিয়ে করো। পাত্রী হিসাবে দিলেন উনার এক ভক্তের কন্যাকে। তারপর বললেন, যাও…, নিজের মায়ের নাভীতে যাও।
সেই থেকেই আছেন দাসপাড়ায়। মুর্শীদ বাবা যাকে দিয়েছিলেন তিনিও আছেন সুখে-দুঃখে, সাধনায়। ছন্নছাড়া সাধককে তিনি দিয়েছেন শান্তি ও প্রেম। ভালোবাসার অমৃত রসে পুষ্ট হয়ে কোলে এসেছিল এক পুত্র। আজ সে সংসারের হাল ধরেছে।
ফারুক শাহ বিশ্বাস করেন, বংশ রক্ষার জন্য বিয়ে করতে হবে। সন্তান পাওয়ার পর স্ত্রী আর স্ত্রী থাকে না। সে হয়ে যায় বিশ্বজননী। তাঁর মাঝেই লুকিয়ে আছে সাধনার ক্ষেত্র। আর বির্য ক্ষয় না। এখন থেকেই মণি রক্ষা পরম ধর্ম। খামাখা স্ত্রী সহবাস কঠিন পাপ। এক ফোঁটা মণির মাঝে হাজারে হাজার প্রাণ। এই নর হত্যার দায় কে নেবে?
চারপাশের এই দুষণ, দুষ্টচক্রের দৌড়াত্ম আর মানুষের অমানবিক লোভ তাঁকে কষ্ট দেয়, লজ্জা দেয়। বাউল গানে যে আড়াল, আর্তনাদ আর নিগুঢ় তত্ত্বের ছাই চাপা আগুন দরকার তার সবটুকুই আছে ফারুক শাহর গানে। গানকে তিনি কালাম বলেন। তাঁর অধিকাংশ গানেই প্রেমতত্ত্ব, কামতত্ত্ব, সাধনতত্ত্ব ও গুরুতত্ত্ব একাকার।
আমি ঠেকছি বড়ো সংকটে গো,
পরছি বড়ো সংকটে,
আমাকে ধরছে প্রেমঅ কারেন্টে।
আমার পজেটিভ আর নেগেটিভে,
হতে চায় এক জয়েন্ট।
অগো, প্রেম কারেন্টের এমনি হয় ধারা,
আলগা থেকে এক পলকে, করে দেয় সারা,
কত অপারেটার পরছে ধরা,
ভুল করে এক পয়েন্টে,
আমাকে ধরছে প্রেম কারেন্টে,
আমি ঠেকছি বড়ো সংকটে।
আজকাল আছে লাইনে গো ভাবের ইঞ্জিনিয়ার,
টেকনিক্যাল আর মেকানিক্যাল যেসব ওয়ারর্কার।
প্রেক্টিক্যালে টেনেসমিটার পৌঁছাইছে রাস্তাঘাটে,
আমাকে ধরেছে প্রেম কারেন্টে,
আমি ঠেকছি বড়ো সংকটে, পড়ছি বড়ো সংকটে।
হবে কী চমৎকার মাটির এক বিল্ডিং,
ঘরের ভিতরে লাইটিং হয় ফিটিং
ভবে কী চমৎকার মাটির এক বিল্ডিং,
ঘরের ভিতরে লাইটিং হয় ফিটিং,
কাম নদীতে বিদ্যুৎ পাসিং।
লাইন জ্বলে যায় এক সটে,
আমাকে ধরেছে প্রেম কারেন্টে,
আমি ঠেকছি বড়ো সংকটে, আমি পড়ছি সংকটে,
আমাকে ধরেছে প্রেম কারেন্টে।
কাঙাল ফারুক বলে, আমার মাটির ঘর,
চব্বিশের বাতি নিভল গিয়া কামশহর।
ঠেকছি বড়ো সংকটে,
আমাকে ধরেছে প্রেম কারেন্টে।
মিলতে পারে বাতির খবর,
দয়াল মুর্শীদ মাওলার নিকটে,
আমি পড়ছি বড়ো সংকটে,
আমাকে ধরেছে প্রেম কারেন্টে।
রাত যখন ভোরের দিকে। আমরাও উঠব উঠব করছি তখন আবার ফারুক শাহকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, বাউল মানে কী?
