শুক্রবার, অক্টোবর ১৮

মনুষ্যসম্পর্ক, পরিব্রজ্যা ও রসাতল এইখানে মূর্ত ও বাঙ্ময় : আহমাদ মোস্তফা কামালের কথাসাহিত্য – শেষ পর্ব

0

পর্ব ৪


পাঁচ. এক যে আছে এক সব পেয়েছির দেশ!

আর কে নারায়ণ (১৯০৬-২০০১) ভারতে ইংরেজিভাষায় সাহিত্যচর্চার প্রথম পর্যায়ের অতি গুরুত্বপূর্ণ লেখক) তাঁর গল্পে-গল্পে এবং উপন্যাসে-উপন্যাসে গড়েছেন অসামান্য এক ‘সব পেয়েছির দেশ’কে। বলেছেন সেই কল্প-ভূভাগের গল্পকথা। তাঁর গড়া সেই ভূভাগের নাম মালগুড়ি। মালগুড়ি নিঝুম এক শহর। সেই শহরের পাশ ঘেঁষে বয়ে বয়ে গেছে সরযূ নামের নদী। সেই নদীর ধারে আছে মেম্পি বন। কতো যে ঘন সেই বন। সেই শহরে কতো ঘটনা ঘটে! সেইখানের কতো কিশোর তাদের মালগুড়িকে ভালোবাসতে বাসতে ক্রমে দিনে-দিনে বড়ো হয়ে ওঠে। মালগুড়ির রেলস্টেশনে নিশুতি গহন রাতের অন্ধকারে অথবা হলুদ আলোর ভোরে ভোরে ট্রেন এসে থামে। যাত্রী নামে, যাত্রী ওঠে। তারপর ধোঁয়া ছেড়ে-ছেড়ে সেই ট্রেন চলে যায় দূরের অন্য স্টেশনের দিকে। মালগুড়ি আবার হয়ে ওঠে শান্ত, চুপচাপ। আমরা আর কে নারায়ণের গল্প পড়ে যেতে-যেতে বসত করতে শুরু করি সেই মালগুড়িতে। গল্প শেষ হয়; কিন্তু আমরা আর আমাদের নিজের নিজের সত্য-শহরে ফিরে আসার পথ খুঁজে পাই না। মালগুড়ি আমাদের, চিরজনমের মতো তার কাছেই রেখে দেয়।

আমরা লক্ষ করি, আমাদের জাদুকর আহমাদ মোস্তফা কামালও তাঁর আখ্যানে-আখ্যানে গড়েছেন অমনই এক ‘সব পেয়েছির দেশ’-কে। একান্তই তাঁর নিজস্ব সেই ভূভাগের নাম উদাসপুর। সে এক গ্রাম, কামালের বেভুলা একলা নায়কদের অভয়াশ্রম বা আরোগ্যসদন ওটি। আর, আমাদের পাঠকসকলের জন্যও সেই গ্রাম ক্রমে হয়ে ওঠে এক সুখদায়িনী তল্লাট। আমাদের তাকে ক্রমে আস্তে-সুস্থে ভালো লাগতে থাকে। আমরা সেই গ্রামকে দিয়ে মুগ্ধ হতে থাকি। মুগ্ধ হতে থাকি। সে হয়ে ওঠে আমাদেরও আপন বাসভূম; যেখানে কোনো-না-কোনোভাবে, কোনো-না-কোনো দিন আমরা আমাদের কিশোরবেলাকে ফেলে এসেছি।

কেমন সেই উদাসপুর?

‘উদাসপুর গ্রাম পদ্মা আর ইছামতি নদী’র পাড়ে। সেখানে ‘শীতের সকাল ও সন্ধ্যা’ আসে হিম ছড়াতে ছড়াতে। ‘গরমে পা পুড়ে যাওয়ার মতো বালুময় পদ্মার পাড়’ অসহ্য সুখ দিতে থাকে। ‘বর্ষায় উঁচু পাড় থেকে পদ্মায় ঝাঁপিয়ে পড়া, কি নতুন আসা পানিতে ডুবে যাওয়া মাঠে ‘গাড়া বড়শি’ দিয়ে মাছ ধরতে থাকার’ দিন নিয়ে সেখানে কিশোরবেলাটা ঝলকানি দিয়ে যেতে থাকে। তবে সকলজনের কাছেই যে এই উদাসপুর একই রূপে দেখা দেয়, তা নয়। আগন্তুক-এ অঞ্জনের কাছে তার একান্ত উদাসপুর-আবির্ভূত হয় এমন রূপে:

‘বাড়ির দক্ষিণ দিকে ৫/৬ মাইল দূরে পদ্মা। ভীষণ রাগী নদী। বর্ষার আগে আগে তার রাগ বেড়ে যায়। প্রতি বছর এই সময় সে তার সীমানায় তাকা ভিটেবাড়িঘর আর ফসলি জমি ভেঙে নিজের বিস্তার ঘটায়। জোয়ার আসে। স্বচ্ছ পানি ঘোলা হয়। স্রোত ক্রমশ প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে ওঠে, …পানি বাড়ে। দুকূল ছাপিয়ে মাঠঘাট ভেসে যায়। … শীতের সময় উদাসপুরকে ঢেকে ফেলে স্বর্গ থেকে নেমে আসা স্বপ্নের মতো কুয়াশা। আর জ্যোৎস্নারাতে মানুষগুলো যেন জ্যোৎস্নার তৈরি পুতুল হয়ে যায়। তাদের গা থেকে জ্যোৎস্না গড়িয়ে পড়ে, ভিজিয়ে দেয় রুক্ষ মাটি। সকালে কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে উদাসপুর ঘুমায়। মাটির চুলায় খেজুরের রস জ্বাল হয়। …গ্রীষ্মের বাতাসে নানা ধরনের মৌসুমি ফলের গন্ধ যেমন জানিয়ে দেয় ‘আমি এসেছি’, এমন করে শুধু গন্ধ দিয়ে নিজের অস্তিত্বের জানান দেয়া ঋতু পৃথিবীর আর কোথায় আছে? উদাসপুরের সবকিছুই এমন—তুলনাবিহীন, ইউনিক, অঞ্জন এতো জায়গায় গিয়েছে, কোনোকিছুই উদাসপুরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারেনি।’ (পৃষ্ঠা ২৪-২৫)

