‘আমি শিশুদের প্রতি খুবই যত্নশীল, ঘরে এবং বিদেশেও। শিশুরা দেশের আশা এবং ভবিষ্যত। শিশুরা গুরুত্বপূর্ণ এবং আমাদের উচিত তাদের প্রতি যত্নশীল হওয়া।’— মাজিদ মাজিদি।
‘চিলড্রেন অব হেভেন’ ও ‘দ্য কালার অব প্যারাডাইস’-এর পরিচালককে নতুন করে পরিচয় করে দেওয়ার কিছুই নেই। তাঁর মতো করে শিশুদের জীবনকে পর্দায় এত চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তোলা লোক দ্বিতীয়টি নেই। মাজিদির সিনেমার মূল থিম মূলত শিশু। নিজের ভেতরেও হয়তো শিশুর মতো সারল্য ও এখনো সবকিছুর প্রতি বিস্মিত হওয়ার ক্ষমতা আছে বিধায় মাজিদি নতুন নতুন সৃষ্টি দিয়ে যাচ্ছেন।
নিজেও তিনি চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন অল্প বয়েসে। বয়স যখন মাত্র ১৩/১৪। থিয়েটার দিয়ে শুরু করলেও ক্রমে অভিনয় ছেড়ে নিজের জগত তৈরি করতে পরিচালনায়। হাত পাকাতে বানিয়েছেন অনেক শর্টফিল্ম। অনেক প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে নিজের তৃতীয় ফিল্ম ‘চিলড্রেন অব হেভেন’ নির্মাণ করেন। এরপর কেবল এগিয়ে চলা। কিন্তু আগের মতো শিশুরাই মূল থিম থাকল মাজিদির সিনেমায়।
এমন কি বড়োদের ক্রাইসিস নিয়ে নির্মিত সিনেমতেও বড়ো ও গুরুত্বপূর্ণ অংশজুড়ে রয়েছে শিশু। ‘দ্য সং অব স্প্যারোস’ ও ‘দ্য উইলো ট্রি’ এর বড়ো উদাহরণ। তবে দুই ওয়ার্কিং কিশোর-কিশোরীর অমীমাংসিত প্রেমকে উপজীব্য করে বানানো ‘বারান’ মাজিদির অন্যান্য কাজ থেকে কিছুটা ভিন্ন। যেখানে দুই প্রধান চরিত্রের এক ইরানি নির্মাণ শ্রমিক লতিফ এবং অন্যজন পিতার দুর্ঘটনার পর ভাগ্যান্বেষণে পরিচয় গোপন করে আন্ডারকন্সট্রাকশনে কাজ নেওয়া আফগান কিশোরী। ‘রহমত’ নামের ছদ্মবেশ নিয়ে যে ছেলে সেজে কাজ নেয়।
মাজিদির ক্যারিয়ারে ব্রেক-থ্রু এনে দিয়েছিল ‘চিলড্রেন অব হেভেন’। দুই ভাইবোন আলী ও জাহরার জুতার গল্প। এই সিনেমা ইরানি চলচ্চিত্র ইতিহাসের এক মাইফলক। ১৯৯৯ সালে প্রথম ইরানিয়ান ফিল্ম হিসেবে একাডেমি অ্যাওয়ার্ডের জন্য মনোনয়ন পায়। এই সিনেমা এতোই প্রভাববিস্তারী ছিল যে, ভারতের বেশ কয়েকজন পরিচালক চেয়েছিলেন ‘চিলড্রেন অব হেভেন’র মতো আরেকটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে। যে শিল্পের প্রাণ আছে তা যে কাউকে ছুঁয়ে যাবে। মাজিদির এই মাস্টারপিস অনেককে তাড়িত করেছে। ভাবিয়েছে। পরবর্তীতে বলিউডের পরিচালক প্রিয়দর্শন তো ‘চিলড্রেন অব হেভেন’র ভারতীয় ভার্শন ‘বাম বাম বোলে’ নামেও সিনেমা নির্মাণ করেন।
প্রতিটি শিশুর ভেতরেও যে কষ্ট ও অভিমান আছে, সবচেয়ে বেশি ভালোবাসা যে তাদের প্রয়োজন তার বর্ণনা দিতে ভালোবাসেন মাজিদি। ‘দ্য কালার অব প্যারাডাইস’ সেই কথাই বলে। আহা! দৃষ্টিহীন শিশুটির দেখার আকুতি, এই বিশ্বের সৌন্দর্যের সঙ্গে যে কম্যুনিকেট করে অন্তরের দৃষ্টি দিয়ে।
কথায় আছে, ‘শিশুরা স্বর্গীয়’। মানুষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় শিশুকাল। যা বড়ো হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জীবনের বিচিত্র-বিচিত্র-কুটিলতার ভেতর প্রবেশ করে। কিন্তু প্রতিটি শিশুর ভেতরেও যে কষ্ট ও অভিমান আছে, সবচেয়ে বেশি ভালোবাসা যে তাদের প্রয়োজন তার বর্ণনা দিতে ভালোবাসেন মাজিদি। ‘দ্য কালার অব প্যারাডাইস’ সেই কথাই বলে। আহা! দৃষ্টিহীন শিশুটির দেখার আকুতি, এই বিশ্বের সৌন্দর্যের সঙ্গে যে কম্যুনিকেট করে অন্তরের দৃষ্টি দিয়ে।
