বৃহস্পতিবার, নভেম্বর ২১

রৌদ্রে-কুসুমে-বিরিক্ষি-পত্রে যেটুকু ব্যথা খচিত হয়ে আছে : আকিমুন রহমান

0

এক. আদিতে এই সরলকথা

এক মেয়ে ছিলো। তার নাম তারামালা। যে-রাতে সে জন্ম নেয়, সে-রাতের আকাশে তখন চাঁদ নেই, সাদা মেঘ নেই, কালো মেঘও নেই। সে-আকাশ ঝকঝকা কালো রাত্রিমাখা। আর সেই আকাশে তখন অযুত নিযুত তারা। ঝিলিমিলি ঝিলিমিলি তারা। সেই তারারা যেনো মালা হয়ে ছড়িয়ে আছে নিকট ও দূরের আকাশে আকাশে। অমন আকাশের নিচে যেই শিশু প্রথম কেঁদে উঠলো, তার নাম তারামালা ছাড়া আর কী হতে পারে! মুরুব্বিরা, তার জন্য, ওই তারামালা নাম ছাড়া অন্য কিছু ভাবতেও পারে না!

ক্রমে দিন ও রাত যায়। তারামালা বেড়ে উঠতে থাকে। বেড়ে ওঠে। বেড়ে ওঠার কালে, সে তার আশপাশে নিজ বয়সি অনেক অনেকজনকে দেখতে পায়, হরদম পায়! কিন্তু এমনই নির্বন্ধ যে, তারা কেউই তার মতো করে, তার সাথে খেলতে আসে না। সেও তাদের সাথে, তাদের মতো করে, খেলতে যাওয়ার পরিস্থিতি পেয়ে ওঠে না। অন্যরা তাকে খেলতে ডাকে ঠিকই! কিন্তু ডাকে ঠিক দুপুরের কালে। তাদের বাড়ির দক্ষিণ সীমানায় যে পুকুর আছে, তার পাশে আছে এক গাবগাছ। দেশি গাবের সেই গাছ দুস্তর ঝাকড়া দুরন্ত ভোমা। সীমাহীন অন্ধকারে নিশপিশে, ঘুটঘুট্টি তার পাতা ডালভরা শরীর। অন্য পোলাপানেরা, ঠিক দুপুরের বেলা, তারামালাকে ওই গাছে চড়ে দোল খাওয়ার জন্য ডাকে।

‘আইয়ো তারামালা! আমরা বুইড়া গাবগাছে উইট্টা দুলকি খাই গা! দুলকি খাইতে খাইতে আমরা হগলতে, পুষ্কুনিত ঝম্প দিমু! আহো, আমাগো লগে! তুমিও খেলবা! অন্নেক আমোদ অইবো। আহো!’ তারা তাকে এইমতে ডাক দিতে আসে। আর সেই ডাক, তারামালা শুনে ওঠার আগেই নানু শুনে ফেলে।

‘হায় হায় হায়, পিছা মারার গুষ্টি! দেখছ নি, শুয়োরের পালেরা আমার নাতিনরে কোন অনিষ্টির রাস্তায় নেওনের বেবস্থা করতাছে!’ নানু হাঁক দিতে থাকে। খেঁজি দিতে দিতে পোলাপানগুলারে দৌড়ানি দিতে থাকে।

অমন হুলস্থূলের মধ্যেই হয়তো কোনোরকমে সেই মেয়েটায়, নানুর নাতিন সেই তারামালায়, ওই সেই পোলাপানের ঝাঁকটারে বলে উঠতে পারে, ‘তোমরা আমাগো বাইত থাকো না? উঠানের গাছে দুলনি বাইন্ধা আমরা ঝুলি? থাকো?’ পোলাপানেরা সেই কথার কোনো উত্তর করে না। তারা তারামালার দিকে ফিরেও তাকায় না। ঠান্ডা পায়ে তারা সব কয়জনে, কোন নাই-জায়গায় জানি চলে যেতে থাকে।