সেই উদাসপুরে রাতের অন্ধকারে কামিনী ফুল ফোটে। আর সাদা মিহি গন্ধের ঝটকায় ঝটকায় চরাচর আউলা-বাউলা হয়ে যেতে থাকে। সেখানে ‘সন্ধ্যা হতে না হতেই বিরাট এক চাঁদ’ ওঠে আকাশে। তারপর শুরু হয় ‘চাঁদ আর নদীর এক অপরূপ খেলা। নদীর ঢেউয়ে চাঁদের আলো পড়ে ভেঙে ভেঙে’ যেতে থাকে। ‘আর চিকচিক করে’ উঠতে থাকে যেন ‘হাজার হাজার হীরকখণ্ড।’ (অন্ধ জাদুকর, পৃষ্ঠা ৭২)

সেখানে বর্ষাও আসে। অন্ধ জাদুকর-এ কায়সারের উদাসপুরে বৃষ্টি নামে, আর কায়সারকে আকুল-বেআকুল করে নিতে থাকে এমতে: ‘তুমুল, অহংকারী, একরোখা জেদী বৃষ্টি। …বাঁশঝাড়ের শোঁ শোঁ শব্দ, অগ্রহায়ণ মাসে রাতের বেলা টিনের চালে টুপটাপ শিশির পড়ার শব্দ, বর্ষায় নিঝুম বৃষ্টির শব্দ, পদ্মার রহস্যময় গর্জন।

সেখানে বর্ষাও আসে। অন্ধ জাদুকর-এ কায়সারের উদাসপুরে বৃষ্টি নামে, আর কায়সারকে আকুল-বেআকুল করে নিতে থাকে এমতে: ‘তুমুল, অহংকারী, একরোখা জেদী বৃষ্টি। …বাঁশঝাড়ের শোঁ শোঁ শব্দ, অগ্রহায়ণ মাসে রাতের বেলা টিনের চালে টুপটাপ শিশির পড়ার শব্দ, বর্ষায় নিঝুম বৃষ্টির শব্দ, পদ্মার রহস্যময় গর্জন। সেইসব শব্দ বড়ো আবেশ জড়ানো ছিলো। প্রহরজাগা পাখির ডাক, প্যাঁচার ডাক, কুক পাখির ডাক, শেয়ালের ডাক আর কখনো কখনো কুকুরের কান্না রাতগুলোকে আরো রহস্যময় করে তুলতো।’ (পৃষ্ঠা ১৫২) আমরা বুঝে উঠতে থাকি ক্রমে, এমত বৃষ্টি সেখানে শুধু কায়সারের জন্যই নামে না, আমাদের পাঠকজনের জন্যও নামে। নামে, আর চিরদিন ধরে ওই বৃষ্টি ঝরতে থাকে, ঝরে যেতে থাকে উদাসপুরের নিরালা সকল উঠানে-উঠানে। আমাদের প্রাণের গহনে-গহনে।

তারপর সেই উদাসপুরে একদিন চৈত্রমাসও আসে। গাছের ডালে ডালে তখন নবীন পত্রপল্লব, খর রোদে রোদে তারা ডগমগ করতে থাকে। চৈত্রমাসের নতুন পাতার চিক্কনতা দেখে ওঠে কায়সারের চোখ। দেখে ওঠে আনন্দকে। তার চোখ ও মন কাশফুল হয়ে দুলে উঠতে থাকে। দুলে যেতে থাকে। ‘…জ্যোৎস্নারাত যে কতটা মোহনীয় হতে পারে, জ্যোৎস্নার রঙ যে কেমন মাখনের মত হতে পারে, সেটা দেখেছি। …পাতার রঙ কতটা সবুজ, খেজুর-রসের স্বাদ কতটা মধুর, ঘুঘুর ডাক কতটা মায়াময়—সেইসব অভিজ্ঞতা আমাকে উপহার দিয়েছিলো উদাসপুর—আমার গ্রাম, আমার জন্মভূমি, আমার বাড়ি। যেন সমস্ত জগৎজুড়ে এক অনির্বচনীয় জাদু ছড়ানো ছিলো।’ (পৃষ্ঠা ১৫২)

 

২.
এই উদাসপুরের ঋতুবদলের সাথে পরিচিত হতে-হতে তার নদীধারার সাথে ভেসে যেতে-যেতে, তার ফসলের জ্যাতা-তাজা গন্ধের সাথে লেপটে যেতে-যেতে, আমরা পাঠকেরা বুঝে উঠতে থাকি যে, এই উদাসপুর, এই যে গ্রাম, এটি আর শেষ পর্যন্ত একা এক কল্পগ্রাম মাত্র হয়ে নেই। আমাদের মাতৃভ‚মিই এইখানে এই উদাসপুর নাম নিয়ে হাজির হয়েছে। আমাদের চোখ ভিজে আসতে থাকে তখন নিরালা সুখে।

 

ছয়. যাদুকর এই তো তুলে আনছেন তাঁর বাম বাহু! ওই তো দৃশ্যমান হয়ে উঠছে কু-রাজনীতিসৃষ্ট নরক-বাস্তবতা!

এবার আমরা দেখতে পারি, কারুকার আহমাদ মোস্তফা কামাল তাঁর বাম হাতটিকে দুলিয়ে যে যাদুজগতটি সৃজন করেছেন, সেইখানে কী আছে। সেই জগতের সাথে বিস্তারিত পরিচয় সম্পন্ন করে ওঠার জন্য আমরা তাঁর উপন্যাস-তিনটির শরণ যেমন নিতে পারি, তেমনি ঢুকে যেতে পারি তাঁর ক. ঘরভর্তি মানুষ অথবা নৈঃশব্দ্য, খ. অশ্রু ও রক্তপাতের গল্প, গ. বড়োদের গল্প যেমন হয়—এই গল্পগ্রন্থগুলোর পৃথিবীতে। আমরা লক্ষ করি, এই তিনটি গল্পগ্রন্থই ক্রমে বলে চলেছে অভিন্ন এক ভ‚ভাগেরই গল্প। বিধৃত করে চলেন সেই একই ভূখণ্ডরেই পীড়নবিদ্ধ নিরুপায় মনুষ্যসকলের অসহায় জীবনের ওঠাপড়ার চিত্র। গল্পে-গল্পে শুধু তিনি কাহিনীই বুনে দেন না, বুনে দিতে থাকেন তার তপ্ত দীর্ঘশ্বাস ও শীতল ক্রোধকেও।

