রাতে বিনি ওর বুকে আমায় হাত রাখতে দিল। আমি বিনির হাত আমার নিচে রাখলাম। থকথকে ঠাকুমার পাশে শুয়ে অনেকক্ষণ ধরে আমি বিনির বুকে কান পেতে আওয়াজ শুনলাম। মুখস্থ করলাম যাতে এই আওয়াজ কখনো না ভুলি। যাতে প্রতিটা খাদের ধারে দাঁড়িয়ে চোখ বুজলেই শুনতে পাই, ধুক ধুক, ধুক ধুক…
আমি আর বিনি প্রতি সন্ধ্যায় একটাই গান শুনি। মোহাম্মদ রফির ‘এহেসান তেরা হোগা মুঝপর…’। আর মুড়ি খাই একটা একটা করে। ইদানিং মুড়ি আমাদের প্রিয়তম খাবার হয়ে উঠেছে। বিনি বলে, ‘দেখ, খাচ্ছি, খুঁটে খুঁটে’, বলে একটা একটা করে মুড়ি মুখে ভরে। ঠোঁটের দুপাশে সাদা দুটো মুড়ি গুঁজে আমি ড্রাকুলা সাজি। বিনি হাসে। প্রতিদিন আমি ড্রাকুলা সাজি আর বিনি প্রতিটাদিন আমায় দেখে হাসে। মোহাম্মদ রফি শুনতে শুনতে আমরা প্রতি সন্ধ্যায় জীবন খুঁটে খুঁটে খাই। আমাদের এই একটিই নেশা।
রাত বাড়লে বিনির কাজে ডাক পড়ে। আমায় ফেলে আমার ঠাকুমার পাশে গিয়ে বসে থাকে ও সারারাত। দরজায় দাঁড়িয়ে আমি বিনিকে আর আমার ঠাকুমাকে দেখি। চেয়ারে বসে ঢুলতে থাকা বিনির পাশে, বিছানায় শোয়া আমার ঠাকুমাকে ধূসর থকথকে বিশালাকার একদলা কফের মতো দেখায়। দরজার আড়াল থেকে দেখি, বেড সোরের দুর্গন্ধর সাথে বিনির চুলের তেলের গন্ধ মিলেমিশে ঘরটা চিড়িয়াখানা হয়ে আছে। দরজার ফাঁকে দাঁড়ানো আমায় দেখে ফেলে বিনি জিভ ভেংচে দেয়। আমি তাড়াতাড়ি পালিয়ে আসি।
গভীর রাতে আমাদের কুকুরটা মাঝে মাঝে অন্ধকারের ডিম ফাটিয়ে কেঁদে ওঠে। আমার পাশে শোয়া পিসিমনি বিড়বিড় করে বলে, ‘ওই কার আত্মা যায়, হরি-ই-হরি!’
শুয়ে শুয়ে দুহাত তুলে কপালে ঠেকায় পিসিমনি, আর তাঁর হাতের চুড়িরা এর ওর গায়ে ঘুমে লুটিয়ে পড়ে, শব্দ জন্মায়।
দশ বছর বয়সে আমাকে দেখে বড় পিসো বলেছিলেন, ‘বিজু একদিন অনেক বড়ো হবে।’
তারপর মা বাবা মরে গেল। আমাদের বাড়িটা পথের ধারে ‘সে-ই’ থেকে পড়ে আছে। দুদিকে মাঠ। সামনে রাস্তা। পিছনে জঙ্গল। অচেনা মানুষকে যার পরিচয় দিতে গিয়ে পিসি বলে, ‘…ওই বাগান আর কী’। ‘ওই বাগান আর কী’-র পর বিনিদের বাড়ি নয়, ঘর। বিনির মায়ের ব্লাউজে সাতটা সেফটিপিন। বিনির মায়ের উপোস রাখা সখ। বিনির বাবার কোনো ঘরে পরার চটি নেই। শুধু বাইরের চটি। বিনিদের সবকিছুই বাইরের। ঘরের ধুলো, আয়নার মেরুন টিপ, বাল্বের ঝুল। সবকিছু বাইরের। সমস্ত বাইরেটা বিনিদের ঘরের মধ্যে একটা হাতির মতো ঢুকে বসে আছে। বিনিদের ভিতরের কিছু নেই আর। উদোম। বিনিদের ঘরে সবচেয়ে দামি হলো প্লাস্টিকের প্যাকেট। প্লাস্টিকের প্যাকেট পৃথিবীর