১.১ নিখোঁজ
প্রাইমারি স্কুলে থাকার সময়কার ঘটনা। একদিন শুনি পাশের বাড়ির বকুল চাচাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তখন সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত। চাচি দরজায় বসে বিলাপ করছে আর তার ছেলেকে অভিশাপ দিচ্ছে কেন সে ওই মাঠের কাছে গরু বাঁধতে গিয়েছিল। ওই মাঠ বলতে দরিয়াভাল্লার মাঠ। আমাদের বাড়ির ঠিক পেছনেই অনেক গুলো বড়ো বড়ো ধানী জমি। আশেপাশের কয়েক গ্রামের সবার জমি সেখানে। ওই জমিগুলোর মাঝখানেই একটা খালি মাঠ। সে মাঠের আশেপাশে কেউ যায় না। এমনকি কেউ সেই মাঠ নিয়ে কোনো কথা বলতে চায় না। কোনো এক ভয়, শঙ্কা, সন্দেহ জড়িয়ে থাকা দরিয়াভাল্লার মাঠে গরু খুঁজতে গিয়া বকুল চাচা নেই হয়ে গিয়েছে। এরকম আরও আরও নেই হয়ে গিয়েছে অনেকজন। একেকজন হারিয়ে যায় আর কিছুদিন গ্রামে একটা অদৃশ্য গুমোট আঁধার নেমে আসে। সেই আঁধারে আমরা সাঁতরে সাঁতরে হারিয়ে যাওয়া মানুষটাকে খুঁজি। আমাদের খোঁজ গিয়ে ঠেকে দরিয়াভাল্লার মাঠে। এরপর আর এগোয় না। তখন কেউ আর কিছু বলে না। জানা আর না-জানার মধ্যিখানের যে সংকীর্ণ রেখা তার কোনো একটা বিন্দুতে গিয়ে আমরাও হারিয়ে যাই।
আমরা যখন তখন দরিয়াভাল্লার মাঠের দিকে তাকিয়ে থাকি। বোঝার চেষ্টা করি এতবড়ো মাঠের ঠিক কোন জায়গায় গিয়ে বকুল চাচা হারিয়ে গিয়েছে। চাচি দরিয়াভাল্লার মাঠের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে আর একে ওকে সেখানে নিয়ে যেতে চায়। কেউ যেতে রাজি হবে না জেনেও এর কাছে ওর কাছে অনুনয় বিনয় করে।
আমরা যখন তখন দরিয়াভাল্লার মাঠের দিকে তাকিয়ে থাকি। বোঝার চেষ্টা করি এতবড়ো মাঠের ঠিক কোন জায়গায় গিয়ে বকুল চাচা হারিয়ে গিয়েছে। চাচি দরিয়াভাল্লার মাঠের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে আর একে ওকে সেখানে নিয়ে যেতে চায়। কেউ যেতে রাজি হবে না জেনেও এর কাছে ওর কাছে অনুনয় বিনয় করে। আমি একদিন চুপিচুপি গিয়ে চাচিকে বলি যে আমি তার সাথে বকুল চাচাকে খুঁজতে যাব, দরিয়াভাল্লার মাঠে। চাচি কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকে তারপর বলে বাড়িত যা। আমি বাড়ি চলে আসি। তারপরের দিন আবার যাই। চাচিকে আর খুঁজে পাই না। চাচিকে কেউই খুঁজে পায় না। চাচির একমাত্র ছেলে মুকুল তাদের বাড়ির সামনের পুকুরঘাটে বসে থাকে। সাথে আরও অনেকেই বসে থাকে। কিছুদিন মানুষ তার পাশে পাশে থাকে, তার আদর কদর করে। তারপর একদিন সে একলা হয়ে যায় আর একা একা ঘাটে বসে থাকে। বাসস্টপে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এইসব কথা ভাবছিলাম। এই সময় ফোন বেজে উঠল। অরণীর ফোন। রিসিভ করতেই বলল দেখা করতে চায়। কি জানি জরুরী কথা আছে। আমি লাফ দিয়ে একটা বাসে উঠে পড়লাম।
২.১ অরণী