আহমাদ মোস্তফা কামালের উপন্যাসবিশ্বে জীবন কেবল সঘন বৃষ্টিমোড়ানো হয়ে-হয়ে আর বন্ধুতার উষ্ণতায় আবৃত থেকে-থেকেই শেষ হয় না, তিনি দেখাতে থাকেন ব্যক্তির জীবনকে কীভাবে এবং কতোভাবে, কতোখানি নিয়ন্ত্রণ করে চলে রাজনীতি। তিনি দেখান, পামর-রাজনীতি-নিষ্পেষিত এই ভূখণ্ডে সামান্য-সাধারণ মানুষ কতোটা এবং কেমন এক ত্রাসকণ্টকিত জীবন যাপন করে যেতে বাধ্য হয়। এখানে শাসক প্রায় কখনোই জনবান্ধব কেউ নয়। সে লোভমত্ত। সে আসে আত্মস্বার্থ হাসিল করার মতলব নিয়ে। নৃশংস অত্যাচারী ক্ষমতালোভী এই শাসক সম্প্রদায়। সে তার সাথে নিয়ে আসে দুষ্ট দুর্বৃত্ত সহযোগীদের। এই দঙ্গলটা সাধারণ মানুষের জীবনকে দুর্গতি দিয়ে হেনস্থা দিয়ে ছন্নভন্ন করে দিতে থাকে।

আমাদের কথাকার ওই দুর্গতি-দুস্থ সামাজিক-রাজনীতিক বাস্তবতার পরিচয় বিশদরকমেই উপস্থাপন করে চলেন। উপন্যাসে-উপন্যাসে সেটা হয়তো আংশিক চিত্রিত হয়; কিন্তু তাঁর গল্পেরা তুলে ধরতে থাকে, আদ্যোপান্ত তুলে ধরতে থাকে কদর্য রাজনীতিশাসিত এক ভূভাগের সর্ব নিরুপায়তার তন্নতন্ন বিবরণ।

ওই যে মধুরা প্রাণদায়িনী উদাসপুর; কামাল দেখান, তাকেও একসময় নষ্ট-ভ্রষ্টরা দখল করে নেয়। দেখান, কীভাবে পেশিবলওয়ালা সন্ত্রাসীরা পরাভূত করে শুভ ও কল্যাণশক্তিকে। সেখানে দরিদ্র-দুর্গতরা পরিত্রাণহীন লাঞ্ছনা পেতে থাকে। অভাবের দুর্গতি মলিন করে দিতে থাকে সামান্যজনের জীবন। শুধু নির্লজ্জ দাপট নিয়ে চরে বেড়াতে থাকে দুর্বৃত্ত ক্ষমতামত্ত রাজনীতিকগণ। তাদের লোভ-দম্ভ-ক্ষমতার কামড়াকামড়ি উদাসপুরকে দূষিত করে তোলে। অঞ্জনের আর যাওয়ার জায়গা থাকে না। ‘অঞ্জন রিক্ত, বিপন্ন, পীড়িত বোধ করতে থাকে।’ (পৃষ্ঠা ৯৬)

শুধু যে উদাসপুরই দুর্বৃত্ত তস্করের পদানত হয়ে যায়, তা নয়। যেই নগরে অঞ্জন বা কায়সার উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য আসে, সেই নগরীকেও দখল করে নেয় নষ্টদুষ্ট হিংস্র ক্ষমতালোভী শাসক। অঞ্জন বা কায়সার তাদের কিশোরবেলা পার করতে করতে মূলত পেরোতে থাকে বৈরী এক সময়কে। মুখোমুখি হতে থাকে বিবিধ রাষ্ট্রীয় বিড়ম্বনার।

দেশে সামরিক শাসন চালু হয়। শঙ্কা-ত্রাস-ভয়-সর্বজনে অবিশ্বাস ও আতঙ্ক এইখানে লোকের জীবনকে আষ্টেপৃষ্টে পেঁচিয়ে ধরে। দম বন্ধ হয়ে আসতে থাকে প্রতি মুহূর্তে। ভয়গ্রস্ত থাকতে থাকতে এই নব তরুণগোত্রটির অন্তর-বাহির হয়ে উঠতে থাকে বিকলাঙ্গ। নিরাশ্রয় বোধ করতে থাকে তারা। বাধ্য হয় নিরালম্ব জীবনকে মেনে নিতে।

এমত বিপন্নতা, এমত নিরুদ্ধার দণ্ডভোগের কাল চলতেই থাকে চলতেই থাকে। অঞ্জন বা কায়সারের এই যে বিপন্নতা, এই যে তাদের রাষ্ট্রপ্রদত্ত দুর্গতি সহ্য করে চলা, তাদের এই যে নিরুপায়তা, এই সবই আমাদের মনে করিয়ে দেয় পৌরাণিক বীর স্যামসন বা শিমশোনের দণ্ড-পীড়িত-ভয়গ্রস্ত থাকার দিনগুলোর কথা। শিমশোন বা স্যামসন পৌরাণিক বীর। তার আছে বাহুবল, আছে শক্তি ও অগাধ সাহস। কিন্তু তাকে এবং তার গোত্রকেও শৃঙ্খলিত করে রাখে পাষণ্ড শাসকগোষ্ঠী।

অন্যদিকে, আমাদের কালের এই যে নায়কেরা, কখনো তাদের কোনোজনের নাম অঞ্জন, কখনো-বা কায়সার বা ঋভু, তাদের বাহুবল কিছুমাত্র নেই। তারা আধুনিক কালের সন্তান। সভ্যতার আবড়া-জাবড়া বিধিরীতির ঘোরপ্যাঁচ, রাজনীতির কূটচাল, জীবনধারণের অন্তহীন লড়াই, তাদের খর্বকায়, ক্ষীণআয়ু-ধুকধুক, অশক্ত এক সামান্য মানব হতে বাধ্য করেছে। কিন্তু যতো অশক্ত ভঙ্গুরই সে এখন হয়ে উঠুক না কেন, শাসকের নির্দয়তার চাবুকের আঘাত সে পায় অবিকল সেই আদিযুগে, ঝিটকে-ঝিটকে নেমে আসা চাবুকের আঘাতের সমানই। সেই দূরকালে শিমশোন যেভাবে থেতলে যেতো, অঞ্জন বা কায়সারও একদম তেমন রকমেই থেঁতলে যেতে থাকে।

শিমশোন জন্ম নেয় এমন এক ভূভাগে, যেখানে তার গোত্রের সকলে প্রজন্ম পরম্পরায় বাস করে চলে বটে, কিন্তু সে ভূখণ্ড তাদের আপন ভূমি নয়। তারা সেখানে দাস, হুকুম-বরদার, পদানত, আর সদা উৎকণ্ঠ। তাদের জীবন ‘পলেষ্টীয়’ শাসকের ‘হস্তে’ বন্দি। সেই শাসকেরা ক্রূর নির্দয়। দাসদের পদানত রাখার জন্য যতো অত্যাচার চালানো সম্ভব, তারা চালায়। পীড়ন-নিষ্পেষণের শঙ্কায় শিমশোনের গোত্রের সকলে মুখ বুজে থাকে, শাসকের বিধিবিধানমাফিক সকল কর্ম সম্পন্ন করে চলে। থাকে আশাহীন, থাকে ধুঁকন্ত, থাকে চির মূক ও বধির দশায়।

