চারদিক অন্ধকারাচ্ছন্ন। হত্যা, মৃত্যু, ধর্ষণের যেন মহামারি লেগেছে। আত্মহত্যা বেড়েছে কয়েকগুণ। পুঁজিবাদের ধর্মই রক্ত দিয়ে হোলি খেলা। সেটাই হচ্ছে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায়। নারীর প্রতি অসহনশীলতা বেড়েছে। কোথাও কোনো স্বস্তির নিশ্বাস নেই। এমন এক ঘোর অন্ধকারাচ্ছন্ন মুহূর্তে পড়ে শেষ করলাম ‘অচিন আলোকুমার ও নগণ্য মানবী’ গ্রন্থটি। লিখেছেন কথাসাহিত্যিক আকিমুন রহমান। বাংলাভাষার একজন শিল্পসৃষ্টিতে নিবিড় নিবেদিত লেখক। যার কোনো গ্রুপিং-লবিংয়ের দরকার হয়নি। তিনি লিখছেন নিজের চিন্তার তাগিদে, অপরকে সমৃদ্ধ করার তীব্র বাসনা থেকে।
একজন সামান্য নারীর জীবনচরিতকে মলাটবদ্ধে তুলে ধরেছেন তিনি। যেখানে মরিয়ম জাহানের অবস্থা আর আমাদের অবস্থার খুব বেশি ফারাক নেই। যা রয়েছে চিন্তার— তার হিসাব এ মুহূর্তে না কষলেও চলবে।
এটি এমন এক গ্রন্থ যেখানে আপনি ‘আপনাকে’ খুঁজে পেয়ে স্তব্ধ হয়ে যদি আকাশপানে তাকিয়ে থাকেন; তাতে দোষের কিছু নেই। মরিয়ম হুসনা জাহানের জায়গায় যদি ‘নিজেকে’ খুঁজে ফেরেন এবং খোঁজাটাই হয়তো স্বাভাবিক। একজন সামান্য নারীর জীবনচরিতকে মলাটবদ্ধে তুলে ধরেছেন তিনি। যেখানে মরিয়ম জাহানের অবস্থা আর আমাদের অবস্থার খুব বেশি ফারাক নেই। যা রয়েছে চিন্তার— তার হিসাব এ মুহূর্তে না কষলেও চলবে।
মরিয়ম হুসনা জাহান চরিত্রকে টেনে নিয়েছেন। একই সঙ্গে রয়েছে আলো ছড়ানোর গল্প। যেখানে এনে দাঁড় করিয়েছেন আলোকুমারকে। অচিন এক দেশের এক অভিনব চরিত্র। কল্পনাশক্তি কতটা প্রখর, ধীসম্পন্ন হলে পাশাপাশি দুটি চরিত্রকে টেনে ১৭৫ পৃষ্ঠাঅব্দি নিয়ে যাওয়া সম্ভব! এরপর সেই বইটি পড়ে আবার কেউ লিখতে বসেছে; নিজেরই অবস্থান খুঁজে ফিরছি লেখার ভেতরে। সত্যিই বিস্ময়কর!
পরিবার, রাষ্ট্র, সমাজের হাজারটা বিধি-নিষেধ, রীতিনীতি নারীর চলার পথকে করে তোলে বিষাক্ত, কণ্টকাকীর্ণ। ক্লিষ্ট, ধুকন্ত; বেঁচে থাকাটাই যেন দায় হয়ে যায়! আর কত লাঞ্ছনা, নিপীড়নের বোঝা বহন করে চলবে মরিয়ম হুসনা জাহানরা? আর কত গল্প তৈরি হবে জীবনের খাতায়; এসব ভাবনার জগতে আলোর দিশারী হয়ে এসেছে ‘অচিন আলোকুমার ও নগণ্য মানবী’।
১৯৯৫ সাল। একজন নারীর বেড়ে ওঠা গল্প। তার একটি নিজস্ব বাড়ি রয়েছে। চালচুলোর বন্দোবস্ত রয়েছে। পড়াশুনার সুযোগ রয়েছে। তবুও যেন কী নেই! খা খা করার গল্প। যেখানে নেই একে-অপরকে জাবড়ে-জুবড়ে থাকার গল্প। একই ছাদের নিচে, নিকটাত্মীর সঙ্গে বসবাস করেও একার গান গেয়ে চলার গল্প। বিচ্ছিন্ন, অনাত্মীয় এক পরিবেশের কথা।
উত্তরাধিকারসূত্রে চারতলা একটি বাড়িতে বেড়ে উঠা। পুরনো, জরাজীর্ণ পরিবেশ। তবুও নিজ কামরা। দিন শেষে নিজ ঘরে ফেরার রয়েছে নিশ্চয়তা। একেবারে অসহায়ত্ব অবস্থা নয়; তবুও কেন এত খা খা করার হৃদয়ের গল্পে ভরপুর গ্রন্থটি!