আমার আর অরণীর মধ্যে আদতে স্বাভাবিক কোনো কথা হয় না বললেই চলে। তারমানে এই না যে সবসময় অস্বাভাবিক কথা হয়। বেশিরভাগ সময়ই আমাদের কথাগুলো কেন জানি ঠোঁটের সীমানাপ্রাচীর পার হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই তিতা হয়ে যায়। এই তিতাভাব কাটতেই চায় না। এমনকি খুব রোমান্টিক কোনো বিষয়ও দুই মিনিট পরে তিতা হয়ে যায়। ওইদিকে আমার তিতা নিয়ে ব্যাপক সমস্যা। জ্বর হলে আমি প্যারাসিটামল খাই না যদি জিভে তিতা লেগে যায়! কখনো বাজার করতে গেল করল্লার দিকে তাকাই না! এমনকি নিমগাছের নিচ দিয়ে হাঁটতে হবে বলে নানার বাড়ি যাই না! আর সেই আমার জীবন হয়ে আছে তিতায় তিতাক্ত। ও! অরণীর পরিচয়টা তো দেওয়া হলো না। ও হচ্ছে আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দরী নারী। চেহারার কাটিং অনেকটা ট্রয়ের হেলেনের মতো। হেলেনকে আমি যদিও কখনো দেখিনি, কিন্তু মনে হচ্ছে হেলেনের চেহারার কাটিংও ওর মতোই হবে। অরণী ছিল আমার কলিগ তেহজিবের প্রেমিকা। এখন আমার প্রেমিকা। তেহজিবই অনেকটা কুসলিংবাজি করে এই অগ্নিসুন্দরীকে আমার কাছে চালান করে দিয়েছিল। এই ট্রান্সফারের কাহিনি অনেক প্যাঁচালো। পরে কখনো মন চাইলে বলব। আপাতত অরণীর বিষয়টা নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে। কী করব কার কাছে যাব কিছুই বুঝি না। সুন্দরের নেশা খুব খারাপ জিনিস। এই নেশাই আসলে কিছু করতে দেয় না। কি-ই বা করব, অরণীর মতো এমন সুন্দরী, স্মার্ট মেয়ে যে আমার সাথে প্রেম করে এটাই আমার সাত জনমের ভাগ্য। আমি নিজেকে বুঝ-টুজ দিয়ে চলি। বারবার ছুটে যাই ওর কাছে। পতঙ্গ যেমন আগুনের শিখার দিকে বারবার ছুটে যায় তেমন। প্রতিবার জ্বলেপুড়ে আসি। বুঝতে পারি, কোন আগুনে পুড়ে তেহজিব অরণীকে আমার কাছে দিয়ে বিয়েশাদী করে কানাডা চলে গেল। আমি কান ধরি, তওবা করি। এইবারই শেষ যাওয়া, আর না। আমি সুন্দরের খ্যাতা পুড়ি। কিন্তু খ্যাতা আর পোড়া হয় না। আবার ছুটে যাই অরণীর কাছে। যেন ওর কাছে ছুটে যাওয়াই আমার কপালের লিখন। একটা সময় এমন করেই বারবার ছুটে যেতাম দরিয়াবালার কাছে। হায়, দরিয়াবালা!
৩.১ দরিয়াবালা
একদিন স্কুল থেকে ফিরে বাড়ির পেছনে ঘুড়ি উড়াতে গেলাম। সাথে সাদুল মামা। সাদুল মামা আমাদের গ্রামেরই। আমার জন্ম থেকে যে দুটো জিনিস একরকমই দেখে আসছি। তার একটা হলো বাড়ির সামনের শিমুল গাছ আর অন্যটা হলো এই সাদুল মামা। নির্দিষ্ট কিছুই করেন না। শুধু এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ান। এর ওর টুকটাক কাজ করে দেন আর সময় পেলেই বাচ্চাদের সাথে খেলায় মজে যান। একটা ফড়িং যেমন খুব আয়েশে এদিক সেদিক উড়ে বেড়ায় সাদুল মামা সে রকম। আমার খুবই পছন্দের ছিল কারণ আমি তাকে প্রচণ্ড হিংসা করতাম। ঘুড়ি উড়ানোর যাবতীয় কলা-কৌশল তার কাছ থেকেই শেখা। সেদিন সুতায় একটা বাইম টান দিতেই ঘুড়ি সুতা থেকে গেল ছিঁড়ে। আমরা দুজনই পেছন পেছন দৌড় দিলাম। একটূ দূরে যেতেই সাদুল মামা থেমে গেল। বলল আর যাওয়া যাবে