শিমশোন ওই ‘পলেষ্টীয়’ শাসকদের বিরুদ্ধাচারণ করলে তারা ‘আসিয়া’ শিমশোনের ‘স্ত্রীকে ও তাহার পিতাকে আগুনে পোড়াইয়া’ মারে। (পুরাতন নিয়ম, পৃষ্ঠা ৩৯৮) তারপর সহস্র সেনা নিয়ে ‘পলেষ্টীয় ভূপালগণ’ যায় শিমশোনকে বন্দি করতে। তবে তারা অভিযান শুরু করার আগেই শিমশোনের স্বগোত্রের সকলে ঝাঁপিয়ে পড়ে শিমশোনকে বন্দি করার জন্য। কারণ ওই এক মাথাগরম দ্রোহীর জন্য তারা নিজেদের জীবনের শান্তি খোয়াতে চায় না। যেভাবেই হোক ওই দাসজীবনে বেঁচে থাকাই তাদের কাছে অতি উপাদেয় মনে হতে থাকে। আদিপুরাণ ওই ভয়াল, আশাশূন্য দশাটির এমন বিবরণ রচনা করে: ‘আর পলেষ্টেীয়রা উঠিয়া গিয়া যিহূদা দেশে শিবির স্থাপন করিয়া লিহীতে ব্যাপিয়া রহিল। তাহাতে যিহূদার লোকেরা জিজ্ঞাসা করিল, তোমরা আমাদের বিরুদ্ধে কেন আসিলে? তাহারা কহিল, শিমশোনকে বাঁধিতে আসিয়াছি; …তখন যিহূদার তিন সহস্র লোক ঐটম শৈলের ফাটালে নামিয়া গিয়া শিমশোনকে কহিল, পলেষ্টীয়রা যে আমাদের কর্ত্তা, তাহা তুমি কি জান না? তবে আমাদের প্রতি তুমি এ কি করিলে? … তাহারা তাহাকে কহিল, আমরা পলেষ্টীয়দের হস্তে সমর্পণ করিবার জন্য তোমাকে বাঁধিতে আসিয়াছি। …তাহার কহিল, … তোমাকে দৃঢ়রূপে বাঁধিয়া তাহাদের হস্তে সমর্পণ করিব। …পরে তাহারা দুই গাছা নূতন রজ্জু দ্বারা তাহাকে বাঁধিয়া ঐ শৈল হইতে তাহাকে লইয়া গেল। তিনি লিহীতে উপস্থিত হইলে পলেষ্টীয়রা তাঁহার কাছে গিয়া জয়ধ্বনি করিল।’ (পৃষ্ঠা-ওই)

ক্রমে বিস্তর পীড়ন-নির্যাতন শেষে ‘পলেষ্টীয়রা তাঁহাকে ধরিয়া তাঁহার দুই চক্ষু উৎপাটন করিল; এবং তাঁহাকে ঘসাতে আনিয়া পিত্তলের দুই শৃঙ্খলে বদ্ধ করিল; তিনি কারাগারে যাঁতা পেষণ করিতে থাকিলেন।’ (পৃষ্ঠা ৪০২)।

 

৩.
অমনই এক ত্রাসকণ্টকিত, রূঢ়-নির্দয় শাসকশাসিত দেশে নিজেকে আচমকাই দেখে ওঠে আহমাদ মোস্তফা কামালের নায়কেরা। তাদের শৈশব ও কিশোরবেলাটা থাকে তরুপল্লবছায়ামোড়ানো। তাদের ওই সময়টুকু থাকে গ্রামের অবাধ উঠানে, নদীর জলকল্লোলমাখানো সূর্যাস্তের কাছে। তখন ফসলি জমিকে শান্তি-সুখ-সুন্দর লাগতে থাকে; রাত্রির কালোকে মায়াময় মনোহর লাগতে থাকে, অভাবী মানুষের মুখেও শান্তি ও প্রসন্নতার মায়া দুলতে দেখতে পেতে থাকে চোখ। তবে ওই নিষ্পাপতার দিনগুলো দীর্ঘস্থায়ী হয় না। অচিরেই এসে যায় জ্ঞানপ্রাপ্ত হওয়ার কাল। কলেজে পড়তে যাবার সময় আসে। তখন এই নায়ককে যেতে হয় রাজধানীতে। অঞ্জন যায়, কায়সারও যায়; আর ঋভু ওরফে পারভেজ মাহমুদ তো জন্ম থেকেই দাঁড়িয়ে আছে নগরবাস্তবতায়।

অঞ্জন এবং কায়সার বুঝে উঠতে পারে, তার দেশ অথবা রাষ্ট্রসংঘটি আদতে তার মতো সাধারণ মনুষ্যের জন্য নেই আর। সেটি দখল করে নিয়েছে কুচক্রী হিংস্র রাক্ষসেরা। আমজনতা এইখানে আছে দাসের জীবনে। নতনেত্র আর স্তব্ধ-মূক থাকতে পারলেই এইখানে প্রাণে বেঁচে থাকা সম্ভব। নয়তো নয়। আগন্তুক-এ অঞ্জন সেটা এইমতে টের পায়: ‘স্কুল পাশ করে আমি এসে ভর্তি হলাম শহরের নামজাদা কলেজে। …দেশজুড়ে তখন তাণ্ডব চলছে।

সেইখানে পা রেখেই অঞ্জন এবং কায়সার বুঝে উঠতে পারে, তার দেশ অথবা রাষ্ট্রসংঘটি আদতে তার মতো সাধারণ মনুষ্যের জন্য নেই আর। সেটি দখল করে নিয়েছে কুচক্রী হিংস্র রাক্ষসেরা। আমজনতা এইখানে আছে দাসের জীবনে। নতনেত্র আর স্তব্ধ-মূক থাকতে পারলেই এইখানে প্রাণে বেঁচে থাকা সম্ভব। নয়তো নয়। আগন্তুক-এ অঞ্জন সেটা এইমতে টের পায়: ‘স্কুল পাশ করে আমি এসে ভর্তি হলাম শহরের নামজাদা কলেজে। …দেশজুড়ে তখন তাণ্ডব চলছে। খুব যে সচেতন ছিলাম এসব বিষয়ে তা নয়, কিন্তু আব্বার গড়ে দেয়া নানারকম কনসেপশন আমাকে আগ্রহী করে তুলেছিলো বিষয়গুলো বোঝার জন্য। কেন এতো হরতাল অবরোধ হচ্ছে দেশে? একটি জবরদখলকারী সরকারকে হটানোর জন্য যারা আন্দোলন করছে তারাও যে খুব ভালো মানুষ তা তো নয়, বরং এরাও ক্ষমতায় থাকার সময় মুক্তিযুদ্ধের ওই ‘আমাদের’ কনসেপ্টটিকে ধ্বংস করেছিলো। নতুন করে তারা ক্ষমতায় এলে এমন কী উপকার হবে এই দেশের?’ (পৃষ্ঠা ৩৮)