অল্পতেই জুটেছিল একটি চাকরি। হোক না স্বল্পবেতনের! তবুও তো নিজ চলার মতো শক্তি অর্জন করেছিল। চাকরি আর ঘরে ফেরা; এটাই যেন জীবন! চাকরি, ঘর থাকাসত্ত্বেও মেয়েটির বারবার মনে হয় এসব না থাকাটাই যেন ভালো হতো। তাহলে জীবনের একটা অনিশ্চয়তার ধাক্কা থাকত। জীবনের মানেটা তখনই তো উপলব্ধি করা যেত!
খাওয়া-পরা, ঘুম-জেগে ওঠা সবকিছু নিয়মিত হচ্ছে। তবুও যেন কী নেই, কী নেই! বাসায় বাইরে যায়, আবার ফিরে, আবারও একই কাজ। নিত্যদিন একই কাজ করতে করতে পুরো বিষাদগ্রস্ত হয়ে উঠছে জীবনের মানে। কখনও রাতভর ঘুম, কখনও রাতভর জেগে থাকে। রাতেও আসে না ঘুম, আবার দিনেও বুজে না চোখ। এ যেন এক জটিল রসায়ন। এভাবেই পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠায় নারীর জীবনচরিতকে এঁকেছেন লেখক।
পড়তে গিয়ে ধাক্কা লাগে; কিন্তু সেটি জীবনের ধাক্কা। ঘোরলাগার ধাক্কা। কখনও কোনোকিছু না পাওয়ার দ্বন্দ্ব আবার কখনও কতকিছুই তো পাওয়ার ছিল বলে হাহাকার।
মেয়েটি ডায়েরি লেখা শুরু করে। মনের কথা। অজানা কথা। না-বোঝা কথা। কখনও মনের কথা লিখতে ইচ্ছা করে, কখনও না। আবার নিজমনেই বিড়বিড় করে বলতে থাকে, ‘আমি আবার কেউ না কি যার আবার লেখার ইচ্ছা জাগে…’! এ এক আশ্চর্য যন্ত্রণা। যা কুড়েকুড়ে খাচ্ছে প্রতিনিয়ত। যেখানেই খুঁজে ফিরি আমাদের অনুভূতিগুলোকে।
কলেজে চলছে রাজনীতি। শিক্ষক হিসেবে মেয়েটি জুনিয়র। তবুও রয়েছে সম্মান, খ্যাতি। এ নিয়ে সিনিয়রদের চক্ষূশূল। ছুটির দিনেও কলেজ করার চাপ। ছাত্রী বাড়ানোর চাপ। এসব লিখে ডায়েরির পাতা। দিনলিপি। লিখেন বাবার সরকারি চাকরি জীবনের কথা। মা মারা যাওয়ার যন্ত্রণা। লেখা চলছে। জীবনের কথা। হারানোর ব্যথা, না পাওয়ার হিসাব কষছে। এভাবেই চরিত্র চিত্রায়ন করেছেন লেখক আকিমুন রহমান।
১লা এপ্রিল ১৯৯৫ সালের ভাবনা থেকে লেখক তুলে ধরেছেন ‘আমার কিন্তু আজকাল একটা কথা খুব বিশ্বাস হয়। বিশ্বাস হয় যে, এই যে আকাশের সন্ধ্যা দেখে আজকাল আমার এমন মন উতলা লাগে; এর সঙ্গে ওই মোরাকাবা করার একটা সম্পর্ক আছে। ভাইবোনদের কোনোজনকে এই বিষয়ে আমি কিছু বলি নাই, কিন্তু নিজের মনের একটা বুঝ আছে তো!’
সেই বুঝ আমারে বলছে, এই দুইয়ের একটা কিছু সম্পর্ক থাকলে থাকতেও পারে!