না। একটু পরেই দরিয়াভাল্লার মাঠ। আমি খুব জোর করলাম। কিন্তু সে কিছুতেই যাবে না। ফেরার সময় আমি জিজ্ঞেস করলাম দরিয়াভাল্লার মাঠে কেন মানুষ যায় না। আর কেউ গেলে কেন আর ফিরে আসে না। সাদুল মামা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, দরিয়াবালা সবাইকে খেয়ে ফেলে। তখন আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, দরিয়াবালা কে? মামা বলল যে এই ব্যাপারে আসলে সে তেমন কিছুই জানে না। পরে বলল যে আসলে কেউই তেমন কিছুই জানে না। যা জানে তা হলো— ওই মাঠটা ছিল এক সময় বিশাল দরিয়া। দরিয়ার পাড়ে ছিল এক রাজার রাজত্ব। রাজার সবই ছিল, কিন্তু ছিল না কোনো সন্তান। পরে একদিন দরিয়ার কূলে হাঁটার সময় রাজা রাণী একটা কন্যা শিশু খুঁজে পায়। কী তার রূপ, কী তার রং। রাজা তাকে প্রাসাদে নিয়ে যায়। দরিয়ার কূলে পাওয়ায় কন্যার নাম হলো দরিয়াবালা। দিন যত যায় দরিয়াবালার রূপ তত বাড়ে, তার সাথে যোগ হয় গুণ। এমন কোনো বিদ্যা নাই যা রাজা কন্যাকে শেখায় না। দিনে দিনে তার রূপ-গুণের কথা ছড়াতে থাকে। এক সময় রাজা মারা যায়। তার জায়গায় রাজ্যের ভার নেয় দরিয়াবালা।
দরিয়ার পাড়ে ছিল এক রাজার রাজত্ব। রাজার সবই ছিল, কিন্তু ছিল না কোনো সন্তান। পরে একদিন দরিয়ার কূলে হাঁটার সময় রাজা রাণী একটা কন্যা শিশু খুঁজে পায়। কী তার রূপ, কী তার রং। রাজা তাকে প্রাসাদে নিয়ে যায়। দরিয়ার কূলে পাওয়ায় কন্যার নাম হলো দরিয়াবালা।
কিন্তু একদিন বিদেশী কোনো এক রাজা সব রাজ্য জয় করতে করতে আসে এই রাজ্যে। কী তার ঠাঁট-বাট, কী সৈন্যের বহর। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সব শেষ। শুধু বেঁচে থাকে দরিয়াবালা। বেঁচে থাকতে হলে শর্ত একটাই। রাজাকে বিয়ে করতে হবে। সে রাজি হয়। কিন্তু তার রাজ্যের এত এত মানুষের খুনীকে বিয়ে করতে মন সায় দেয় না। বিয়ের সাজে সে মোহরভরা কলসি গলায় বেঁধে জীবন দিয়ে দেয় দরিয়ার জলে। দরিয়ার কূলে পাওয়া কন্যা দরিয়ায় ফিরে যায়। ওই দিনই দুনিয়ার সবাইকে ঘুমে রেখে গোটা রাজ্য গিলে খায় দরিয়া। তারপর নাকি মুহূর্তের মধ্যে দরিয়ার সব জল শুষে নেয় মাটি। আর সেই জায়গায় হয় এই মাঠ। দরিয়াবালার মাঠ। লোকের মুখে মুখে তা হয়ে যায় দরিয়াভাল্লার মাঠ। এখনো এই মাঠের উপরে কেউ গেলে তার রক্ষা হয় না। দরিয়াবালা তাকে গিলে খায়। সাদুল মামার মুখে এই কাহিনি শুনে আমি চুপ হয়ে যাই। দরিয়াবালার জন্য আমার খারাপ লাগতে থাকে। খুব মায়া হয় তার জন্য। আমার খুব ইচ্ছে হয় দরিয়াবালাকে একটু দেখি। তাকে জিজ্ঞেস করি কেন সে মানুষ গিলে খায়। আমার খুব ইচ্ছে হয় তার সমস্ত দুঃখগুলো চুপটি করে বসে শুনতে। বাড়ির কাছাকাছি গিয়ে সাদুল মামা আমায় বাড়ি যেতে বলে উত্তরপাড়ার দিকে চলে যায়। আমি বাড়িতে ঢুকে দেখি টমি বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে।
৩.২ টমি