তবে নিজ রাষ্ট্রসংঘের বেহাত হতে যেতে থাকা নিয়ে খুব বেশি ভাবিত থাকার ফুরসত মেলে না অঞ্জনের; তাকে বিদেশে পড়তে পাঠিয়ে দেয়া হয়। স্বভূমিতে উন্মূল হয়ে থাকার পরিস্থিতি জোটে না তার, তাকে পরবাসে গিয়েই উন্মূলতার অন্য আরেক বোধে বিদীর্ণ হতে থাকতে হয়।

অঞ্জনের মতো অতো মসৃণ নয় কায়সারের জীবন। তাকে পাঁকেচক্রে থেকে যেতে হয় তার দেশ নামক তল্লাটে, যেটিকে কায়সারের কিশোরবেলা থেকেই দখল করে নিয়েছে এক রাক্ষস। কায়সারের স্বগত ভাবনা আমাদের জানায়: ‘এখনো মনে পড়ে, কৈশোরের কোনো এক সুন্দর সকালে ঘুম ভেঙেই শুনেছিলাম, এই দুর্ভাগ্যপীড়িত জাতিটিকে উদ্ধার করার মহান উদ্দেশ্য নিয়ে এক মহামানব নাজেল হয়েছেন। নাজেল হয়েই তিনি আদেশ জারি করেছেন, ‘তাঁর’ এবং তার সাঙ্গপাঙ্গদের কাজকর্মের কোনো সমালোচনা করা যাবে না, করলে এই শাস্তি ওই শাস্তি ইত্যাদি। শুধু তাই নয়, একসঙ্গে পাঁচজনের বেশি জমায়েতও করা যাবে না, করলে দেখামাত্র গুলি করা হবে! সামরিক শাসনের নামে এমনই এক বীভৎস, ভয়ঙ্কর পৈশাচিক শাসন চেপে বসেছিল সারা জাতির বুকের ওপর।’ (অন্ধ জাদুকর, পৃষ্ঠা ১০৬)

দম আটকে যেতে থাকা সেইসব দিনে সেই কিশোরেরা প্রাণে বেঁচে থাকে বটে; তবে বেঁচে থাকে কুঁকড়ি-মুকড়ি দশায়, আন্তর-অর্থবতাগ্রস্ত হয়ে। কায়সার মনে করতে পারে: ‘ওই পবিত্র বয়সেই আমরা দেখেছিলাম, সমাজের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়ছে অবিশ্বাস-দ্বন্দ্ব-সন্দেহ। কেউ কারো ওপরে আস্থা রাখতে পারছে না, কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না, দেয়ালেরও কান আছে ভেবে কথা বলছে ফিসফিসিয়ে। … আমাদের সময়টি ছিলো এমন যে, …দুজন ফিসফিস করার মানে হচ্ছে তাদের মধ্যে তৃতীয় কেউ শুনে ফেলার ভয় বা শঙ্কা কাজ করছে। তা, তৃতীয় কেউ শুনে ফেললে সমস্যা কোথায়? সমস্যা হলো, তাকে যে বিশ্বাস করা যাচ্ছে না, যদি সে বলে দেয় কাউকে, যদি নেমে আসে পাশবিক সামরিক নিপীড়ন! (ওই, পৃষ্ঠা ১০৬)

এর পাশে চলতে থাকে সহজে লাভবান হয়ে ওঠার প্রবল হুড়াহুড়ি। কায়সার দেখে, ‘প্রাচীন রাজনীতিবিদরা’ ক্ষমতার চমচমির লোভে ‘লুটিয়ে’ পড়ছে ‘সামরিক প্রভুর কদর্য পায়ে’; আর তরুণ ছাত্রনেতা যারা, সামরিক প্রভুরা ওই তরুণদের ‘চারপাশে’ ছড়িয়ে দিচ্ছে ‘টাকা আর ক্ষমতা’; ‘আর লোভে পড়ে আজকের বিপ্লবী কালকেই হয়ে যাচ্ছে প্রভুর চামচা।’ সেই সময়ে সমাজে, ‘টাকা এবং টাকাই হয়ে উঠছে সবকিছুর একমাত্র নিয়ামক শক্তি; কোনো নীতিবোধ বা মূল্যবোধ আর চালকের আসনে থাকছে না।’ (পৃষ্ঠা-ওই) তেমন এক ‘অসৎ, আদর্শহীন’ সমাজ-রাষ্ট্রে কায়সার এবং অন্যরা বেড়ে ওঠে। বেড়ে উঠতে থাকে তারা ‘লক্ষ্যহীন-আদর্শহীন-নীতিহীন-স্বপ্নবিহীন সময়ে’; সেই সমাজের কোনোদিকে ‘কোথাও এমন কিছু’ থাকে না, ‘যাকে অবলম্বন করে একজন তরুণ জীবনকে অর্থপূর্ণ করে তোলার স্বপ্ন দেখতে পারে।’ (পৃষ্ঠা ১০৭)

এই উদাসপুরে অথবা এই দেশে আর কোনো আদর্শ অবশিষ্ট নেই। কোনো আশা নেই।

তাহলে কী আছে?

আছে ভয়। আছে অবদমন। আছে কোনোমতে মুখ বুজে দিন পার করে করে দেহটিকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা। ফলে শেষমেশ কী আসে? আসে বিকলাঙ্গতা। মনে ও মগজে। কারোই আর কাউকে বিশ্বাস করার সাহস হয় না। কেবল সন্দেহ জাগে, কেবল সংশয় ও অবিশ্বাস জাগে।

যখন কোনো ভাবনা ও বিশ্বাসই অন্য কারো সাথেই ভাগ করে নেওয়ার সাহস আসে না যেখানে, সেখানে একটি কিশোর কেমন কাঠামো পায়, যখন সে তরুণ বয়সে পৌঁছে তখন? কায়সার বোধ করে: ‘যে বয়সটিতে মানুষের সর্বোচ্চ মানসিক বিকাশ ঘটে সেই বয়সটি যদি কাটে এমন একটি আবদ্ধ সময়ে, আবদ্ধ পরিবেশে; তাহলে সে হয়ে ওঠে অসম্পূর্ণ মানুষ। …এইরকম সম্পর্কহীনতার সময়ে এক অসম্পূর্ণ মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠেছি আমি। স্কুলজীবনে এই মহামানবের আবির্ভাব হলো। স্কুল ছেড়ে কলেজে, তারপর ইউনিভার্সিটিতে এলাম। কৈশোর-তারুণ্য-যৌবন কাটলো তার বুটের তলায়।’ (পৃষ্ঠা ১০৭)