এমনে এমনে শুধু খানিকটা সময় বড়োদের পায়ে পায়ে থেকে থেকে, আর বাকিটা সময় একা একা একা গাছগরানের আশপাশে ঘুরে ঘুরে বড়ো হয়ে উঠতে থাকে সে। তখন, চরাচরকে ভালোমতো বুঝে ওঠা দূর, বেশ-খানিকটা করেও চিনে ওঠা হয় না তার।

তাহলে তারামালা আর কী করে! একলা একলা নড়োন-চড়োন্তি দেওন ছাড়া, সেয় আর কী করবো তাইলে! এমনে এমনে শুধু খানিকটা সময় বড়োদের পায়ে পায়ে থেকে থেকে, আর বাকিটা সময় একা একা একা গাছগরানের আশপাশে ঘুরে ঘুরে বড়ো হয়ে উঠতে থাকে সে। তখন, চরাচরকে ভালোমতো বুঝে ওঠা দূর, বেশ-খানিকটা করেও চিনে ওঠা হয় না তার। তখন শুধু দেখে যাওয়া, শুধু ইতিপিতি চোখ ছড়িয়ে রাখা।

তারপর একদিন তার সাত বছর বয়সটা আসে। সেই তখন সে বোধ করতে পারে, সে পেয়ে উঠেছে দুটি উঠান। পেয়ে উঠেছে দুটি বাইরার আঙ্গিনা।

তখন সে সদ্য সদ্য বুঝে ওঠে, তাদের নিজেদের আছে দুই আপন ভিটি। ওই ভিটিরা আছে দূরের দূর—দুই ভিন্ন এলাকায়। কিন্তু তারা আছে। সে তখন তাদের চিনে উঠতে থাকে। অল্প অল্প করে। অল্প-খানিকটা করে করে। জেনে উঠতে থাকে তখন সে, তাদের একটা আঙ্গিনার শেষে আছে আজদাহা এক পুকুর। সেই পুকুরের চারপাশে আছে সুপারির দঙ্গল আর ডাবগাছ। ওটা তার নানাবাড়ির দেশ।

অন্য যে আঙ্গিনাটা, ওটা হু-হু এক ডাক-মেশানো! নিরল শুনশান। সেই আঙ্গিনার শেষে, পুষ্কুনি নেই। হালকা, মিহি জলের টলটলা ছলাৎকার নেই। সেইখানে বাইরার আঙ্গিনার পরে, আছে শুধু ফসলি-মাঠ। দূর থেকে দূর, কেবল কইচ্চা সবুজ, কেবল পক্ব ধানি সবুজ, কেবল লঙ্কা ঝোপে ঝোপে ক্ষুদে সাদা ফুল। তারপর আরো দূরে একটুখানি একফালি সাদা ঝিলিক। বাঁকাআঁকা ঝটকা ঝিলিক। সেই সাদা ঝিলিকখানা ঢাকা আছে ক্ষেতের সবুজে সবুজে। ওটা নদী। দূরের দূর নদী! অতো দূরে ছোটোরা যেতে নেই। ওই নিঝুমের দিকে পাও বাড়নো মাত্র, গুঁড়াগাঁড়া সকলেরে বান-বাতাসে ধরে। খবরদার! ওইদিকে খবরদার না! এমন নিষেধ-মোড়ানো নদী! এইই তার দাদাবাড়ির তল্লাট।

তখন, ওই দুই আপনা-আঙ্গিনা-উঠানের যেদিকে তাকানো যায় শুধু গাছ, শুধু গাছ। তাদের কেউ কেউ উঠে গেছে কোন ওপরে! হয়ে আছে আকাশ ছুঁইছুঁই। তার মাথা বা পাতাশাখা দেখতে চাও? তাহলে ঘাড় উঁচোও। তাকাও ওই উঁচুতে, ওই যে দূর উঁচু! সেইখানে আকাশের আসমানি রঙ হয়তো আছে, কিন্তু এখন সেটা ঢাকা পড়ে আছে সবুজ দিয়ে। সেই সবুজ কেমন সবুজ? বয়স্ক, বাত্তি চালতাপাতার মতন সবুজ তার রঙ। সেই সবুজের কী নাম? ওই সবুজের নাম কইচ্চা! এই গাছেরা দীঘল সরল, কিন্তু স্ফীতকায়। ক্ষুদে দুহাতের বেড় তাকে ঘিরে নিতে পারে নাকি!