টমি আমাদের পালা কুকুর। সে হলো ছয় নাম্বার টমি। এর আগে আমাদের আরও পাঁচটা টমি ছিল। কেন জানি আমাদের সব কুকুরের নামই টমি হয়। এই টমি আবার প্রথম টমির পঞ্চম প্রজন্ম। প্রথম টমি যে কীভাবে আমাদের কাছে এসেছিল তা কেউ বলতে পারবে না। শুধু এতটুকু শুনেছি যে একদিন সকালে দেখা যায় বাড়ির সামনে একটা নাদুসনুদুস কুকুর ছানা। কেউ একজন তার নাম দিয়ে দেয় টমি। এরপর থেকে শুরু হয়ে যায় দ্য টমি ডাইন্যাস্টি। সেদিক দিয়ে এখনকার টমি হলো টমি দ্য সিক্সথ। মহান পরিবারতন্ত্র আস্তে আস্তে সবাইকে ছাড়লেও আমাদের তৃতীয় বিশ্বকে ছাড়ে না। তো এই টমি দ্য সিক্সথ একদিন এক কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলল। মায়ের সাথে বাজারে গিয়ে একজোড়া জুতা কিনেছিলাম। জাম্প কেডস। অনেক অধ্যবসায়ের পর এই জাম্প কেডস প্রাপ্তি। একদিন ধুয়ে টুয়ে রোদে শুকাতে দিয়েছিলাম। বিকেলবেলা দেখি কেডস তার জায়গায় নেই। অনেক খোঁজার পরে পাওয়া গেল ঘরের পেছনে। কিন্তু কেডস আর কেডস নাই। টমি কামড়ে তার কোনো কিছুই আর অবশিষ্ট রাখেনি। আমার প্রচণ্ড কান্না পেল। মনে হলো কে জানি আমার বুকে ছুরি মেরে দিয়েছে। আবার কবে এরকম একটা কেডস পাওয়া যাবে তার তো কোনো ঠিকই নেই। উলটা নিজের জিনিস যত্ন না করে রাখায় বেদম পিটুনি। কিছুদিন দুঃখী দুঃখী মন নিয়ে ঘোরার পর সব ভুলে গেলাম। ঘুড়ি ওড়াতে একদিন বাড়ির পেছনে গেলাম। সাথে নিলাম টমিকে। ঘুড়ি ওড়ানো শেষে চোখ গেল দরিয়াভাল্লার মাঠের দিকে। আমার দরিয়াবালাকে দেখতে ইচ্ছে হলো। টমির দিকে তাকিয়ে বললাম যাবি? টমি বলল সে যাবে। মানে মুখে বলেনি। ইশারা-ইঙ্গিতে বলেছে। আমরা আস্তে আস্তে সেদিকে গেলাম। যখন দরিয়াভাল্লার মাঠে গেলাম তখন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এলো। যতই ভেতরের দিকে যাই ততই ভয় লাগতে শুরু করে। টমি আমার পেছন পেছন আসে। মাঠের মাঝখানে যেতেই মনে হলো সময় থেমে গেছে। সন্ধ্যা রাতের দিকে যাচ্ছে না। আর আশপাশে কোনোদিকেই কিছু নেই। আমার মনে হলো ফিরে যাওয়া উচিত। টমিও বলল সে ফিরে যেতে চায়। আমরা বাড়ির পথ ধরি। তখনই হঠাৎ মনে হলো যেন মাটি ফেটে পানি বের হচ্ছে। মুহূর্তেই হাঁটু পানি হয়ে গেল। তারপরই কোমর পানি। আমি টমিকে কোলে নিয়ে দৌড়াতে শুরু করলাম। পানি আস্তে আস্তে বুকের কাছাকাছি চলে এলো। গলার কাছে আসতেই এবার সাঁতরাতে শুরু করলাম। কিন্তু কোন দিকে যাব কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। চারদিকে শুধু পানি আর পানি। এসময় মনে হলো কে জানি আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আরেকটু সামনে গিয়ে দেখলাম বিয়ের সাজে এক রূপবতী কন্যা জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। পৃথিবীর সকল রূপ যেন এই রূপের সামনে কিছুই না। আমার মনে হলো এই সেই দরিয়াবালা। আমি রুদ্ধশ্বাসে তাকিয়ে রইলাম। টমি তারস্বরে চিৎকার করতে থাকল। কাঁদতে কাঁদতে