 

৪.
শুধু যে শাসকের দেওয়া নিপীড়নই লোকসাধারণের জীবন-মন বিকলাঙ্গ করে তুলতো এইখানে, তা নয়। সাথে থাকে সামাজিকগণের রূঢ়তা, অন্যায্য দুর্ব্যবহার ও দম্ভের কঠিন ধাক্কা। জীবন আরো বিড়ম্বিত হয়। খুব বিপন্ন হয়ে যেতে থাকে। আহমাদ মোস্তফা কামাল সেই সামাজিক শীতল-নীরব নিপীড়নের পরিচয়ও দিয়েছেন অতি বিশদরকমে।

অন্ধ জাদুকর-এ কায়সার তো সংসারের অনটনের ধাক্কাটা পায়ই, তার সাথে পায় নিজেদের অতি নিকট কিন্তু ধনী আত্মীয়দের দেওয়া অবহেলার আঘাত। কিশোরকালের প্রধান যে আশ্রয় নানাবাড়ি, সেইখানে শিশু-কায়সার ও তার অন্য ভাইবোন-কয়টার জন্য বরাদ্দ থাকে কেবলই হেলাফেলা ও অনাদর। কারণ, তাদের ‘বাবার আর্থিক অবস্থা খারাপ’। ‘নিজেদের গ্রামে দারিদ্র্যের রূপটি ঢেকে’ রাখা গেলেও, ‘নানুবাড়িতে গেলে সেটা প্রকট হয়ে দেখা’ দিতে থাকে। মামাবাড়ির সকলে ছিলো ‘শিক্ষিত ও সচ্ছল’। বিত্তের প্রতিযোগিতায় কায়সারের বাবা ওই আত্মীয়দের সাথে ‘কুলিয়ে’ উঠতে পারতো না। ফলে সেই বাবার সন্তানদের জন্য বরাদ্দ থাকতো ‘অবহেলা অনাদর’।

কায়সার জানায়: ‘প্রতিবছর ফেব্রুয়ারিতে আমাদেরকে নানুবাড়িতে যেতে হতো নানা মৃত্যুবার্ষিকীকে সামনে রেখে। এক মিলনমেলা বসতো সেখানে। কিন্তু আমাদের জন্য প্রীতিকর ছিলো না সেই যাওয়া। …মামা ও খালাদের জন্য ওই বাড়িতে আলাদা আলাদা রুমের ব্যবস্থা ছিলো। …অথচ আমাদের জন্য তেমন কিছু ছিলো না। …আমরা যে কে কোথায় থাকতাম তার কোনো ঠিকঠিকানা ছিলো না। …মা পড়ে থাকতো রান্নাঘরে। একসঙ্গে যখন খাওয়ার ব্যবস্থা হতো তখন মা’র রান্না-করা তরকারি খেতে খেতে প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতো সবাই, কিন্তু আমাদের পাতে কখনো বড় মাছের টুকরা পড়তো না, সর-পড়া দুধ খেতে পেতো শুধু শহুরে কাজিনরা। ও বাড়িতে একটা সফেদা গাছ ছিলো। ফল পেকে মাটিতে পড়লে আমরা হয়তো কুড়িয়ে আনতাম, নানু সেই ফল আমার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে বলতেন, এটা নাহিদের জন্য রেখে দে। …এইসব নিদারুণ অবহেলা-অপমান চুপ করে সহ্য করে গেছে মা। …ওসব স্মৃতি যখন মনে পড়ে, তখন এতো মন খারাপ হয়ে যায়’! (পৃষ্ঠা ১০৪-১০৫)

এইসব অনাদর-উপেক্ষাকে সহ্য করার সাথে সাথে সহ্য করে চলতে থাকতে হয় ‘বিস্তর সামাজিক বিধিনিষেধ’-কে। এইখানে নিত্যনিরন্তর, কঠিনরকমে উঁচোনো থাকে নিষেধের তর্জনী: ‘এমনিতেই নানারকম বাধা-নিষেধের মধ্যে দিয়ে আমাদেরকে বড় হয়ে উঠতে হয়; এটা করা যাবে না,ওটা করা যাবে না, এটা বলা যাবে না, ওটা বলা যাবে না—কী যে করা যাবে, আর কী যে বলা, সেটা আর বলে না কেউ।’ (পৃষ্ঠা-ওই)

কায়সার বোঝে এতোসব চাপে থেকে-থেকে কোনো-না-কোনোভাবে বিকলাঙ্গ হওয়া ছাড়া ব্যক্তির গত্যন্তর নেই। আহমাদ মোস্তফা কামালের নায়কদের আখ্যানগুলো তাই একটি রুদ্ধ-সমাজ বাস্তবতায় বেড়ে উঠতে বাধ্য হওয়া প্রাণদের বিকলাঙ্গতার ইতিকথা বলেও গণ্য হতে পারে।

আহমাদ মোস্তফা কামাল তাঁর গল্পে-গল্পে যে ভূখণ্ডটিকে আমাদের সামনে হাজির করেন, সেটা এমনই এক দুনিয়া, যেইখানে কিছুমাত্র সুধা বা মাধুর্য বিরাজ করে না। সেখানে একমাত্র দাপটশালী হচ্ছে দ্বিপদ একজাতের পশু, তারা শাসক-সম্প্রদায়ভুক্ত। সাধারণ সামান্য লোকসকলের জীবন তারা থেঁতলে-ভেঁতলে, আছড়ে-দুমড়ে মিসমার করে চলেছে। ন্যায়ের শাসন সেখানে নেইই, সেখানে বিরাজ করে ‘জোর যার মুল্লুক তার’ নীতি। শাসক বা রাষ্ট্রই সেখানে পৃষ্ঠপোষকতা করে চলেছে ওই দ্বিপদবিশিষ্ট শ্বাপদদের। কোনো-না-কোনোভাবে প্রতিটি সাধারণ মনুষ্য-জীবন সেখানে বিপন্ন। আহত ও পর্যুদস্ত সেখানে আশা ও আলো। সেখানে অপ্রকৃতিস্থ হয়ে যাওয়া ছাড়া লোকসকলের যেন অন্য কোনো নিয়তি নেই।

