আমার শৈশব কেটেছে নানুবাড়িতে। নানু নূর মোহাম্মাদ মণ্ডল ছিলেন প্রচণ্ড সংস্কৃতিমনা। নানুবাড়িতে সবসময় সাহিত্যচর্চার আবহ বিরাজ করত। গল্প-উপন্যাসের বই ছিল আমার শৈশবের সঙ্গী, চরিত্রগুলোর মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলতাম। একসময় মনে হলো, আমি কি পারব না লিখতে? সেই ভাবনা থেকেই ছোটো ছোটো ছড়া, গল্প লেখার চেষ্টা শুরু করি। লেখা শেষে নানুকে দেখাতাম, তিনি ভুলগুলো সংশোধন করে দিতেন, সাহস দিতেন।

মায়া হারানোর গল্প | ঈশিতা ইমু | ধরন: ছোটোগল্প | প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ | প্রকাশক: দেশ পাবলিকেশন্স | বইটি সংগ্রহ করতে এখানে ক্লিক করুন
একদিন নানু বললেন, ‘একটা গল্প লিখে দে, পত্রিকায় দেবো।’ তখন আমি অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি। উৎসাহ নিয়ে লিখে ফেললাম ‘বাঘ ও শেয়ালের গল্প’। নানু সেটি ঠিক করে উত্তরাঞ্চলের বহুল প্রচারিত দৈনিক করতোয়া পত্রিকায় পাঠালেন। পরের সপ্তাহেই গল্পটি প্রকাশিত হলো। নানুর আনন্দ দেখে আমার মনে হলো, এ যেন আমার সবচেয়ে বড়ো সাফল্য! পত্রিকা হাতে নিয়ে নানু সবাইকে গল্পটি দেখাতে লাগলেন, বাড়ির সবাই উচ্ছ্বসিত। সেদিনের সেই অনুভূতি আজও স্পষ্ট মনে আছে।
এরপর আমাদের উপজেলায় প্রকাশিত ‘মিশ্রদর্শন’ সাহিত্য পত্রিকায় নিয়মিত লেখা পাঠাতে লাগলাম। সবার কাছ থেকে উৎসাহ পেতাম, যা আমাকে আরও অনুপ্রাণিত করত।
কিন্তু জীবন তো সরল রেখায় চলে না। নানা জটিলতার মাঝে একসময় আমার কলম থেমে গেল। কথায় আছে, ‘কত সরস্বতী হারিয়ে যায়, শুধু লক্ষ্মী হওয়ার ছলনায়!’ আমারও তাই হয়েছিল। জীবনের বাস্তবতায় হারিয়ে গিয়েছিলাম, লেখালেখির জায়গা দখল করে নিয়েছিল বেঁচে থাকার কঠিন লড়াই। লেখালেখি থেকে দূরে ছিলাম প্রায় দেড়যুগ। আর কখনও যে লিখতে পারব এমন কথা কল্পনাতেও ছিল না।
এমন সময় জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিলেন একজন। তিনি বললেন, ‘তুমি তো ভালো লিখতে, আবার শুরু করো।’ কথাগুলো আমার মনের গভীরে ছাপ ফেলল। দীর্ঘ বিরতির পর আবারও কলম ধরলাম।
কিন্তু ঝড় যেন পিছু ছাড়ল না। একবার থামি, আবার শুরু করি। কখনও মনে হয়, ছেড়ে দিই, আবার ভাবি—আমি কি হেরে যাব? না, আমাকে থামলে চলবে না! দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে, এখন শুধু সামনে এগিয়ে যাওয়ার পালা। হতাশার মধ্যে থেকেই লিখে ফেললাম কয়েকটি গল্প।
গল্প আমার কাছে এক বিশাল অরণ্যের মতো, যেখানে প্রতিটি চরিত্র একেকটি গাছ—কেউ মহীরুহ, কেউ লতিয়ে ওঠা লতা। কাহিনির বাঁকগুলো নদীর মতো বয়ে চলে, কখনও শান্ত, কখনও ভয়াল। উত্তেজনার মুহূর্তগুলো ঝড়ের মতো ধেয়ে আসে, গাছের ডালপালায় দুলুনি তোলে, পাতায় পাতায় কাঁপুনি ধরায়। আর রহস্য লুকিয়ে থাকে কুয়াশার মতো
গল্প আমার কাছে এক বিশাল অরণ্যের মতো, যেখানে প্রতিটি চরিত্র একেকটি গাছ—কেউ মহীরুহ, কেউ লতিয়ে ওঠা লতা। কাহিনির বাঁকগুলো নদীর মতো বয়ে চলে, কখনও শান্ত, কখনও ভয়াল। উত্তেজনার মুহূর্তগুলো ঝড়ের মতো ধেয়ে আসে, গাছের ডালপালায় দুলুনি তোলে, পাতায় পাতায় কাঁপুনি ধরায়। আর রহস্য লুকিয়ে থাকে কুয়াশার মতো, অরণ্যের গভীরে, অপেক্ষা করে কোনো পথিকের তা উদ্ঘাটনের।
কখনও গল্প পাহাড়ের চূড়ায় উঠে, যেখানে চরিত্রেরা বিজয়ের নিশ্বাস নেয়, আবার কখনও গভীর উপত্যকায় নামে, যেখানে পরাজয় আর অন্ধকারের ছায়া দীর্ঘ হয়। প্রেমের মুহূর্তগুলো হলুদ শরতের পাতার মতো ধীরে ধীরে ঝরে পড়ে, আর বিদ্রোহী চরিত্রেরা বজ্রপাতের মতো দিগন্তে গর্জে ওঠে।