সমস্ত কিছুর প্রতিনিধিত্ব করতে পারে বলে বিনিরা বিশ্বাস করে। বিনিদের জীবনে রাবার ব্যান্ডের ভূমিকাও গুরুতর। আর খাটে যাতে পিঁপড়ে না হয় সেই বিষয়ে বিনিরা খুব সচেতন। তাই বিনির মা আমাদের বিস্কুট খেতে দিলে আমরা বিস্কুট হাতে ঘরের বাইরে বেরিয়ে যাই। যে কেউ চলে এলে, যেকোনো কেউ চলে এলে বিনি ওর বাবার হালকা গোলাপি গামছাটা গলায় দেয়। আমি এলে দেয় না। কারণ, ছোটোবেলায় আমরা একসাথে হিসিও করেছি, খেলার ফাঁকে, ‘ওই বাগান আর কী’-তে, গাছের আড়ালে। তাই আমাদের একটা ‘হিসিগাছ’ ছিল। আমি বিনিকে, বিনিদের এমন জানি যে, কোন কোন বার বিনির মায়ের উপোস চলে, তা আমার জানা। বিনিদের প্রতিটা ছাগলের বাচ্চার নাম আমি দিয়েছি। আমি জানি— বিনির হাতের পাতা, যত বয়স বাড়ছে তত খসখসে হয়ে যাচ্ছে। আমি ভয় পাই। আমি বিনির হাত চেপে ধরি। বিনিও উল্টে আমার হাতে চাপ দেয়। এত জোরে আমরা নিজেদের হাত চেপে ধরে থাকি যে ছেড়ে দেওয়ার পর হাতে আঙুলের লাল দাগ তৈরি হয়। আমি আর বিনি সেই দাগের উবে যাওয়া দেখি। উবে যাওয়া দেখে বিনি বলে দেয়, ‘আমরা আমাদের ভুলে যাবো’, বিনি গুনগুন গায়, ‘উও বহতে হ্যায় তো বহনে দো’। আমি শুনি। আমি সব শুনি। আমাদের কুকুরটা মাঝরাতে কেঁদে ওঠে। পিসি কপালে হাত ঠেকায়। ঠাকুমার মুখ থেকে দুর্বোধ্য সব আওয়াজ বেরিয়ে আসে। তাঁকে দেখিয়ে আমি বিনিকে বলি, ‘দেখ, এলিয়ানদের সাথে কথা বলছে’। বিনি আমায় মুখ ভেংচায় আর নাক টিপে দিয়ে বলে, ‘এই হনুমান কলা খাবি?’
কুকুরটাকে একটা লরি চাপা দিয়ে গেছে গতরাতে। আমরা কাঁদলাম একটু। বড়ো পিসেমশাই দুপুরে কিছু খাননি। আমি আর বিনি মিলে হিসিগাছের নিচে কুকুরটাকে পুঁতে দিয়ে এলাম। বিনির মা আমাদের দুজনকে দুটো গজা খেতে দিয়ে বললেন, ‘খাটে না।’ গজা হাতে আমরা সারাদিন কুকুরটার সাথে থেকে গেলাম। সন্ধ্যায় আবার মোহাম্মদ রফি। রাতে আমার ঠাকুমা। বিনি বলল, ‘তোর ঠাকুমাও একদিন…’ আমি মাথা নাড়ালাম, বললাম, ‘আমরাও একদিন…’
রাতে বিনি ওর বুকে আমায় হাত রাখতে দিল। আমি বিনির হাত আমার নিচে রাখলাম। থকথকে ঠাকুমার পাশে শুয়ে অনেকক্ষণ ধরে আমি বিনির বুকে কান পেতে আওয়াজ শুনলাম। মুখস্থ করলাম যাতে এই আওয়াজ কখনো না ভুলি। যাতে প্রতিটা খাদের ধারে দাঁড়িয়ে চোখ বুজলেই শুনতে পাই, ধুক ধুক, ধুক ধুক…