প্রাকৃতবাদী তাত্ত্বিক ও ঔপন্যাসিক এমিল জোলা (১৮৪০-১৯০২) রচনা করেন এমন এক আশাহীন বিশ্ব, যা অন্ধ ও অশুভ শক্তি দিয়ে নিয়ন্ত্রিত। এই বিশ্বে শুভ পুরস্কৃত হয় না, অশুভও দণ্ডিত হয় না। এ এক ভয়াল রসাতল। আহমাদ মোস্তফা কামালও আমাদের সামনে হাজির করেন অমনই ভয়াবহ বীভৎস এক রসাতলকে, যাকে দোজখ বললেও ভুল বলা হয় না। এমিল জোলা’র রসাতলের বাসিন্দারা সমাজের অতি দুর্গত, দারিদ্র্যলাঞ্ছিত নিম্নগোত্রভুক্ত। তেমন অতি নিম্নতলবাসীর জীবন-দুর্গতিকথা বলে ওঠার ব্যাপারে কামালের আগ্রহও সামান্য বলেই আমরা লক্ষ করি।

তিনি সর্বদাই আগ্রহ বোধ করেন নিপাট মধ্যবিত্তদের গল্প বলতে। তার উচ্চশিক্ষিত, ‘প্রকৃতির সৌন্দর্য, শিল্পের সৌন্দর্য’ উপভোগ করার মতো সুরুচিসম্পন্ন। ‘মানুষও যে প্রকৃতিরই সৃষ্টি, মানুষের মধ্যেও যে বিপুল সৌন্দর্য আছে, এটা’ তারা অনুভব করতে পারে। তারা সংবেদনশীল, শান্তিপ্রিয়; কিন্তু নিজ ভূখণ্ডেই তারা পরবাসী। শিমশোনের মতোই সর্বার্থে শৃঙ্খলিত তাদের সকলের জীবন। তাদের ভূভাগটিই আর তাদের নয়। ওটি দখল করে নিয়েছে রাক্ষসেরা। সাধারণ মানুষদের জীবনের সমস্তটাই ভয়াবহভাবে বেষ্টিত হয়ে আছে ওই দাঁতালো হিংস্র দ্বিপদ দ্বারা। যেকোনোভাবে অথর্ব-অচল হয়ে ওঠাই মানুষের নিয়তি এইখানে।

এ এক এমনই জনপদ যেখানে ব্যক্তির জীবন কোথাও কোনোভাবেই নিরাপদ নয়। নিরাপদ নয় ব্যক্তির গৃহকোণ, নিরাপদ নয় তার বহির্জগত। ব্যক্তির দৈহিক ও মানসিক সুস্থতাকে যেমন হরণ করে নিয়েছে কুরাজনীতি। তেমনি রাজনীতিক হিংস্রতার ছোবল ক্রমে বিকল করে দিচ্ছে লোকের ভেতর-বাহির, শরীর-আত্মা। ভিন্ন মতাবলম্বী কাউকে এখানে মোটেও বরদাস্ত করতে প্রস্তুত নয় তার রাজনীতিক প্রতিপক্ষ। গুপ্তহত্যা নিত্যদিনের সাধারণ এক ব্যাপার। এইখানে আততায়ী আর ধর্ষকেরা হানা দিয়ে চলছে প্রতিটা ঘরে।

কে কাকে এখানে কতোপ্রকারে জুলুম করে উঠতে পারবে, অহর্নিশি যেন তারই প্রতিযোগিতা চলছে ওই দেশে। দাম্পত্য এখানে তিক্ত নীরক্ত, বিষাক্ত। স্বামী ও স্ত্রীর আর এখানে একে অন্যের সহায়-ভরসা নয়। তারা পরস্পরকে ঘৃণা করে। ঘৃণা ও তাচ্ছিল্য করতে করতে এক ছাদের নিচে বসত করে চলে, লজ্জা পায় না।

অক্ষম প্রিয়জনের সামনে ধর্ষিতা হচ্ছে নারী। স্বামীর সাথে ঈদের শপিং করতে যাবার পথে রোজার বিকেলে ধর্ষিতা হচ্ছে স্ত্রী। ‘স্বামীর গান শোনা ও কবিতা পড়া ও চাঁদ দেখা ও বাংলার রূপে হওয়ার অপরাধে’ নিজ গৃহে ধর্ষিতা হতে হচ্ছে স্ত্রীকে। ধর্ষণ কি এখানে শুধু নারীর জন্যই বরাদ্দ থাকছে? না! এমতে আসলে ধর্ষিতা হচ্ছে সমস্তটা দেশই। ব্যক্তি হয়ে উঠেছে আত্মহননপ্রবণ। ব্যক্তিসম্পর্কগুলো দরদ ও মমতার স্পর্শশূন্য, নির্দয়তায় পরিপূর্ণ। কে কাকে এখানে কতোপ্রকারে জুলুম করে উঠতে পারবে, অহর্নিশি যেন তারই প্রতিযোগিতা চলছে ওই দেশে। দাম্পত্য এখানে তিক্ত নীরক্ত, বিষাক্ত। স্বামী ও স্ত্রীর আর এখানে একে অন্যের সহায়-ভরসা নয়। তারা পরস্পরকে ঘৃণা করে। ঘৃণা ও তাচ্ছিল্য করতে করতে এক ছাদের নিচে বসত করে চলে, লজ্জা পায় না।

আহমাদ মোস্তফা কামাল তাঁর গল্পের পৃথিবীতে প্রবল নৈরাশ্যবাদী একজন, যিনি আমাদের জানাতে থাকেন যে, ধরিত্রীর মধুরতা সেই কবে লুপ্ত হয়ে গেছে! আশা ফুরিয়েছে। এখন উদ্যমের আর কোন প্রয়োজন! ধরিত্রী সন্তানের জন্য, এখন আছে শুধু অবিরল মনস্তাপে দগ্ধ হতে থাকার নিয়তি। হে ধরিত্রীকন্যা ও পুত্রগণ, নিরাশাই সত্য শুধু। ওইই একমাত্র সত্য হয়ে এখন বিরাজ করে চলে।

 

একটুখানি পাদটীকা

আমরা লক্ষ করেছি, কথাকার আহমাদ মোস্তফা কামাল নিজেও সৃষ্টিশীল কারুকার মাত্রকেই জাদুকর বলেই মানেন। সেটি তিনি নিজেই স্পষ্ট করে জানিয়ে দেন তাঁর উপন্যাস অন্ধ জাদুকর (২০০৯)-এ। কিন্তু এই জাদুকরকে কামাল গণ্য করেন অন্ধ বলে। কেন সে অন্ধ? কামাল বিশ্বাস করেন: ‘তোরা, মানে লেখকরা। তোরা সব বায়বীয় চরিত্র তৈরি করে তাদের মধ্যে মমতা-প্রেম-মহত্ত্ব এইরকম গুণাবলি আরোপ করে পাঠকদের মোহমুগ্ধ করে ফেলিস। বাস্তবে তো অমন মানুষের অস্তিত্ব নেই। …তুই তো অন্ধ জাদুকর। …জাদু দেখিয়ে মানুষকে ঘোরের মধ্যে ফেলে দিচ্ছিস, অন্ধ বলে তা দেখতেও পাচ্ছিস না।’ (পৃষ্ঠা ৮১-৮২)