অন্য গাছেরা ঝাঁকড়া মাঝারি। তাদের থেকে ছোটো শরীরের গাছও আছে এইখানে, সবখানে। তারা ঝোপ, তারা কখনো ঝাড়; তারা কখনো লতা-গুল্ম। সেইসব গাছ কখনো কখনো পাতা-শাখা নিয়ে বাতাসে বাতাসে দোল খায়। কখনো থির হয়ে থাকে। অগাধ থির। তখন তাদের দেখে মনে হতে থাকে যেনো, নিজেদের শরীরে সমস্তটা খোলা রৌদ্রের আছড়ে-পড়াটা আর তারা সইতে পারছে না। তারা বেবোধা কাহিল হয়ে উঠেছে। কাতরে কাতরে উঠছে তাদের শরীর।

সেইসব ঝাঁকড়া মাঝারি গাছের যে-সবুজ, সে একটু ফিকেরঙা। তার নাম টলকা কইচ্চা। যখন সেই সবুজ, লাউয়ের জাংলায় জাংলায় বিছিয়ে যেতে থাকে, তখন সে ঠলকে-ছলকে অনেকখানি তিরতিরে বরনের হয়ে ওঠে। ওই সবুজের তখন অন্য নাম। লোকে তখন তাকে বলে টিয়া-রঙা।

আবার যখন সেই সবুজ রঙখানা ছড়িয়ে পড়তে থাকে পুঁইমাচায়, নাইলে শিমের লতায় লতায়, নাইলে বেতের ঝোপে ঝোপে, নাইলে ফাল্গুন মাসের তামাকের ক্ষেতে ক্ষেতে; তখন তার বরন আরেকটু গভীর ও ঘন। তখন সে কটকইট্টা সবুজ। সে তখন ওই সবুজের নামসকল, মনে মনে, গেঁথে চলতে থাকে নিজের ভেতরে।

আর চিনে চলতে থাকে, ওইসব সবুজ দিয়ে ঢাকা আঙ্গিনা-দুটোকে। শুধু সবুজ। চারদিকের সবখানে। সকল কোণে কোণে, আর মাথার ওপরে। চিনে চলছিলো আর বোধ করছিলো যে, শুধু গাছ সত্য, শুধু গাছই আগে। তারপর সে, বা বাড়ির অন্যরা। গাছ ও লতাঝোপের নিচে আর তার ঘেরের ভেতরে, শুধু অল্প কয়টা লোক। থাকে তারা। নিরিবিলি থাকে তারা। কর্মধর্ম করে। নিদ্রাগত হয়, জাগে। দুঃখ পায়, কাঁদে। সুখ পায়, হাসেও। তারা সব সবুজে ঢাকা-পড়া লোক।

সেই এক কাল! যখন আকাশ কেবল একা নীল আকাশ নয়। তখন তার অনেক বরণ। একটু উঁচুতে সে আসমানি। তার নিচে সে সাদা ও কালো। মেঘমাখানো। আরো একটু নিচে সে সবুজ। মস্ত গাছের উঁচোনো মাথার আড়ালে থেকে যাওয়া সে তখন। তাই সে সবুজ-মেশানো আকাশ।

তখন খুব মন ঢেলে বৃক্ষমনস্ক হওয়ার কোনো ফুরসত থাকে না তার, সেই বালিকার। গাছের দিকে আবার আলাদা করে তাকানো কী! গাছ আছে সবখানে। সকলের সকল ভিটিতে। নানাবাড়ির চতুর্দিকে গাছ। দাদাবাড়ির সবখানে গাছ। উঠানে উঠানে, ভিটির কিনারে কিনারে। আছে গাছ। পুকুরের পাড়ে আছে, বাড়ির নামায় আছে। ক্ষেতের আলে আলে আছে। সেই এক কাল ছিলো, যখন বিরিক্ষিরা কেবল ছায়াই দেয়। লোকে তখন বাঁচে-মরে গাছের ছায়ায় ছায়ায়। দিনেরা তখন আসে, যায় চুপমুখে। গাছের ফাঁক ও ফোকর দিয়ে দিয়ে আসে। তারপর থাকে তারা, থাকে ছায়ামোড়ানো আবছা আলোর সন্ধ্যার মতন হয়ে।