মাজিদ মাজিদির শিশুদের সকলেই সুবিধাবঞ্চিত। কিন্তু তারা থেমে থাকার নয়। জীবনকে তারা দেখে অকৃত্রিম বিস্ময়ে। লড়াই করে প্রতিকূলতার সঙ্গে। ‘সান চিলড্রেন’ যেন সেই বাস্তবতাকেই তুলে ধরে। যাকে আমরা বলি ‘রাস্তার ছেলে’ তাদের নিয়ে এই সিনেমার গল্প। কিংবা বলা যাক তাঁর একেবারে শুরুর দিকের কাজ ‘বাদুক’ নিয়ে। শিশু দাসত্বের করুণ বিষয়ের কথা বলেছেন তিনি। এই ফিচার ফিল্মে মাজিদি নিজেও অভিনয় করেছেন। অবশ্য চলচ্চিত্রে শুরুটাও তার অভিনয় দিয়েই। তাঁর আরেক গুরুত্বপূর্ণ নির্মাণ ‘মুহাম্মদ: দ্য মেসেঞ্জার অব গড’। এই এপিকধর্মী ফিল্মটি নিয়ে অনেক বিতর্ক বা সমালোচনা রয়েছে। এতেও মূল থিম শিশু। মুহাম্মদের নবী হয়ে ওঠার গল্প।
কেন মাজিদির ফিল্ম শিশুদের নিয়ে বা শিশুদের ভিত্তি করে? এই প্রশ্ন আসতেই পারে। তাঁর শিশুরা কেন সুবিধাবঞ্চিত, রাস্তার— এর কারণ কি ‘চিলড্রেন অব হেভেন’র যে জনপ্রিয়তা-বৈশ্বিক পরিচিতি, সেই ধারা থেকে বেরোতে পারেননি তিনি? নাকি ওভাবেই নিজের জগতকে দেখেন মাজিদি? তাঁর জন্ম রাজধানী তেহরানে। যেখানে শিশুরা নাগরিক সুবিধার মধ্যে বেড়ে উঠে। কিন্তু প্রদীপের নিচেও থাকে অন্ধকার। আকাশচুম্বী অট্টলিকার নিচে থাকে বস্তির সুবিধাবঞ্চিত জীবন। কিংবা ধরা যাক, রাজধানীর বাইরে কোনো পার্বত্য বা প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিশুর কথা। যে একজোড়া জুতার স্বপ্ন দেখে এখনও। কিংবা অসহায় বাবাকে সাহায্য করার জন্য বা নিজের সামান্য একটা স্বপ্নপূরণের জন্য কোনো ভিড়ভাট্টার শহরে ফুল নিয়ে নেমে পড়েছে কোনো শিশু। মাজিদি এসব শিশুদের গল্পই বলেন। যেখানে আবেগকে পাশ কাটিয়ে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয় দর্শকদের।
কেন মাজিদির ফিল্ম শিশুদের নিয়ে বা শিশুদের ভিত্তি করে? এই প্রশ্ন আসতেই পারে। তাঁর শিশুরা কেন সুবিধাবঞ্চিত, রাস্তার— এর কারণ কি ‘চিলড্রেন অব হেভেন’র যে জনপ্রিয়তা-বৈশ্বিক পরিচিতি, সেই ধারা থেকে বেরোতে পারেননি তিনি? নাকি ওভাবেই নিজের জগতকে দেখেন মাজিদি?
আমেরিকা বা ইউরোপের শিশুদের তুলনায় আফ্রিকা বা এশিয়ার শিশুদের জীবন পার্থক্য একেবারে ভিন্ন। অথচ শিশুরা পৃথিবীতে এসেছে জগতের সকল সৌন্দর্যকে আরও রাঙাতে। সমান অধিকার নিয়ে। কিন্তু আজকের পৃথিবীতে শিশুরাই সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত। তাদের কল্পনার জগতকে আমরা বড়োরা প্রতিনিয়ত ধ্বংস করে দিচ্ছি। সংকুচিত করে দিচ্ছি তাদের বেঁচে থাকার স্থানটাকে। মাজিদি এখানেই ব্যতিক্রম যে, তিনি জানাতে পেরেছেন এই পৃথিবীটা শিশুদেরও। তাদেরই সবচেয়ে বেশি অধিকার পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দর্যকে আরও বেশি গ্রহণ করার।
উপল বড়ুয়া। জন্ম: ১৯ ডিসেম্বর। রামু, কক্সবাজার। প্রকাশিত বই: কানা রাজার সুড়ঙ্গ (কবিতা), উইডের তালে তালে কয়েকজন সন্ধ্যা (কবিতা), তুমুল সাইকেডেলিক দুপুরে (কবিতা) ও ডিনারের জন্য কয়েকটি কাটা আঙুল (গল্প)।