কারুকার অন্ধ হলেও বা ক্ষতি কী! যাদের জন্য তিনি দিগন্তে-দিগন্তে রঙধনু সৃজন করেন, সেই তারা থাকুক সত্যকারের চক্ষুষ্মান হয়ে। আর থাকুক তারা কারুকারের সৃজনপ্রতিভার সামনে হাঁটুমুড়ে বসার মতো হৃদয়বান হয়ে।

 

…..

সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি

১. আখতারুজ্জামান ইলিয়াস: অন্য ঘরে অন্য স্বর। অনন্যা, ঢাকা। প্রথম প্রকাশ: ১৯৭৬।

২. মাহমুদুল হক: জীবন আমার বোন। জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী, ঢাকা। প্রথম প্রকাশ: মে ১৯৭৬।

৩. হায়াৎ মামুদ অনূদিত গিলগামেশ। অবসর, ঢাকা। প্রথম অবসর প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০০০।

৪. জীবনানন্দ দাশ: বাসমতীর উপাখ্যান। জীবনানন্দ-রচনাবলি (পঞ্চম খণ্ড), ঐতিহ্য, ঢাকা। ২০০৬।

৫. মাহমুদুল হক: কালো বরফ। মাহমুদুল হক রচনাবলি (প্রথম খন্ড)। আবু হেনা মোস্তফা এনাম সংকলিত ও সম্পাদিত। বাংলা একাডেমি।

৬. মণির পাহাড়: সোভিয়েত দেশের নানা জাতির রূপকথা। রাদুগা প্রকাশন, মস্কো। প্রকাশকাল: অজ্ঞাত।

৭. পবিত্র বাইবেল: পুরাতন ও নূতন নিয়ম। বাংলাদেশ বাইবেল সোসাইটি, ঢাকা।

৮. আহমাদ মোস্তফা কামাল—
ক. আগন্তুক (উপন্যাস)। শ্রাবণ প্রকাশনী, ঢাকা। প্রথম প্রকাশ: ২০০২।

খ. ঘরভরতি মানুষ অথবা নৈঃশব্দ্য (গল্পগ্রন্থ)। পাঠসূত্র, ঢাকা। প্রথম প্রকাশ: ২০০৭।

গ. অন্ধ জাদুকর (উপন্যাস) পাঠসূত্র, ঢাকা। প্রথম প্রকাশ: ২০০৯।

ঘ. অশ্রু ও রক্তপাতের গল্প (গল্পগ্রন্থ)। শুদ্ধস্বর, ঢাকা। প্রথম প্রকাশ: ২০১১।

ঙ. বড়োদের গল্প যেমন হয় (গল্পগ্রন্থ)। নাগরী, সিলেট। ২০২০।

চ. জলের অক্ষরে লেখা (উপন্যাস)। পাঠক সমাবেশ, ঢাকা। ২০২৪।

9. Becker. George J. ( edited): Documments of Modern Literary Realism. Princeton University press. New Jercy. 1963.

10. Kenneth N. Taylor: Taylor’s Bible Story Book. Tyngale House Publishers., USA. 1970.

11. James Applegate and others ( edited): Adventure in World Literature. Harcourt Brace Jovenvich Publishers. USA. 1970.

13. R.K. Narayan: Malgudi Landscapes: The best of R. K.Narayan. (Edited by S. Krishnan). Penguin Books India Limited, New Delhi, India. 1992.


আরও পড়ুন : মনুষ্যসম্পর্ক, পরিব্রজ্যা ও রসাতল এইখানে মূর্ত ও বাঙ্ময় : আহমাদ মোস্তফা কামালের কথাসাহিত্য – ১ম পর্ব

আরও পড়ুন : মনুষ্যসম্পর্ক, পরিব্রজ্যা ও রসাতল এইখানে মূর্ত ও বাঙ্ময় : আহমাদ মোস্তফা কামালের কথাসাহিত্য – ২য় পর্ব

আরও পড়ুন : মনুষ্যসম্পর্ক, পরিব্রজ্যা ও রসাতল এইখানে মূর্ত ও বাঙ্ময় : আহমাদ মোস্তফা কামালের কথাসাহিত্য – ৩য় পর্ব


 

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

বাংলা ভাষার একজন ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক ও গল্পকার। আকিমুন রহমানের গ্রন্থসমূহ হলো : ‘আধুনিক বাংলা উপন্যাসে বাস্তবতার স্বরূপ (১৯২০-৫০)’, ‘সোনার খড়কুটো’, ‘বিবি থেকে বেগম’, ‘পুরুষের পৃথিবীতে এক মেয়ে’, ‘রক্তপুঁজে গেঁথে যাওয়া মাছি’, ‘এইসব নিভৃত কুহক’, ‘জীবনের রৌদ্রে উড়েছিলো কয়েকটি ধূলিকণা’, ‘পাশে শুধু ছায়া ছিলো’, ‘জীবনের পুরোনো বৃত্তান্ত’, ‘নিরন্তর পুরুষভাবনা’, ‘যখন ঘাসেরা আমার চেয়ে বড়ো’, ‘পৌরাণিক পুরুষ’, ‘বাংলা সাহিত্যে বাস্তবতার দলিল (১৩১৮-১৩৫০ বঙ্গাব্দ)’, ‘অচিন আলোকুমার ও নগণ্য মানবী’, ‘একদিন একটি বুনোপ্রেম ফুটেছিলো’, ‘জলের সংসারের এই ভুল বুদবুদ’, এবং ‘নিরুদ্দেশের লুপ্তগন্ধা নদী’।

আকিমুন রহমান ভালোবাসেন গন্ধরাজ আর বেলীফুল আর হিজলের ওড়াভাসা! আর তত্ত্বের পথ পরিক্রমণ! আর ফিকশন! ঊনবিংশ শতকের ইউরোপের সকল এলাকার গল্পগাঁথা আর এমিল জোলার কথা-বৈভব! দূর পুরান-দুনিয়ায় বসতের সাথে সাথে তিনি আছেন রোজকার ধূলি ও দংশনে; আশা ও নিরাশায়!

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।