সেইসব দিনে, বহু বহু দিন, সেই মেয়েটার কেবলই মনে হতে থাকে, ওই গাছজড়ানো ছায়ামোড়ানো উঠান আর বাইরার আঙ্গিনার মতনই বুঝি চরাচরের সকল ভিটি। সবখানে শুধু চিরল-টিরল ছায়া আর গাছগরান। তখন তার কেবল মনে হতে থাকে, ওই গাছদের ছাড়া দুনিয়ার কোনো ভিটি কোনোখানে নেই। সবখানে কেবল ছায়া আর শীতল সবুজ। শুধু আম শুধু বিলাতি গাব শুধু কাঁঠাল গাছের সারি। ফাঁকা ভিটি বুঝি দুনিয়ার কোথাও বিরাজ করে না!

কিন্তু একদিন এক খটখটা খরখরা ভিটির সাথে তার দেখা হয়ে যায়। একদম আচমকাই সাক্ষাৎ ঘটে তার সাথে। সেই ভিটিকে দেখে তার সমস্তটা শরীর আর তার ভেতরটা তখন, ঝুপ করে, বাক্যহারা হয়ে আসে। এমনও হয়! এমন খোলা ধুবধুবা রোদভরা উঠানও হয়? এমন গাছগরান ছাড়া! এমনও হয়? তার চোখেরা পলকহীন হয়ে তখন চেয়ে থাকে সেই বিস্ময়ের দিকে। তার শরীর ও মন যেনো সেই তখন আর শরীর ও মন হয়ে থাকে না। তারা হয়ে ওঠে তার চোখ। শুধু তার দুই চোখ। সে দেখে। দেখতে থাকে। ভিন্ন অচিনকে দেখতে থাকে। তার ভালো লাগে না। আবার যেনো ভালো লাগতেও থাকে।

কোথায় সে দেখতে পায় অমন অন্যকে? অমন বিরিক্ষিশূন্য ফকফকা উঠান ও বাইরার আঙ্গিনাকে? কোথায় পেয়ে যায় সে?

সেটা সে পায় জেবুন্নেসাদের ভিটিতে। আরো অন্য কিছুও সেখানে সে পেয়ে যায়। সেইখানে সে তেতো কুটকুটে পিচ্ছিল পিচ্ছিল কিছু অপমানি পায়, চক্ষুর জন্য খানিকটা শুকনো-মরিচ-গুঁড়া ক্রন্দনও পায়, একা একা হিম হয়ে যেতে থাকাকেও পায়! সেই প্রথমবার! পায় সে।

কতো দূরে জেবুন্নেসাদের ভিটি? কোন মুল্লুকে তারা বসত করে?

জেবুন্নেসারা বসত করে নানাবাড়ি থেকে অনেকখানি পুবে। নিরাছাড়া এক ভিটিতে। যেনো সেটা প্রায় এক পতিত-ভিটি। সেইখানে গিয়ে সেই প্রথম, সে পেয়ে ওঠে একটা উথলে-উঠতে থাকা সকাল। পেতে থাকে রুটি-সেঁকার ঘন গন্ধ। আর পায় মুসুর ডালের তপ্ত তরল ফেঁপে উঠতে থাকাকে।

সকালের ভিটিতে ভিটিতে তবে এইসব গন্ধও থাকে? এমন মিঠা আহ্লাদী গন্ধ? সেই প্রথম খোলখোলা আঙ্গিনার, খলটলা রইদের নিচের এক বেড়ার ঘর, তাকে ওইসব সুগন্ধের সন্ধান দেয়। খুব গাঢ় ও নিকট সৌগন্ধ। আর দেয় খুরখুরা এক আন্ধারের সন্ধান।

তবে ওইসব কিছু পেয়ে ওঠার আগে, সে পেয়ে যায় অন্য একটা জিনিস। এমন একলা এক জিনিস, সে আগে আর, পায় নাই কখনো।

কী অমন একলা জিনিস পায় সে?