কই, আগেও তো কতো সন্ধ্যার দিকে তাকায়েছি! কম-বেশি তাকাই না কি বিকাল বা সন্ধ্যার দিকে? তাকিয়েছি! কিন্তু সেইসব সন্ধ্যাকে তো কোনোদিন চোখে পড়ে নাই। এখন এমন গভীর কেমন চোখে পড়ছে?’ এভাবেই দেখার গভীরতা বাড়ে, জীবনের রঙগুলো গভীর হয়ে পড়ে। জীবনের অর্থগুলো ফ্যাকাশে হয়ে পড়ে।
একজন বাবাহারা নারীর কথা যেভাবে লেখক লিখেছেন ‘আব্বা মারা যাওয়ার পর থেকেই আমি আর আমি নাই! আমি হয়ে গেছি তুফানে আছড়ানী খেতে থাকা একটা গাছ! কাহিলের কাহিল, মরমর এক গাছ! আহ! আমার ওপর দিয়ে ভয়ানক বজ্জাত-কী এক তুফান যে যাচ্ছে।…’ লাইনগুলো আর কাউকে কতটা ভাবিত করেছে, সেটি বলা মুশকিল; কিন্তু আমার চিন্তাকে শক্তিশালী একটা নাড়া দিয়েছে। বটবৃক্ষের ছায়া যে কতটা দরকার সেটির বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে লাইনগুলোতে।
পড়ছি। এগুচ্ছি। পৃষ্ঠাগুলো যেন দ্রুতই শেষ হচ্ছে। কাহিনির গতি আগাচ্ছে। আঞ্চলিকতার টান রয়েছে; কিন্তু নেই বাড়তি বাহানা। উঠতি শব্দের আনাগোনা। শুধুমাত্র ভারী করার জন্য উটকো শব্দের ঝনঝনানিও নেই। যা আপনাকে গতিরুব্ধ করতে পারবে। টেনে নিয়ে যাবে, এরপর কী?
গ্রন্থটি পড়তে গিয়ে বারবার মনে হয়েছে, আচ্ছা উপন্যাসের কথা লিখতে গিয়ে কী আরেকটা উপন্যাস তৈরি করা যায়! হয়তো, সে রকম কোনো শক্তি কারো থাকতেই পারে। কিন্তু এটা পড়ে বারবার চিন্তায় সে কথাটিই বাড়ি দিচ্ছিল। উপন্যাসের প্লট তৈরি হচ্ছিল। কিন্তু জীবনটাই সম্ভবত একটা উপন্যাসের প্লট!
এরপর অনেকগুলো দিন কেটে যায়। বহু ঘটনার ইতিহাস সৃষ্টি হয়। ৮ এপ্রিল ১৯৯৫। সেসময়ও লেখক ভাবছেন। লিখছেন। সন্ধ্যার যে অপরূপ সৌন্দর্য আকাশে ছড়িয়ে থাকে, তার রূপবৈচিত্র্যের কথা লিখে। অনেক ইচ্ছার কথা লিখে। শুধু লিখে। আর ভাবে কী হবে ছাইপাশ লিখে! দুনিয়ার কাজ রেখে শুধু লেখা, চাকরি টিকবে তো! এই তো বুঝি জীবনের জয়গান। নিজের কথাগুলো লিখছেন অন্যকাউকে সামনে দাঁড় করিয়ে। খুব দুঃসাধ্য কাজ।
এরপর একের পর এক আশ্চর্যকর ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। কলেজের অনুষ্ঠান। এটিকে সফল করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা। তবুও সিনিয়রদের মন না ভরার গল্প। অনেক ঝড়-ঝঞ্জা পেরিয়ে প্রোগ্রামের জন্য ফুল সংগ্রহ করা। এরপরও ম্যাডামরা যেভাবে হেনস্তা করে তার বর্ণনা ‘প্রোগ্রামটা নষ্ট হউক, এই প্ল্যান করছিলা নাকি মরিয়ম। নাইলে সকাল নয়টার ফুল দশটায় আনো কি কইরা?