কন্যা আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। সরে আসতে চাইলাম। প্রাণপণে সাঁতার কাটতে লাগলাম। কিন্তু সেই হাত আর আমার দূরত্ব কিছুতেই কমছে না। টমিকে নিয়ে সাঁতার কাটতে কষ্ট হচ্ছিল। তাকে ছুঁড়ে দিলাম। আর দরিয়াবালা ছোঁ মেরে ধরে নিল। তারপর ডুব দিয়ে কোথায় যেন চলে গেল। আমার মনে হলো কে জানি আমার পা ধরে টানছে। আমি সর্বশক্তিতে সাঁতার কাটতে লাগলাম। কিন্তু দরিয়া কোথায়, কোথায়ইবা পানি। খটখটে শুকনো মাঠে আমি সাঁতার কাটার চেষ্টা করছি। তখনো দিনের আলো খানিকটা বাকি। আমি এক দৌড়ে বাড়ি চলে এলাম। এরপর আর কিছু মনে নেই। একটা সময় দেখলাম আমি শুয়ে আছি আর সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি কোনোমতে জানতে চাইলাম টমি কোথায়। কে একজন বলল যে সে শেষবার টমিকে আমার সাথে দরিয়াভাল্লার মাঠের দিকে যেতে দেখেছে। সেদিন রাতে আমার প্রচণ্ড জ্বর এলো। আকাশ-পাতাল এক করা জ্বর। বেশ কিছুদিন এই জ্বর থাকল। চোখ বন্ধ করলেই আমি আবছা আবছা দেখতে পেতাম দরিয়াবালা আমার দিকে তাকিয়ে কাঁদছে আর একটু একটু করে এগিয়ে আসছে। আমার খুব ভয় লাগত। তাই আমি চোখ বন্ধ করতে চাইতাম না। মাঝে মাঝে দরিয়াবালাকে দেখতে ইচ্ছে করত। তখন চোখ বন্ধ করতাম। অনেক দিন দরিয়াবালা আমাকে ছাড়ে না। এক সময় আমি এসব কথা ভুলে যাই। দরিয়াবালাও আমার কথা ভুলে যায়। হয়তো আর কখনোই মনে পড়ত না। কিন্তু একদিন জাপটা আমাকে তার কথা মনে করিয়ে দেয়।
৩.৩ জাপটা
জাপটার আসল নাম জাফর। আমাদের বাড়িতে থাকত আর গরু-গোতান দেখাশোনা করত। অন্যান্য ছোটোখাটো কাজও করত। এই জাপটা নাম আমারই দেয়া, এমনিই। পরে দেখলাম সবাই তাকে জাপটা বলেই ডাকে। সমবয়েসি হওয়ায় তার সাথে আমার গলায় গলায় খাতির। আমরা দুজনেই তখন টিনেজার। এই বিষয়ে সেই বিষয়ে অনেক অনেক কৌতূহল। একদিন আমাকে নীল কভারের একটা বই এনে দিল। বইয়ের ভেতরে সব বড়োদের গোপন কাজকর্মের কাহিনি। আর মাঝে মাঝে সেসব কাজকর্মের ছবি। আমি এসব পড়ে পড়ে শোনাতাম আর জাপটার কাছ থেকে কিছু টু-পাইস আদায় করতাম। এতবার শুনিয়েছিলাম যে আমার সব মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। বিপত্তি হলো একদিন যখন ছোটোকাকা এই বই আবিষ্কার করে ফেলল আর জাপটাকে ধরে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হলো। জাপটা খুব নিষ্পাপ চেহারা নিয়ে বলে দিল যে এই নীল বই আমার। আমি তাকে রাখতে দিয়েছি। একসাথে সবগুলো চোখ আমার দিকে ফিরল আর আমি লজ্জায় মাটির যত নিচে গেলে পাতাল পাওয়া যায় তারও নিচে নেমে গেলাম। কেউ আমাকে কিছু বলল না। তবুও আমি আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারছিলাম না। ঠিক তখনই আমার দরিয়াবালার কথা মনে পড়ে। তাকে দেখতে ইচ্ছে হয়। আমি জাপটাকে গিয়ে দরিয়াবালার কথা বললাম। আমি বললাম তার রূপের কথা। তার দেহের প্রতিটা অঙ্গের বর্ণনা দিলাম। তারপর বললাম কীভাবে একদিন তার সাথে আমার দেখা হয়ে গিয়েছিল। কিভাবে আমায় জড়িয়ে ধরেছিল। আরও আরও অনেক কিছু।