পায় একখানা পথ। জলে-ভাসা কচুরিপানার গন্ধঅলা সেই পথ। ভেজা সুপসুপা গন্ধঅলা পথ।

সেই পথটাকে, সেই সেদিনই প্রথম পেয়ে যায় সে। সেই যে জেবুন্নেসাদের ভিটিতে প্রথম যাওয়ার সকাল, সেই সকালে! সেই সকালটা তাকে সবার আগে দেয় ওই কচুরিপানার গন্ধঅলা পথটা! এর আগে রাস্তা ধরে ধরে, একা একা, সে প্রায় প্রায়ই দূরে দূরে গেছে বটে, কিন্তু সেই রাস্তাগুলো হয়ে থেকেছে অন্যদের পথ।

কতো কতো মানুষ কতো কতোরকমে হেঁটে হেঁটে যায় সেই রাস্তা দিয়ে। সেখান দিয়ে সেও যায় হাইস্কুলে। বিকালে বাড়িতেও ফিরে আসে। সেটা শুধু পেরুবার জায়গা। সেটা শুধু বাইরে ফেলে রেখে আসার জিনিস। কিন্তু সেই সকালে, সেই প্রথম, সে আচমকা পায় একটা শুমশুমা পথ। যে-পথ শুধু তার একার। সে ঠিক বুঝে যেতে পারে, শুধু তার জন্য হয়ে উঠেছে অই পথটা পথ হয়ে উঠেছে। শুধু তার জন্য। তার অন্তর মায়ায় টলকাতে থাকে।

 

 

দুই. খানিকটা পথ কচুরিপানা ঠাসা, খানিকটা অন্যকিছুতে

হয়তো তখন সেটা ছিলো শ্রাবণ মাসের শুরু।

সে-সেই সে মেয়ে-তখন কেবলই বাংলা মাসগুলোকে চিনে উঠছিলো। শুধুই নামে নামে চিনে উঠছিলো। সেইসব মাসের বেশিরভাগই কখন যে আসে কখন যে যায়, তখন সে সেটা জেনে উঠতে পারছিলো না। কীভাবে পারবে! নানু যে সেসব মাস নিয়ে, মুখে মুখে, কোনো সাড়া-তাপ ছটকায় না।

সে তখন খেয়াল করে উঠছিলো যে, অন্যসব মাসের আনা-যানা নিয়ে নানু বিশেষ রাগ-গোস্বা না ছটকালেও, বাইরা মাসের স্বভাব-খাসলতের আও-ভাও নিয়ে নানুর মুখে কেবল রাগ কেবল চেত কেবল হায়-আফসোস। এমনটা নানু কেনো করে?

তেমনটা কি আর নানু বিনা কারণে করে!

তা তো না। বাইরা মাইস্যা দিনে, নানাবাড়ির দেশে তখন, কতো যে হুজ্জোত, কতো যে যন্ত্রণা, কতো যে ভোগান্তি এসে খাড়া হয়ে যায়! সেই বাইরা মাইস্যা কালে, সেখানে লোকের চলাচলতিতে তখন কতো যে কষ্ট।

তারামালার ওই ছোটোবেলাটার দিনে, নানাবাড়ির দেশে, তখন একটা কোনো রাস্তা নেই। কোনো রাস্তা নেই। পাকা রাস্তা তো দূর, মাটি-বাঁধানো একটা কিছুও নেই। উঁচু একটা সড়ক আছে বটে, কিন্তু সেটা আছে অনেক দূরের অন্য একটা এলাকায়। সেইটা দিয়ে সকল গ্রামের লোকসকলে টাউনে যায়। টাউন থেকে ফেরে। কিন্তু নানাবাড়ির পুরাটা গ্রামে আছে কোনো সড়ক! নাই। নাই তো।