ফারুক শাহ: বাউল মানে এঁরা দয়ালের নামে একনিষ্ঠা হয়ে, উদাসী জগতে, যন্ত্রের জগতে মিশে যায়। বাউলের কান্ট্রিতে জাতি-ধর্ম নাই। হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রীষ্টান সব এক ধর্মের পতাকাতলে। সেইটাই মানব ধর্ম। বাউলরা দোজখের ভয়ে কিংবা বেহেস্তের লোভে কাতর না। তাঁরা শুধু দয়ালকে চায়। স্রষ্টাকে পাওয়া হলে সব পাওয়া হবে।
শেখ লুৎফর: খবর নিয়ে দেখেছি, আপনাকে মিডিয়া চেনে না।
ফারুক শাহ: আমি মিডিয়ার জন্য সাধনা করি না। জানাজানি, কানাকানি মানে বিড়ম্বনা। মারফতের কান্ট্রিতে সেক্রেটারি হযরত আলী করমউল্লাহ। পিয়ারে রাসুলের কাছ থেকে তিনি বাতুনি জগতের খেলাফত পেয়েছিলেন।
শেখ লুৎফর: আপনার শিক্ষাগুরু ও দীক্ষাগুরু কে?
ফারুক শাহ: বাবাই ছিলেন আমার প্রথম শিক্ষাগুরু ও দীক্ষাগুরু। উনার নাম হযরত শাহাধন পীর। আমার বাবার পীর ছিলেন, হযরত রহমত শাহ চিশতিয়া। তিনি অই তরফ কান্ট্রিতে ওলি জগতের বিশিষ্ট একজন ছিলেন। আর বাবার একটুখানি দোয়া নিয়ে আমি দাঁড়িয়ে আছি। আমার শিক্ষাগুরু, মানে এই বাউল জগতে পথ দেখালেন যিনি, তিনি হলেন ঢাকা মীরপুরের মফিজউদ্দীন আল চিশতিয়া। উনার কাছ থেকে তত্ত্বজ্ঞান পাইছি। আর বয়েত হয়েছি টেংবাজার সর্দার শাহ ওলি দরবারের প্রধান খাদেম হাজী মোহাম্মদ শুকুর শাহ এর কাছে।
শেখ লুৎফর: উনি কী গান লিখতেন?
ফারুক শাহ: হ্যাঁ।
শেখ লুৎফার: গান ছাড়াও তো মুর্শীদকে পাওয়ার সাধনা করা যায়। তবে কেন বাউলরা গানকে এত গুরুত্ব দেন?
ফারুক শাহ: এই গান অন্তরের আহার যোগায়, সান্ত্বনা জোগায়, কলবকে জীন্দা রাখে। উদাসী ভাব যার অন্তরে একবার ঢুকে যায়, শিক্ষাগুরু-দীক্ষাগুরুর প্রেমশিক্ষা হৃদয়ে নিয়া এই বাউল জগতে যারা পড়ে গেছে, একনিষ্ঠ হয়ে গেছে, তাঁরা তো পথে পথেই, গানে গানেই দয়াল মুর্শীদকে তালাশ করে।
শেখ লুৎফর: গানের ভাব দিয়ে কী চান?
ফারুক শাহ: পাপি অঙ্গে আমাদের তো কোনো সম্বল নাই। কোটি কোটি বছর পার হয়ে যায় এক হুকুমে। ফেরেশতারা সেই এক হুকুমেই ডিউটি চালায়া যায়। আমরা তো আর সেই জায়গায় নাই। তাই গানের মাঝে তাঁরে সন্ধান করি। সাধন-ভজন করি।
শেখ লুৎফর: শরীয়ত তো গান মানে না।
ফারুক শাহ: একটা দামী কথা বলেছেন। সন্ধ্যা বেলায় আমরা যে সিঁড়ি বেয়ে পাহাড়ের উপরে এই বাড়িটাতে এসেছি। কী দিয়ে এলাম?