বিপত্তি হলো একদিন যখন ছোটোকাকা এই বই আবিষ্কার করে ফেলল আর জাপটাকে ধরে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হলো। জাপটা খুব নিষ্পাপ চেহারা নিয়ে বলে দিল যে এই নীল বই আমার। আমি তাকে রাখতে দিয়েছি। একসাথে সবগুলো চোখ আমার দিকে ফিরল আর আমি লজ্জায় মাটির যত নিচে গেলে পাতাল পাওয়া যায় তারও নিচে নেমে গেলাম।
মোটামুটি ওই নীল বইয়ের একটা কাহিনি দাঁড় করালাম। সেই কাহিনি শুনে জাপটার চোখ চকচক করে উঠল। আমাকে বলল সে দরিয়াভাল্লার মাঠে যেতে চায়। আমি সেদিন রাতেই তাকে নিয়ে গেলাম। জাপটা আগে আগে যাচ্ছে আর তিন ব্যাটারির একটা টর্চ নিয়ে আমি পেছনে। আমরা দুজন মাঠের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ালাম। একটু পরেই পানি উঠতে শুরু করল। কোমর পর্যন্ত পানি উঠতেই জাপটা পেছন ফিরে দৌড় দেয়ার চেষ্টা করল। আমি ওকে ধরে ফেললাম। ঠিক তখনই বিয়ের সাজে দরিয়াবালা উঠে এলো। আর কাঁদতে কাঁদতে আমাদের দিকে আসতে লাগল। আমি জাপটার কানে ফিসিফিস করে বললাম, যা, এই সুযোগ, যা! জাপটার শরীর যেন অবশ হয়ে গেল। আমি পিছিয়ে যেতে যেতে দেখলাম দরিয়াবালা জাপটাকে নিয়ে পানির নিচে তলিয়ে যাচ্ছে। আমি কোনোরকমে বাড়ির কাছাকাছি গিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলাম। জ্ঞান ফিরতেই সবাই জানতে চাইল কী হয়েছে। আমি সব খুলে বললাম। বললাম কীভাবে জাপটা আমাকে দরিয়াভাল্লার মাঠে নিয়ে গিয়েছিল। কীভাবে দরিয়াবালা উঠে এলো আর আমি কোনোরকমে পালিয়ে এলাম। সবাই ভয় নিয়ে শুনল। শুধু বিন্তির মাঝে কোনো ভয় দেখলাম না। সে কেমন সন্দেহের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল।
৩.৪ বিন্তি
বিন্তিকে আমরা ডাকতাম খুন্তি। আমাদেরই গ্রামের রমেশ জেঠুর মেয়ে। প্রায়ই আমাদের বাড়িতে আসত আর আমরা একসাথে খেলতাম। বড়ো হতে হতে বিন্তি আমাদের সাথে খেলা বাদ দিয়ে বড়ো আপুদের সাথে জুটে গেল। বিন্তিকে আমার বেশ মনে ধরেছিল। শ্যামলা গায়ের রং, বড়ো বড়ো চোখ আর ঘন চুল নিয়ে যখন সামনে দিয়ে হেঁটে যেত আমার কেমন জানি লাগত। অনেকবার ইনিয়ে বিনিয়ে অনেক কিছু বলতে চেয়েছি, সে বোঝেনি নাকি বুঝেও না বোঝার ভান করেছে কে জানে। এক রাতেরবেলা আমি দোকান থেকে কেরোসিন আর মশার কয়েল নিয়ে ফিরছিলাম। রমেশ জেঠুর বাড়ির পাশ দিয়ে যেতেই সামনের বাঁশ ঝাড় থেকে কেমন একটা খসখস আওয়াজ এলো। আমি ভাবলাম শিয়াল। টর্চ মারতেই দেখলাম ঝাড় হতে কে একজন বেরিয়ে খেতের দিকে নেমে গেল। আর একজন মুখ ঢেকে বাড়ির দিকে চলে যাচ্ছে। মুখ ঢাকার আগে আমি চেহারাটা একটুর জন্য দেখতে পেলাম। মুহূর্তেই আমার পায়ের নিচের মাটি সরে গেল। নিদারুণ এক কষ্ট নিয়ে বাড়ি এলাম। সারা রাত দুই চোখ এক করতে পারলাম না। পরদিন দুপুরে ভাত খেয়ে পুকুরে হাত ধুতে গেলাম। পুকুর ঘাটে