সেখানকার সকলে তাহলে চলাচলতি করে কী প্রকারে! তারা করে কী, এর বাড়ির কিনার দিয়ে, তার বাড়ির ঢালের নামা দিয়ে, অমুকদের ভিটির পৈঠার পাশ দিয়ে দিয়ে, হেঁটে হেঁেট দূরের নয়া সড়কটার দিকে যায়। সেইখান থেকে তার যায়, যে যার গন্তব্যে। আরো দূরে দূরে যায়। আবার অমন করে হেঁটে হেঁটেই সকল জনে, যে যার বাড়িতে ফিরে আসে। এভাবেই তখন শুকনার দিনে, লোকসকলে আনা-যানা করে সেইখানে। কিন্তু বাইরা মাইস্যা দিনে যে তেমনটা করার কোনো উপায় থাকে না। তখন বড়ো গ্যাঞ্জামের দিন আসে ওখানে।

নানাবাড়ির দেশের কাছে-কিনারে কোনো নদী নেই ঠিক, কিন্তু বাইরা মাসে কী হয়; বাড়ি-লাগোয়া যা-কিছু, জমি-ঘাট-মাঠ-পাতরা-পুষ্কুনি, বেনোজলের নিচে চলে যায়।

নানাবাড়ির দেশের কাছে-কিনারে কোনো নদী নেই ঠিক, কিন্তু বাইরা মাসে কী হয়; বাড়ি-লাগোয়া যা-কিছু, জমি-ঘাট-মাঠ-পাতরা-পুষ্কুনি, বেনোজলের নিচে চলে যায়। তখন কী পায়ে হেঁটে আর কোনোদিকে এগুবার কোনো উপায় থাকে! তখন নিজের নিজের কোষা নাওই হয়ে ওঠে সকলজনের সম্বল।

এক রক্ষা এই যে, সেই বাইন্না পানি হাড়–ম-দুড়–ম করে এসে হানা দেয় না। তারা আসতে থাকে তিরতিরা তিরতিরা রকমে। প্রথমে আসতে থাকে একটু একটু করে। পায়ের পাতা ভেজানো পানি ক্রমে হাঁটু-ডোবানো পানি হয়ে, তেমনটাই রয়ে যায় বেশ অনেকদিন। তারপর এক ভোরে দেখা যায়, রাতের কোন সময়ে জানি, অনেক অনেক পানি এসে আশপাশের সকল ক্ষেত-পাতরের তল্লাট ডুবিয়ে শেষ করেছে। সব ক্ষেতপাতর চলে গেছে টুবটুবা-মাথাডোবা পানির তলে। আর শুধু দূরে দূরে, একটুখানি করে করে, জাগনা দিয়ে আছে ভিটিগুলা। ছাড়া ছাড়া একা একলা দূরে দূরে থাকা একেকটা ভিটি।

এই যে বাইরা মাইস্যা পানি অমন তিরে-ধীরে আসে, তাতে সেই এলাকার লোকের বড়ো উপকারই হয়। তারা আস্তে-মুস্তে নিজের নিজের নাওরে চলা-চলন্তির জন্য গোছায়ে নিতে পারে। কোনোরকম তাড়াহুড়ার হয়রানির মধ্যে তাদের পড়তে হয় না।

তবে অমন আরাম-সারামের অবস্থাটা থাকে অতি অল্পকাল! বানের পানি প্রথমে ফকফকা তকতকা হয়ে থাকলে কী, দু’একদিনের মধ্যেই আবার এক ভোরে দেখা যায়, সমস্তটা পানির দুনিয়ার কোনোদিকে আর এক টলকা পানি দেখা যায় না। বাইন্না পানির শরীর কিনা ঢাকা পড়ে গেছে কচুরিপানায় পানায়! সেই কচুরিপানা যদি ছোটোমোটো গোলাটে ধাচের জাতটা হতো, তো কিছুটা রক্ষা থাকতো। তারা তেমন হালকা-পলকা জাতের কচুরিপানা না!

