১.
‘জন্ম। জন্মের আগে ছিল অনন্ত অন্ধকার, মৃত্যুর পরও এক অসীম অন্ধকার। এই দুই অনন্ত অসীম অন্ধবিন্দুর মাঝে যে প্রদীপ জ্বলছে, সেই জীবন।’
এ কথা বলেই সে আবার ব্যস্ত হলো দড়িটা টেনে তুলতে। রু জানত দড়ির নিচে আছে একটা বালতি। রু বলল ‘প্রাণ’। উঁকি মারার সাহস সবার হয় না! তবু রু কিছুটা এগোলো। চুপ করে থাকল, সাহস সঞ্চয় করতে চাইছিল। রু বলতে চাইল, অকারণ মিথ্যে বলে কী হয়? পরমুহূর্তেই মনে পড়ল, মা বলতেন, মিথ্যে তখনই মানুষ বলে, যখন তার হারানোর ভয় থাকে। এ কেন মিথ্যে বলবে, হারানোর ভয় তো নেই এর! নাকি আছে? স্বগতোক্তির মতো বলে উঠল, এতো কষ্ট করে প্রাণের খোঁজ করো, সহজতায় বুঝি শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। এ জন্যই তুমি কবি। আর আমি কিছুই না।
রু বলতে চাইল, অকারণ মিথ্যে বলে কী হয়? পরমুহূর্তেই মনে পড়ল, মা বলতেন, মিথ্যে তখনই মানুষ বলে, যখন তার হারানোর ভয় থাকে। এ কেন মিথ্যে বলবে, হারানোর ভয় তো নেই এর! নাকি আছে? স্বগতোক্তির মতো বলে উঠল, এতো কষ্ট করে প্রাণের খোঁজ করো, সহজতায় বুঝি শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। এ জন্যই তুমি কবি। আর আমি কিছুই না।
সে কিছু বলল না। সে হাসল, হুইস্কি গলায় ঢেলে আবার দড়ি ওঠানোয় মন দিল।
রু ভাবছিল, কবেই সব শেষ। যে কটা বসন্ত কেটেছে, তা হয়তো বসন্ত না হয়ে বরফাচ্ছাদিত শীতও হতে পারে। আপাতত সব যোগসূত্র শেষ। তবে কি সত্যি কুয়োর ভেতর থেকে সে তুলে আনছে প্রাণ? পারবে?
পিছোতে লাগল …যতটা পিছোলে এই দৃশ্য থেকে সে নিখোঁজ হতে পারে। বাইরে তখন সন্ধ্যে নামছে। ঘোড়ার গাড়িটা কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে। টুং টাং শব্দ হচ্ছে, ঘাড় নেড়ে ঘাস খেতে গেলে যেটুকু হয়। মিলিয়ে যাবার আগে, রু একবার শূন্যে ক্রশ আঁকল। না কি ক্রুশ! মনে মনে বলল, নিজেকে বিচ্ছিন্ন করার আগে পর্যন্ত যতটা পথ, তা অনুভূতির, বিচ্ছিন্ন করলে সেটা ঘটনা! তবে কি কোথাও অনুভবেরই অংশ রেখে এলো?
২.
‘পাগলকে কোনো তত্ত্বের ধার ধারতে হয় না, যুক্তিরও। তাই সে যা করে তা করে বিদ্যুৎ ঝলকের মতোই। তাই পাগলরাই পৃথিবীতে পূজ্য। যারা অবুঝ, তারা ভুল যুক্তির কারণেই ভুলে জড়ায়। যেমন নেপোলিয়ন, যেমন সাদ্দাম হুসেন। আর বোকা যারা, তারাই এ দুনিয়ায় সব থেকে পপুলার। তুমি বেড়ালের কথা বললে, সে বলবে কুকুরের কথা। তুমি পরিযায়ী শ্রমিক নিয়ে বললে, সে বলবে অর্থনৈতিক অগ্রগতির কথা! এরাই সর্বাধিক জনপ্রিয়। যেমন সেই লোকটা, দেশের চরম সংকটের দিনে সে বিশ্বযোগদিবস পালন করবে। যেমন সেই লোকটা, মধ্যরাতে সে যখন ট্রিস্ট উইদ ডেস্টিনির কথা বলছে, দেশের মানুষ দাঙ্গায় ছিন্নভিন্ন! এই বোকাদের সুবিধে হলো তারা বাকিদের বোকাই ভাবে।’
রু-এর এই মেইলের উত্তরে সে জিজ্ঞেস করেছিল, তুমি কি আমায় পাগল ভাবো, একই সাথে বোকাও?
উত্তরে রু লিখেছিল, যেমনটা আমি লিন্ডা কিং, আর তুমি বুকাওস্কি!