[আমি, জহির, রাজীব, বাম ঘরানার মামুন, কাজল, লম্বা চুলের বিদগ্ধ কায়েস (বন্ধুরা যাকে কবি ইমরুল কায়েস ডাকে), অপু, শুভসহ সবাই এক সাথে বলে উঠেছিলাম, সিঁড়ি দিয়ে।]
সিঁড়ি মানে ধাপ। এইটা হলো বাতুনি এলেমের অংশ। শরিয়ত বলতেছে মসজিদে আসো। দোজখ থেকে রাক্ষা পাবে। পুরস্কার হিসাবে আছে, বেহেস্ত, হুর-গেলমান। তো এলেমে মারফত বলতেছে, শুধু পাঁচবার না, চব্বিশ ঘন্টা তোমার কলবের মাঝে আল্লাহকে ধরে রাখো। বাউলরা তাই গানে গানে তাঁকে কলবে ধরে রাখে। সুরে সুরে মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে চায় মুর্শীদের বাণী। শ্বাসে-প্রশ্বাসে দয়ালরে নিয়া হৃদমাজারে খেলা করে। তাঁকে পেলেই সব পাওয়া হয়। রাবেয়া বসরি (রাঃ) ছিলেন দয়ালের প্রেমে পাগল। একদিন তিনি দুই হাতে দুইটা পোটলা নিয়ে বসরা শহরের রাস্তা দিয়ে ছুটছেন। একজন তাঁর পথ আগলে দাঁড়ায়, এই পাগলি, তোমার দুই হাতে কী? রাবেয়া বসরি বললেন, দোজখ-বেহেস্ত নিয়ে যাচ্ছি, বাগাড়ে ফেলে দেব। এইসব দিয়ে আমি কী করব? আমি চাই স্বয়ং আল্লাহকে। এই শুনে লোকজন বলাবলি করল, আইজ পাগলির মাথাটা ষোলআনা গেছে।
শেখ লুৎফর: গান বিষয়ে হাদিস-দলিল কী কয়?
ফারুক শাহ: এই কান্ট্রিতে খুঁজলে অনেক পাবেন। ইমাম গাজ্জালী (রঃ) তাঁর ‘কিমিয়ায়ে সাআদাত বা সৌভাগ্যের পরশমণি’ কিতাবের দ্বিতীয় খণ্ডে একটা অনুচ্ছেদে সংগীত বৈধ কি অবৈধ বিষয়ে স্পষ্ট কিছু কথা বলেছেন। তিনি বলেন, লোহা এবং পাথরের মাঝে যেমন আগুন আছে তেমনি মানুষের আত্মার মাঝে একটা গুপ্তধন আল্লাহ রেখেছেন। লোহা-পাথরে ঘষা লাগলে আগুন জ্বলে। মিষ্টি সুর শুনলে মানুষের হৃদয় আলোড়িত হয়। তিনি বলেছেন, ঈদের দিন কিংবা কোনো আনন্দের দিন গান বৈধ। তিনি মুর্শীদের শানে গানকে বলেছেন মধু আর কাম-উত্তেজক বা খারাপ গানকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। হযরত আয়েশা (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, কোনো এক ঈদোপলক্ষ্যে মসজিদে নববীতে হাবশীগণ খেল-তামশা করছিল। তখন রাসুলে পাক (সাঃ) আমাকে বললেন, তুমি খেল-তামশা দেখবে? আমি বললাম হ্যাঁ। তিনি দরজায় দাঁড়িয়ে হাত প্রসারিত করলেন আর আমি তাঁর বাহুতে থুতনি রেখে তামশা দেখছি। একটু পরে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আরও দেখবে? আমি বললাম, হ্যাঁ। এইভাবে তিনি আমার কাছে তিনবার হ্যাঁ উত্তর পাওয়ার পর আমাকে তিনি মসজিদে নববীতে নিয়ে গিয়ে হাবশীদেরকে বললেন, তোমরা উত্তম রূপে নৃত্য কর। কাজটা হারাম হলে তিনি কখনো হাবশীদেরকে এই নির্দেশ দিতেন না।
শেখ লুৎফর: জীবনে প্রথম কোন গান আপনাকে এই তলে তলের পথের খবর দেয়?