এরপর একের পর এক আশ্চর্যকর ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। কলেজের অনুষ্ঠান। এটিকে সফল করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা। তবুও সিনিয়রদের মন না ভরার গল্প। অনেক ঝড়-ঝঞ্জা পেরিয়ে প্রোগ্রামের জন্য ফুল সংগ্রহ করা। এরপরও ম্যাডামরা যেভাবে হেনস্তা করে তার বর্ণনা ‘প্রোগ্রামটা নষ্ট হউক, এই প্ল্যান করছিলা নাকি মরিয়ম। নাইলে সকাল নয়টার ফুল দশটায় আনো কি কইরা? সাদেকা আমারে বুঝাইতে বাকি রাখে নাই!’ বারবার মরিয়ম বোঝাতে চায়, কিন্তু কোনই বুঝই ম্যাডামদের সন্তুষ্ট করে না। এটাই ব্যবস্থাপনা। আমলতান্ত্রিক জটিলতা, যেখানে নরমের জম, শক্তের ভক্ত। এরপর শোকজের হুমকি! এরপরও স্বাভাবিকভাবে পুরো দিনটা কাটিয়ে দেওয়ার যে কী যন্ত্রণা! নিজের জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে নিন, খুঁজে পাবেন আপনারই সঙ্গে ঘটে যাওয়া কোনো চিত্র।
ডায়েরির পাতা ভরছে, ‘দুনিয়াতে আমার মায়া করে-এমন তো কেউ নাই। দুনিয়াতে আমার জন্য মন খারাপ করে-এমনও কেউ নাই!
এই দুনিয়ায় কেউ একজনও নাই, যে কিনা আমার জন্য অপেক্ষা করে। সেই আমি দুনিয়া থেকে চলে গেলেই কী, থাকলেই কী!’ এই যে এভাবেই তাজা প্রাণগুলো ঝরে যাচ্ছে। এ কটা লাইন পড়ে জাস্ট এ অনুভূতিটাই কাজ করছে। ১৯৯৫ সালেও একজন নারীর, একজন মানুষের এরকম একা থাকার যন্ত্রণা কষ্ট দিত, হতাশ করত; জীবনের মায়াত্যাগ করতে উৎসাহিত করত।
হতাশার মাপকাঠিতে কখনও আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠার গল্প বলতেও ছাড়েননি তিনি। যেখানে অন্ধকার থাকে, সেখানে আলোও দৃশ্যমান থাকে। এটাই এ উপন্যাসের সার্থকতা। শুধুমাত্র হতাশার জয়গান গেয়ে, দিশাহীনকে পথ না দেখিয়ে সমাপ্ত টানাটা দায়হীনতার কাজ। সেটি কথাসাহিত্যিক আকিমুন রহমান করতে পারেননি, তিনি দেখিয়েছেন ‘এমন যখন খুবই আত্মবিশ্বাসী আমি এবং সাফল্যের সুখে খানিকটা অন্যমনস্কও আমি; তখন আচমকাই আমার মনিটরে কিছু কিম্ভূত রেখা দেখা দিতে থাকে! একটা কেমন কিম্ভূত শব্দও শুনতে পেতে থাকি আমি! এমন বিকট শব্দ কেনো করে উঠবে আমার যন্ত্র?’
এরপর তিনি লেখেন ‘আমি ইচ্ছারশ্মি পাঠিয়েছিলাম পৃথিবীর বস্তুরাশি থেকে উপাত্ত সংগ্রহ করতে। বুদ্ধিমান প্রাণীরা আমার লক্ষ্য ছিলো না মোটেও। কিন্তু ঘটনাচক্রে আপনি আক্রান্ত হয়ে পড়েন তখন, মরিয়ম হুসনা জাহান!’
এরপর আলোকুমারের আবির্ভাব। হাঁটু মুড়ে বসে আলোকুমার জানায়, ‘আমার একটা বাসনা ছিলো, মরিয়ম হুসনা জাহান!’ … ‘বাসনা ছিলো-ওই দুই হাতে-এই মুখটাকে গুঁজে রাখবো একটুক্ষণ! দেবেন রাখতে? একটুখানি?’