বিন্তি দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখেই এগিয়ে এসে বলল যে কথা আছে। আমি জানতাম সে কী বলবে। আমি বললাম যে আমি কাউকে কিছুই বলব না যদি সে আমার সাথে দরিয়াভাল্লার মাঠে যায়। সে রাজি হলো। সেদিন সন্ধ্যায় আমরা চুপিচুপি বেরিয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণ পরেই আমি ফিরে এলাম। রাতে রমেশ জেঠু এলো বিন্তির খোঁজে। কেউ কিছু বলতে পারল না। আমি বললাম যে বিন্তিকে আমি কে একজনের সাথে দরিয়াভাল্লার মাঠের দিকে যেতে দেখেছি। রমেশ জেঠু হাঁ হয়ে তাকিয়ে রইল। বাইরে তখন একটা একটু করে বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে শুরু করেছে।
অরণী ঝাঁঝালো গলায় বলল, যাও তোমাকে মুক্তি দিয়ে দিলাম, এবার খুশি? আমার খুশি হওয়া উচিত কি না বুঝতে পারলাম না। আমি তো ওর কাছ থেকে মুক্তিই চেয়েছিলাম। তবুও আমার মন খারাপ হলো খুব, শ্বাস বন্ধ হয়ে এলো। মনে হলো আমি কোনো এক অন্ধকার কূপে তলিয়ে যাচ্ছি। তলিয়ে যেতে যেতে মনে পড়ল দরিয়াবালার কথা।
৪.১ বৃষ্টি
বাস থেকে যখন নামলাম তখন প্রচণ্ড বৃষ্টি। ভিজে ভিজেই আমি সুইসফুডে গেলাম। সেখানে অরণী বসে আছে। আমি যেতেই খিটমিটিয়ে উঠল, এই তোমার পাঁচ মিনিট। আমি হতাশ হলাম। বৃষ্টিতে কাকভেজা একজন মানুষের সাথে এভাবে কথা বলার মানে হয় না। কিছুক্ষণ বসে থেকে আমি মিনমিন করে জিজ্ঞেস করলাম কী খাবে। বলল যে সে কফি খেয়েছে। এই বলে আমার দিকে একটা সুন্দর মেরুন খাম বাড়িয়ে দিল। আমি হাতে নিয়ে খুললাম। ওর বিয়ের কার্ড। একটু হতভম্ব হলাম। অরণী ঝাঁঝালো গলায় বলল, যাও তোমাকে মুক্তি দিয়ে দিলাম, এবার খুশি? আমার খুশি হওয়া উচিত কি না বুঝতে পারলাম না। আমি তো ওর কাছ থেকে মুক্তিই চেয়েছিলাম। তবুও আমার মন খারাপ হলো খুব, শ্বাস বন্ধ হয়ে এলো। মনে হলো আমি কোনো এক অন্ধকার কূপে তলিয়ে যাচ্ছি। তলিয়ে যেতে যেতে মনে পড়ল দরিয়াবালার কথা। মুহূর্তেই উঠে এলাম। বললাম, কনগ্রাচুলেশনস! হ্যাপি ফর ইয়ু। চলো আমরা শেষবারের মতো কোথাও ঘুরতে যাই। সে আমার দিকে তাকাল। দুই চোখ দাবানল হয়ে আছে। যেন আশপাশের সবকিছু এখনই পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। অনেক কষ্টে রাজি করালাম। বাইরে বেরিয়ে জিজ্ঞেস করল, এই বৃষ্টির মধ্যে আমরা কোথায় যাব। রাস্তায় জমে থাকা পানি থেকে কয়েকটা ডেয়ো পিঁপড়া একটা হলুদ পাতায় উঠার প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছিল। আমি পা দিয়ে পাতাটা পিঁপড়ার দিকে ঠেলে দিলাম। তারপর বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বললাম, দরিয়াভাল্লার মাঠে।
জন্ম ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রামে হলেও ফেনীতে বেড়ে উঠা। পড়াশোনা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে। পড়তে ভালোবাসেন। বর্তমানে একটি সরকারি দপ্তরে সহকারী পরিচালক হিসেবে কর্মরত আছেন।