ফারুক শাহ: আমার বাবা যখন গান গাইতেন তখন দেখতাম দুই চোখের পানিতে উনার বুক ভেসে যাচ্ছে। এই দৃশ্য দেখে আমার অন্তরটা সেই শিশু বয়সে মোমের মতন গলে গেল।
শেখ লুৎফর: আপনার বাবার (হযরত শাহাধন পীর) লেখা কোন গানটা আপনার ধ্যানের জগতে, জ্ঞানের জগতে আজও আলোড়ন তুলে?
ফারুক শাহ:
কী সুখে রয়েছি গো বন্দে,
চান বিনে বিন্দাবনে।
অ আমার বিন্দাবনে বন হয়েছে,
কেবল বনমালী বিনে গো সখী,
অ আমার চান বিনে বিন্দা বনে…।
শেখ লুৎফর: দেহতত্ত্বের কথা বলবেন?
ফারুক শাহ: আমাদের দেহ পঁচিশটি চন্দ্রে গড়া। সাড়ে চব্বিশটি চন্দ্র আমাদের দেহের মাঝে। বাকি আধা চন্দ্র আছে মুর্শীদের কাছে। একনিষ্ঠ সাধনায় তিনি খুশি হয়ে যদি দেন তবেই হবে পঁচিশ চন্দ্র সাধন। আমরা প্রতিদিন ছয়শত চব্বিশ হাজার বার দম টানি, দম ছাড়ি। যারা করে দমের ডিউটি তাঁদের কলবে ছয় লতিফা জাগ্রত হয়।
শেখ লুৎফর: ছয় লতিফা কী কী?
ফারুক শাহ: ছের, খপী, কলব, রুহু, আখফা, নফছ। প্রতিটা লতিফার জন্য দুই ঘন্টা দমের ডিউটি করতে হবে। তাহলে কলবের ময়লা সাফ হয়ে যাবে। তখন মাটির ঘরের লাইটগুলা জ্বলে উঠবে। আর তার আগে যদি কামের ঘাটে গিয়ে এক্সিডেন্ট হয়ে যায় তবে চব্বিশের বাতি নিভে যাবে। আপনার চেহারার রুশনি হারিয়ে যাবে। যার ভিতরে চব্বিশের বাতি জ্বলতে থাকবে সে কালো হলেও, বুড়া হলেও, বেমারী হলেও চেহারায় নূরের একটা আলো থাকবে।
শেখ লুৎফর: গান অর্থাৎ মরমি গান বিষয়ে যদি আরও কিছু বলতেন।
ফারুক শাহ: বড়ো পীর আব্দুল কাদির জিলানির কাছ থেকে খাজা মাঈনউদ্দীন চিশতি (রঃ)-এর মাধ্যমে এই লাইন আসছে। চিশতিয়া তরিকাকে স্বীকৃতি দিছেন বড়ো পীর। চিশতিয়া তরিকার আগে ছিল কাদরিয়া তরিকা। তখনকার দিনে কোনো খবর দিতে হলে ঢোল পিটিয়ে সমাজকে জানানো হতো। খাজা মাঈনউদীন চিশতি (রঃ) সেই ঢোল পিটাতেন। একদিন ঢোল বাজাতে বাজাতে খাজা সাহেবের এশকে তজলী শুরু হয়ে গেল। তিনি ঢোল বাজিয়ে নবীর শানে গজল গাইতে শুরু করলেন। আকাশ-জমিন কাঁপতে শুরু করল। চার দিক থেকে গায়েবি বাজনা উঠে বাগদাদের দিকে আসতে শুরু করল। সেই শব্দে আকাশ ভেঙে জমিনের দিকে ছুটে আসতেছে দেখে বড়ো পীর সাহেব হাতের লাঠি দিয়ে মাটি চেপে ধরলেন আরেক হাত তুলে দিলেন আসমানের দিকে যাতে সামাল দেওয়া যায়। বড়ো পীর সাহেব খাজা সাহেবকে ডেকে বললেন, বন্ধ কর তোমার গজল, আমি অনুমতি দিচ্ছি, তোমার জন্য গান জায়েজ। এই তো তিনি হয়ে গেলেন চিশতিয়া তরিকার সেক্রেটারি। এই কান্ট্রিতে যিকিরে জলি, যিকিরে খপী, যিকিরে নফিই মূল কথা।
শেখ লুৎফর: যিকিরে জলি কী?