গল্প এক দিগন্ত বিস্তৃত সূর্যাস্ত—সোনালি আভায় রাঙানো, মুগ্ধতা আর অতৃপ্তির এক অপূর্ব মিশেল। পাঠক হারিয়ে যায় সেই বিস্ময়ে, আর ফিরে আসার আগেই অনুভব করে—কোনো এক অলিখিত অধ্যায়ে সে এখনো বন্দি।
গল্প আমার কাছে শুধু কিছু চরিত্রের সংঘর্ষ বা কাহিনির বিন্যাস নয়, এটি এক ধরনের অভিজ্ঞতা। প্রতিটি গল্পের মধ্যে আমি এক টুকরো বাস্তবতা রেখে যেতে চাই, যেন পাঠক অনুভব করতে পারেন; যেন তাদের মন ছুঁয়ে যায়।
এই বই করার চিন্তা আসলে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে। আমি যখন প্রথম কয়েকটি গল্প লিখি, তখন সেগুলো একান্তই আমার নিজস্ব ভাবনা ছিল। একসময় মনে হলো, এগুলো এক জায়গায় জড়ো করা দরকার। ব্যক্তিগত সম্পর্ক, বিচ্ছেদ, সময়ের পালাবদল, থ্রিলার, সায়েন্স ফিকশন—এসব নিয়েই গল্পগুলো গড়ে উঠেছে। তারপর সিদ্ধান্ত নিই, এই গল্পগুলো একত্রিত করে একটি বই আকারে প্রকাশ করব।
বইটিতে আমি মূলত জীবন থেকে নেওয়া কিছু ছোটোগল্প দিয়ে সাজিয়েছি, যেখানে অনুভূতির গভীরতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। প্রেম, বিচ্ছেদ, মায়া, সময়ের অনিবার্য পরিবর্তন—এসব অনুভূতির ওপর ভিত্তি করেই গল্পগুলো লেখা হয়েছে।
বইটিতে আমি মূলত জীবন থেকে নেওয়া কিছু ছোটোগল্প দিয়ে সাজিয়েছি, যেখানে অনুভূতির গভীরতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। প্রেম, বিচ্ছেদ, মায়া, সময়ের অনিবার্য পরিবর্তন—এসব অনুভূতির ওপর ভিত্তি করেই গল্পগুলো লেখা হয়েছে। কিছু গল্প বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে এসেছে, কিছু গল্প নিতান্তই কল্পনার ফসল। তবে প্রতিটি গল্পের পেছনে কিছু না কিছু সত্যি ঘটনা বা অনুভূতির ছোঁয়া আছে।
আমি জানি, মায়া সহজে হারিয়ে যায় না। তবুও একসময় বুঝতে পারি কিছু সম্পর্ক, কিছু অনুভূতি, কিছু স্বপ্ন—সময়ের স্রোতে ভেসে যেতে বাধ্য। ‘মায়া হারানোর গল্প’ লিখতে বসেছিলাম এই উপলব্ধি থেকেই।
একটা সময় আমি ভেবেছিলাম, মায়া মানে হলো বাঁধন, যা চিরস্থায়ী। কিন্তু জীবন আমাকে শিখিয়েছে, মায়ারও মেয়াদ থাকে। সম্পর্কের উষ্ণতা, স্মৃতির আকর্ষণ—সব কিছুই একদিন বিবর্ণ হতে শুরু করে। আমি দেখেছি, কাছের মানুষ দূরে সরে যেতে পারে, অনুভূতির রং বদলে যেতে পারে, অথচ হৃদয়ের কোনো কোণে সেই মায়া চুপচাপ বসে থাকে অপেক্ষায়।
গল্পগুলো লিখতে লিখতে আমি যেন নিজেকেই খুঁজে পেয়েছি। প্রতিটি চরিত্র, প্রতিটি ঘটনা কোনো-না-কোনোভাবে আমারই জীবনের প্রতিচ্ছবি।
গল্পগুলো শুধু আমার গল্প নয়, এটি আমাদের সবার গল্প। জীবনে চলার পথে আমরা সবাই একবার না একবার হারিয়ে ফেলি প্রিয় কিছু। হয়তো মানুষ, হয়তো সময়, হয়তো স্বপ্ন কিংবা এক টুকরো সুখ। ‘মায়া হারানোর গল্প’ ঠিক সেইসব মুহূর্তের কথা বলে, যখন আমরা বুঝতে পারি, কিছু হারিয়ে গেলেও তার ছায়া আমাদের ভেতরে থেকে যায়।
মায়া হারিয়ে যায়, কিন্তু সত্যিই কি পুরোপুরি হারায়? নাকি কোনো না কোনোভাবে সে আমাদের মধ্যেই বেঁচে থাকে? এই বইয়ে আমি সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছি।
বইটি প্রকাশ করেছে, দেশ পাবলিকেশন্স। এটি পাওয়া যাবে বইমেলায় ৬৮৬, ৬৮৭, ৬৮৮ নম্বর স্টলে। প্রচ্ছদ করেছেন শিল্পী ধ্রুব এষ। বইটির মুদ্রিত মূল্য ২৮০ টাকা।

বগুড়া জেলার ধুনট উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বর্তমানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কর্মরত আছেন। ‘মায়া হারানোর গল্প’ তাঁর প্রকাশিত প্রথম ছোটোগল্পের বই।