তখনও দুপুর। রু তখন একটা ঘোড়ার গাড়ি চেপে এগিয়ে চলেছে পাহাড়ের কোল ঘেঁষা ফার্ম হাউসের দিকে। মনে পড়ছে, বাবা একদিন নিরুদ্দেশ হয়ে যান। যেমন বাবারা গিয়েই থাকেন। মা একটা আকাশ হতে গিয়ে আকাশ প্রদীপ। আর দুনিয়াটা একার। কেবল পাতা ঝরে পড়ে অবিরাম। তখন শীত শুরু হতে চলেছে সবে।
ভুলু এক স্ট্রিট ডগ। একদিন গলিতে একটা ছোটো টেম্পো ঢুকল, সে তখনও আরাম করেই ঘুমোচ্ছে। দিল তার দু পা-ই মাড়িয়ে। ব্যাস চিরজনমের মতো শেষ হয়ে গেল ভুলুর হাঁটাচলা। তা বলে সে যে হাল ছেড়েছিল তা নয়। পেছনটা ঘষটে ঘষটেই চলত। তো সেদিন যখন খুব বৃষ্টি। ভুলু ভিজে সপসপে। কাঁপছে খুব। শীতের বৃষ্টি। ওমা, লালি জিভ দিয়ে চাটছে ভুলুর গা। গায়ে গা ঘষছে। মা বলছিল, দেখ মায়ের জাত তো। লালি মনে হয় ভুলুকে ভালোবাসে!’
৩.
কেউ যখন কাউকে প্রবল ভালোবাসে, তখন পথ চলা সুন্দর। আদর, কামড়াকামড়ি, ঝগড়া, মারামারি সব সুন্দর। তখনই আপেল গাছগুলো ভরে থাকে থোকা থোকা আপেলে। যেমনটা বৈতালিকীর আগের আশ্রম প্রাঙ্গণ। মা প্রায়শই বলতেন, রু, সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে গেলে, প্রত্যাশা কমিয়ে আনতে হয়, বুঝলি। রু বুঝতে চাইত না। তারপর একদিন খুব বৃষ্টি, চারদিক ভেসে যাচ্ছে থৈ থৈ জলে, গাড়ি বারান্দায় কি করে যেন উঠতে পেরেছিল ভুলু। ভুলু এক স্ট্রিট ডগ। একদিন গলিতে একটা ছোটো টেম্পো ঢুকল, সে তখনও আরাম করেই ঘুমোচ্ছে। দিল তার দু পা-ই মাড়িয়ে। ব্যাস চিরজনমের মতো শেষ হয়ে গেল ভুলুর হাঁটাচলা। তা বলে সে যে হাল ছেড়েছিল তা নয়। পেছনটা ঘষটে ঘষটেই চলত। তো সেদিন যখন খুব বৃষ্টি। ভুলু ভিজে সপসপে। কাঁপছে খুব। শীতের বৃষ্টি। ওমা, লালি জিভ দিয়ে চাটছে ভুলুর গা। গায়ে গা ঘষছে। মা বলছিল, দেখ মায়ের জাত তো। লালি মনে হয় ভুলুকে ভালোবাসে!’
রু খানিক ব্যস্ত হয়ে ঘরের মধ্যে হাঁটল। ওকে বের হতে হবে। একবার, অন্তত একবার দেখা করে আসতেই হবে। এখন সকাল। ফিরোজা রঙের একটা আলো এসে পড়েছে পায়ের কাছে। চা বানিয়ে আবার এসে বসল রাইটিং টেবিলে। লিখল, এটা তো এক অসমাপ্ত পৃথিবী। মার্কেজ বলেছিল, ঈশ্বর কেন যে রবিবারগুলিতে বিশ্রাম নিয়েছিলেন কে জানে! না নিলে, এই দুনিয়ার নির্মাণ কার্যটা আরামসে সম্পন্ন করতে পারত। জানো, প্রেম মানে জানতাম অন্ধ চোখে রঙিন আলোর স্পর্শ। বধির কানে সেবাস্টিয়ান বাকের সংগীত। মানুষ ভাবে এক আর হয় এক! এই যে দুনিয়া জোড়া এত এত বাড়ি, ঘরদোর— দরজা সব খোলা। চাইলেই মানসপথে ঘুরে আসা যায় যে কোনো ঘরে। মানুষ কী বোকা! বসে থাকে একটা ঘর, একটা টেবিলের ধারে, একটাই চেয়ারে। এ-ও কিন্তু প্রেম! অক্ষরের গায়ে হাত রেখে, তাকে সাজাই, বসাই, ওলোট পালোট করি। আবার সাজাই, এভাবেই তুমিও তো জগত বানাও, আমিও। কিন্তু আমাদের মধ্যের অক্ষরগুলো কবেই ভ্যানিশ! অথচ দেখ, কত পরিশ্রমী আমিও, যে কোনো সুউচ্চ পর্বত আরোহণের মতো, উপন্যাস লিখতেও লাগে অধ্যাবসায়, খেয়াল রাখতে হবে শ্বাসের নিয়ন্ত্রণ, অক্সিজেন কতটা, দড়ি, কাঁটাওলা জুতো, খাবার…উপন্যাস বলো বা সম্পর্কও ঠিক তাই, অথচ…
রোদের তেজ বাড়ছে, রু রওয়ানা দেবে পাহাড়ের কোল ঘেঁষা সেই ফার্ম হাউসটার দিকে। যেখানে লোকটা কুয়ো থেকে তুলে আনছে জীবন, নাকি সম্পর্ক?
মানুষ কেন যে এত কঠিন করে জীবনকে ভাবে!
জন্ম-১৯৭০। বিজ্ঞানে স্নাতক, কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলাইয় স্নাততকোত্তর। ‘ঐহিক’ সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক। পেয়েছেন একাডেমি পুরস্কার-২০১৫, প্রকাশিত বই : তিতিরের নৌকো যাত্রা, হ্যালুসিনেটেড অক্ষরমালা ও নিঝুমপুরের না রূপকথা