জ্বলন্ত আগুনের একটা বিড়ি হাতের কাছে রেখে আরেকটা টানতে টানতে যখন পঁচা জলের ড্রেনটা পার হয় মজি তখন ডান হাতের লাঠিটা মাটিতে ঝপঝপ করে আওয়াজ করতে করতে এগিয়ে যায়। যায় সে নদীটার বয়সের কাছে, যারে বহুদিন আগলে রেখেছে ও। ওখানে বেঁচে থাকার নামকরণের জন্য যে বাতাস লাগে সেটা অন্তত উন্মুক্ত। সেখানে বিনিময় নাই পৃথিবীর পুঁজির। মজি জানে না তার ভালো নাম কী তবে তার মায়ের নাম মজির-মা এটা সে জানে। মজি আমার নাম জানে না কিন্তু আমি জানি তার নাম মজি পাগলি। ওর সাথে যখন আমার প্রথম দেখা তখন আমাদের মাঝে একটি দেড় হাত ড্রেন। এপাড় ওপাড় করে আমরা যখন দাঁড়িয়ে আছি যেন ড্রেনটা একটা আস্ত সমুদ্রের উচ্চতা আর জলোচ্ছ্বাসের কলহ হয়ে উঠছে ক্রমশ। নিঃসঙ্গতায় মজির বয়স তখন কতো হবে জানি না। হয়তো কয়েকশত চাঁদের নিগ্রহ কিংবা প্রতিবন্ধকতা অবলম্বন করে সে তখন ষাটের কাছাকাছি।
ওর সাথে যখন আমার প্রথম দেখা তখন আমাদের মাঝে একটি দেড় হাত ড্রেন। এপাড় ওপাড় করে আমরা যখন দাঁড়িয়ে আছি যেন ড্রেনটা একটা আস্ত সমুদ্রের উচ্চতা আর জলোচ্ছ্বাসের কলহ হয়ে উঠছে ক্রমশ।
মজি পাগলির পরনে ঠিক কয়টা কাপর থাকত গুণে শেষ করা যাবে না, আলখাল্লা টাইপের ঐ ড্রেস আমি প্রথম সম্ভবত দেখেছি হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার ছবিতে। তালি দিয়ে জুড়ে দেওয়া জীবনের বহুবিধ রঙের সুতায় মজির মোটা শরীরে যে বোঁটকা গন্ধ তারে এড়িয়ে পাড়ার ছেলেমেয়েগুলি আমরা দূরেই থাকতাম; এমনকি রাতে না ঘুমালে মা বলতেন,‘তারাতাড়ি ঘুমা, মজি আসলো’!
আমাদের দক্ষিণে অতিক্রম করে নদীটা যে পুব দিকে চলে গেছে তার একটা পাশে পাথরঘাটা। দিনের বেশিরভাগটাই শ্রমিকেরা জাহাজ থেকে পাথর নামিয়ে ট্রাকে তোলে, এক পাশে স্নানের ঘাট, মেয়েরা দিব্যি স্নান সেরে কাপড় বদলে নিচ্ছে। আর কোথাও কোনো কোনো শ্রমিক আড়চোখে দেখতে থাকে সাদা স্তনের মতো স্ফীত মহাবিশ্ব কিংবা আরও বেশি কিছু। ঠাম্মার হাত ধরে আমরাও মাঝে মাঝে গেছি ও ঘাটে। পাথর কুড়িয়ে ফেরার পথে ঠাম্মা বেশ গল্প জুড়ে দিত মজির সাথে। অব্যক্ত ভাষার মতো সে গল্পের চরিত্রেরা আমাদের জীবনে আর ফিরে আসে নাই। নদী থেকে ফেরার পথেই শুকিয়ে আসত বুড়ির পাটের আঁশের মতো পাতলা চুল আর সাদা থান। ওই পথেই লালইটের খাঁজ আর পাতার বেড়ায় তৈরি মজির ছোট্ট ঘর। এটাকে ঠিক ঘর বলা যায় না, একটা চৌকির চার পায়ের বাইরে কী আছে গল্পের প্রয়োজনে আমারও ঠিক আর জানা হয়নি কোনোদিন। মজির সরঞ্জাম বলতে গাঁজার কল্কি, মাথার গামছা, কোমরের শিকল, জলের ঢেলা আর কুড়িয়ে আনা পাথরের সম্ভার। জীবনে কোনো রত্নপাথর সে পেয়েছিল কি না আমার জানা নাই। পাথরের