আমরা কদিন খুব মালবোঝাই লরির উপর চোখ রাখলাম। খালাসিদের চোখ রাঙালাম। খোঁজ খবর করা হলো এদিক ওদিক। তারপর আবার আমাদের মুড়ি খাওয়া। আবার আমাদের, ‘চাহে বনা দো, চাহে মিটা দো’। যখন বিনিকে পুরোটা জানা গেছে মনে করেছি তখনই বিনির হাসি বদলে গেল। চোখের সামনে বিনির দৃষ্টি পালটে গেল। এমনকি বিনির গায়ের গন্ধও। আমার দিকে তাকিয়ে আমাকে না, সে অনেক দূরের কিছু দেখছে। আমাকে ছাড়িয়ে যেন সে চলে গেছে অনন্তে, উলের গোলা যেমন উল খুলে রেখে যেদিকে দুচোখ— গড়িয়ে যায়।
আজ সন্ধ্যায় বিনি আলাপ করিয়ে দিল দীপকের সাথে, লরির খালাসি। চোখের পাশে চামড়া কুঁচকে গেছে অল্প বয়সেই। হাসলে লাল লাল দাঁত দেখা যায়। পানমশলার নেশা করে। ছোটো মোবাইল ফোন রাখে তীব্র গোলাপি রঙের শার্টের বুকপকেটে। ফোন এলে তাতে বাজে ‘এক দো তিন’ এর সুর। বিনির মাকে নালিশ করতে গিয়ে দেখি বিনির মা গুনগুন করছেন, ‘পথে এবার নামো সাথী…’। বিনির বাবা খাটে খাবার খাওয়ার মতো যত্ন করে বসে বিড়ি খাচ্ছেন। বিড়িতে কোনো পিঁপড়ের ভয় নেই। বাড়ি ফেরার পথে দেখলাম হিসিগাছের নিচে বিনি দীপককে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওরা কুকুরের কবর দেখছে মন দিয়ে। ইচ্ছে হলো বিনির কাঁধ ধরে জোরে জোরে ঝাঁকাই, বা ধাক্কা মারি। বা ঠেলে ফেলেই দিই একেবারে। বড়োপিসেমশাই একদিন অফিস থেকে ফিরে বাসস্টপের পাগলির গল্প করেছিলেন। পাগলিটা দাঁড়িয়েছিল স্টপের ছায়ার তলায়। বাকি মানুষেরা কেউ ছায়ায় আসছিল না ভয়ে। বড় পিসেমশাই আপন খেয়ালে ছায়াতে এসে দাঁড়ালেন। একটু পরে দুম করে ধাক্কা দিয়ে তাঁকে ছায়া থেকে বাইরে বের করে দিল পাগলিটা। ছায়ার মতো আমি ঘরে ফিরলাম। বিনি ঠাকুমাকে দেখার কাজ ছেড়ে দিল আজকে। ঠাকুমার ঘর থেকে আজ আমি মিস্টার বিনের গলার আওয়াজ পাচ্ছি।
মরে গিয়ে আমাদের কুকুরটা ডাকে না আর। মাঝরাতে কাঁদেও না। পিসির চুড়িগুলো শান্তিতে ঘুমোচ্ছে। মোহাম্মদ রফি শুধু আমার মাথার ভিতর আটকে গিয়ে অটিস্টিক বাচ্চার মতো ঘুরে ফিরে বলেই চলেছেন ‘আঁশুকা হামারে গম না করো’, থামছেন না। বিনি, আমার বিনি লরি করে আমায় রেখে অনন্তে চলে যাচ্ছে। অনন্তের ড্রাইভার দীপক তার ডান হাতের কনুই জানালার উপর রেখে লরি অনন্তে চালিয়ে দিচ্ছে। লরির পিঠ থেকে অসংখ্য মুড়ি রাস্তায় পড়ে পড়ে তা তা থৈ থৈ তা তা থৈ থৈ…
স্যাঁতস্যাঁতে বিছানায় শুয়ে কুকুরের কান্না বেরিয়ে আসে আমার বুক থেকে, পাশ থেকে পিসি ঘুমের ঘোরে বলেন, ‘ওই কার আত্মা যায়…’
কোলকাতায় জন্ম। পেশাগত কারণে বাস ব্যাঙ্গালোরে। দশটা-আটটায় তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী। নিশাচর অক্ষরশ্রমিক। প্রকাশিত বই : ঝিঁঝিরা (২০১৫), হাওয়াশহরের উপকথা (২০১৮), দাস্তানগো (২০১৯) এবং রণ বিশ্বাস কারো নাম নয় (২০১৯)।