ফারুক শাহ: জালালি যিকির। এর মাধ্যমে মুর্শীদের সাথে সরাসরি কানেকশন হয়। এইটা কাদরিয়া তরিকার। এই জিকিরটা গরম। এই তজলি শান অনেকের বডি মানে না। উপরে উঠতে উঠতে এশকে ফানাফিল্লাহ, এশকে বাকাবিল্লাহ হয়ে দেহ যন্ত্র বেজে উঠে। তখন অনেকের প্রাণ চলে যায়। একটা গান আছে যেমন:
গাইতে কাদরিয়া গান,
বাগদাদে যায় কত যে প্রাণ,
জজবা হালে মরলেন দেওয়ান।
তো ভাই আপনি যে টিপে টিপে সব নিগূঢ় কথা নিয়ে নিলেন।
শেখ লুৎফর: আমাদের দেশে তো ইসলাম এসেছিল পীর-আউলিয়া-গাউছ-কুতুবদের মাধ্যমে। বর্তমানে তো আমারা প্রায় সাধকশূন্য উজার ভিটায় পড়ে গেছি। তাই আমি আপনার কাছ থেকে এই মূল্যবান আমানত নিলাম। যারা সাধক হতে চাইবে, তাঁরা যদি এই লেখা পড়ে অসীম অন্ধকারে একটু দিশা পায় তবেই আমার আপনার এবং আমাদের ঘিরে উন্মুখ হয়ে বসে থাকা এইসব গুণী তরুণদের কষ্ট সার্থক হবে। আমরা আজকের এই রাতটাকে অনন্ত রাতের দিকে ছেড়ে দেব, আমাদের সন্তানদের কাছে রেখে যাব। তারা যদি আমানতদার হয় তবে চব্বিশের বাতি আবার জ্বলে উঠবে এই অন্ধকার দেশের অলিগলিতে।
পুনরায়: প্রিয় ছোটো ভাই আব্দুলাহ আল মামুন এবং আনোয়ারুল কায়েসের সহায়তা না পেলে কোনোদিনই আমি বাউল ফারুক শাহর সঙ্গ পেতাম না। সেই রাতে আমাকে সঙ্গ দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে যারা সুখী করেছিল তাদের সবার জন্য একবুক প্রেম।
জন্ম ময়মনসিংহরে গফরগাঁওয়ে ১৯৬৬ সালে। বিএসসি সম্পন্ন করে শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত আছেন। র্বতমানে থাকনে সুনামগঞ্জে। প্রকাশতি গল্পের বই: ‘উল্টারথে’ [২০০৮], ‘ভাতবউ’ [২০১৩] ‘অসুখ ও টিকনের ঘরগিরস্তি’, [২০১৭]। উপন্যাস: ‘আত্মজীবনের দিবারাত্রী’ [২০১১], ‘রাজকুমারী’ [২০১৯]।