চেয়ে নির্জীব পদার্থ আর কী হতে পারে যা মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে! মজিকে খেতে দেখেছি সদাই দোকানের বাইরে। সে গেলে দোকানিরা রুটি কিংবা বিস্কিটের ভাগ তারে দিত। এই দেওয়ার কী হিসেব করা যেতে পারে বড়ো হয়ে আমি জানতে পারিনি। তবুও তখন আমি ড্রেনের একপাশে দাঁড়িয়ে যার অন্যপাশে সে। আমাদের ব্যবধানের সীমা আমরা অতিক্রম করতে পারছি না। আমার পায়ের আঙুলে একটা উল্টো জুতা বেরিয়ে এসেছে অবাধ্য শৈশবের মতো। ভয় পেতে গিয়ে আমি যেন বড়ো হয়ে গেলাম দাদাঠাকুরের মতো।
কতবছর সে এমন একা ঘরে নিঃসঙ্গ নদীটারে উঠান বানিয়ে বেঁচে আছে কেউ জানে না। তার প্রতিবেশীরা শুনেছি সব গভীর রাতে আসে, গাঁজার থলি কিংবা কল্কার টানে তখন ঝুমঝুমিয়ে শুরু হতো মজির মারফতি গানের আসর, বহুদূরের কার্গো নৌকায় তখন নির্ঘুম মাঝি ছুটে চলছে আরেক কোনো জীবনের গল্প করতে।
সন্ধ্যার পরপর সুনসান ঘাটের কাছে যখন আছড়ে পড়া জলের শব্দগুলো স্পষ্ট হতে থাকে তখন জানালার গ্রিল ধরে তাকালে দূরে মিটমিট করে জ্বলত মজির ঘরের ষাট পাওয়ারের আলো। কতবছর সে এমন একা ঘরে নিঃসঙ্গ নদীটারে উঠান বানিয়ে বেঁচে আছে কেউ জানে না। তার প্রতিবেশীরা শুনেছি সব গভীর রাতে আসে, গাঁজার থলি কিংবা কল্কার টানে তখন ঝুমঝুমিয়ে শুরু হতো মজির মারফতি গানের আসর, বহুদূরের কার্গো নৌকায় তখন নির্ঘুম মাঝি ছুটে চলছে আরেক কোনো জীবনের গল্প করতে।
শুনেছি তৃতীয় তালাকের পর মজি বেছে নেয় নদীর জীবন। ঢেউয়ের মতো যেকোনো পুরুষ তখন তার কাছে ভেসে আসা পানার মতো, তাণ্ডবের পর আবার ভাসায় ফসলিয়া জমির আইলের দিকে, প্রতিদিনই গড়াতে থাকা মেঘের শরীর একসময় সে শিকলে বাঁধে কিছু গন্ধ। মজি নদীরে আর ভেজাতে দেয় না তার শরীরের গন্ধ। ভাসে চারপাশে তারে চেটে খাওয়া পুরুষদের ফেলে আসা বীর্যের ঘ্রাণ। মজি কাপড়ের উপরে আরও কাপড় জরায়। জমতে থাকে তার বহুগামিতার স্তর।
বয়সী মজি পায়ে ঘুঙুর জড়ায়ে হাঁটতে শুরু করে বহুকাল, যেন সে আসছে নিজস্বতা নিয়ে একটা মহল্লার বাইরে। যেদিন গলিতে একা সে আর আমি মুখোমুখি তখন একটা কুত্তা এগিয়ে না এলে যেন সে আমার গলা টিপে ধরত সে ভয়ে রাতে জ্বরের ঘোরে দেখেছি জোড়া তালের মাথায় বাবুই পাখির বাসা।
অতঃপর একদিন মেঘনায় ভাসে মজি পাগলের দেহ!
কবি ও গদ্যকার। নরসিংদী জেলায় জন্ম আর বেড়ে উঠা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক আর স্নাতকোত্তর শেষে যোগদান করেন বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে। কবিতা লিখছেন দীর্ঘদিন। গদ্যের কাজ পরীক্ষা আর নিরীক্ষামূলক। সরল ভাষায় বয়ান করে চলেছেন জীবনের পর্ব যা নিজস্ব এবং বহুমূখী।