মরিয়ম হুসনা জাহানের স্পষ্টই জানায়, মনুষ্য স্পর্শে না কি আপনার ভয়, আপনাকে যখন-তখন কিছুতেই ছুঁতে নেই? তাহলে কেমন করে ছোঁবে আমার এ হাত আপনাকে, আলোকুমার? কী ভাবের বিনিময়। সেটির আবার প্রকাশভঙ্গি কী চমৎকার! বিমুগ্ধ হয়ে পড়ছি। প্রেমেরও ধরন আছে। রঙ আছে। পাল্টায়, নিত্যনতুন পাল্টায়। এরকম উপলব্ধি থেকেই আগাচ্ছি।
মরিয়ম অস্থির হয়ে উঠুন। কথাগুলো বলার পর থেকে তা ভেতরে অগ্নির স্পর্শের যে অনুভূতি সেটি উপলব্ধি করতে থাকে। আলোকুমার আবারও কাকুতির স্বরে, বদলে যেতে হবে আমাকে। বদলে যাওয়ার আনন্দ আলাদা। তার রূপ-রস ভিন্ন। শুধু স্পর্শ। দুহাতের স্পর্শ। একবার শুধু চাই। একবার শুধু স্পর্শের অনুভূতি নিয়ে মরতে চাই।
মরিয়ম, দুহাতে পেতে দেয়। একটু অভিমানের স্বরে ‘এই তো আমার দু হাতের পাতা! সেইখানে কেউ যদি তার ক্লিষ্ট মুখটাকে গুঁজে দিতে চায়, দিক! না দিলে না দিক!’ এ কিসের আলামত, কিসের এত বেদনাবিধুর কথা! কী এক দুর্বিপাকের মতো ঘটনা! এমনই মোড় ঘোরানো, ঘোর পাকানো এক উপন্যাস ‘অচিন আলোকুমার ও নগণ্য মানবী’।
একজন সামান্য নারীর দগ্ধ হওয়ার গল্প। ক্ষণে ক্ষণে দগ্ধ হওয়ার কথা। অপেক্ষার থাকার যন্ত্রণা। নিজ জীবন সম্পর্কে নিজের নিশ্চয়তার অভাব, ক্লিষ্টতা ধুকন্ত জীবনসংগ্রাম নিয়ে লেখা বইটি শুকিয়ে যাওয়া প্রাণকে আশা জোগায়। বিপন্নতার কালে যেখানে ত্রাসের রাজনীতি বিরাজমান, সেখানে এরকম একটি সাহসী, উদ্যমী বই একমাত্র প্রচারের অভাবে আজ প্রায় অজানা। একজন মানুষ যখন কারো লেখার ভেতরে, নিজেকে খুঁজে ফেরে তখনই সেটার সার্থকতা হয়; সেই অবস্থান থেকে বইটি সার্থক।
“আমার হাতেরা ইতলা অধীর হয়ে অপেক্ষা করছিলো মনুষ্যমুখের পরশ পাবার জন্য। কিন্তু তার বদলে তারা পায় খানিকটা আগুনের স্পর্শ।
খানিকটা পায় ঝুরঝুরে মাটির ছোঁয়া!
খানিকটা পায় পানির ছলাৎ ছল!
ফিনফিনে বাতাসের একটু স্পর্শও পায়।
তার সঙ্গে পায় আকাশের শূন্যতার একটা হিম ঝাপটা!
সেইসব কিছু ক্রমে, ধীরে ধীরে, ঢুকে যেতে থাকে আমার শরীরে ভেতরে। আমি-আমি- বুঝতে পারি, আমার ভেতরের আমিটার সাথে মিশে যাচ্ছে ওরা! আমি হয়ে উঠছি অন্য আরেক আমি! অন্য একজন!
‘আলোকুমার!’ আমার অন্তরাত্মা ডুকরে ওঠে; ‘ফিরে এসো!’ ”
ফিরো এসো বলার মতো দুঃসাহস লেখক দেখিয়েছেন। একজন পাঠক হিসেবে বলছি, ‘ফিরো এসো’ কিংবা ‘ফিরে আসা’ সত্যিই কষ্টদায়ক, যন্ত্রণাদায়ক। আর না আসাটার কথা আজ না-হয় থাক…!
যে প্রিয় পুরুষের স্বপ্ন দেখে নারীপ্রাণ, কিন্তু যার সাথে আমাদের কখনো দেখা হয় না, সেই চিরন্তন পরমই এই উপন্যাসে, আলোকুমার নামে দেখা দিয়েছে।
সে হয়তো হঠাৎ এসে আমাদের সমস্ত সত্তাকে সুধামাধুরী দিয়ে ভরে দিয়ে যায়! তারপর নিরুদ্দেশে যায়।
অথবা সেই চিরন্তন হয়তো কোনোদিনই আসে না আমাদের পৃথিবীতে। শুধু তার স্বপ্ন দেখি আমরা, শুধু নিষ্ফল অপেক্ষা।
তাঁর জন্ম টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী উপজেলার কৃষ্ণপুর গ্রামে। সবুজের মাঝে বেড়ে ওঠা এই লেখক ভালোবাসেন প্রাণ-প্রকৃতি ও মানুষের গল্প বলতে। দীর্ঘদিন ধরে যুক্ত রয়েছেন প্রকাশনাশিল্পে। তিনি বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকা ও অনলাইন মাধ্যমে সাহিত্য ও বই আলোচনা এবং প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখে থাকেন। ইতিমধ্যে যৌথ সম্পাদনায় তাঁর পাঁচটি বই প্রকাশিত হয়েছে।