তারা বিষম ডাঁটো, বিষম তাগড়া, বিষম আটোসাটো আর লম্বা জাতের পানা সব। তারা হঠাৎ করে হাজির হয়ে যায়। আসে হাজারে-বিজারে ঝাড়। কোত্থেকে কখন তারা আসে-কিচ্ছু দেখতে পায় না লোকে। শুধু কোনো একদিনের সকালে তারা দেখে, ঝাড়ে ঝাড়ে কচুরিপানা এসে বন্যার পানিকে ঠেসে-চেপে নিয়ে গেছে কোন আড়ালে! কোন অতলে! পানির আর কোনো হদিস পাওয়া যেনো যাবেই না! সকল মুল্লুুুকে কেবল কচুরিপানা, কেবল ওইই! অন্য কিচ্ছু নাই।

তখন লোকের চলাফেরায় কতো যে কষ্ট। সেই কচুরিপানার ঝাড় ঠেলে-ধাক্কিয়ে একটুখানি ফাঁক করে করে, কোষা নাওকে আগায়ে নিয়ে যাওয়া! সেটা তখন বড়ো এক কঠিন কর্ম। একা একজনের পক্ষে তো তখন কোষা বাওয়ার কথাই আসে না। কেমনে একলা একজনে, একা হাতে তেমন কঠিন কর্মখানা করে। সে নাওয়ের একমাথায় দাঁড়ায়ে লগি ঠেলবে, না সামনের মাথায় গিয়ে কচুরিপানার ঝাড় সরাবে! তবেই না নাও আগানো সম্ভব। নাইলে, শুধু লগি ঠেলে ঠেলে তো অতো তাগড়া অতো ঘন কচুরিপানার ঝাড়কে ছন্নতন্ন করে করে নাও আগায়ে নেওয়া যায় না! কিছুতেই যায় না।

এই যখন অবস্থা, তখন, চলাচলতি করতে লোকের কতো যে পেরেশানি! সকল বাড়িতে কী আর সকল সময় নাও চালানোর জন্য দুইজন করে মানুষ পাওয়া যায়! থাকলে থাকে একজন। সেই একজনরেই তখন একলা হাতে একবার লগি ঠেলতে হয়, আবার সামনে গিয়ে নাওয়ের আগার দিকের কচুরিপানা সরায়ে দিতে হতে থাকে। এই করে করে একেকজনে দরকারের কাজে দরকারের জায়গায়, সঠিক সময়ে গিয়ে পৌঁছায়, সেইটা আর হয় না।

তার ওপর আবার এই বাইরার দিনে, দিন নাই রাত নাই বাদলা নামতে থাকে। কী বাদলা! কতো যে বৃষ্টি, বৃষ্টি। অঝোর অঝোর! ঢলকে ঢলকে বৃষ্টি। আসমান থেকে নামতে থাকে সীমাছাড়া ঢল। নেমেই আসতে থাকে। তখন উঠানের মাটি, সর্বক্ষণ, ভিজে ভিজে পিছলা প্যাচপ্যাচা! প্যাঁকে-পানিতে দশদিক ছ্যারাভেরা! কখন যে কে কোনদিকে ছেলাত করে আছাড় খাবে, তার কোনো ঠিকঠিকুন্তি নাই! এমত সকল ভাবনায়-চিন্তায় সকল ভিটির লোকে তখন, জেরবেরা জেরবেরা থাকে। বাইরা মাসগুলা ভরে।

অমন যখন দুনিয়াদারির অবস্থা, তখন নানুর মেজাজ সয়সুশীল থাকে কীভাবে! সেই মেজাজ চেতে আর গোস্বায়, খনখন না করে কেমনে! তাদের বাড়িতে লোক বলতে আছে চারজন মানুষ। আর আছে একটা এমা-টেমা পোলাপান, নানুর নাতিন তারামালা। ভিটির চারজন মানুষের দুজনই, একদম সকাল করেই, কর্ম করতে চলে যায়, দূরের টাউনে। রোজ রোজই যায়। তারা দুইজন এক কোষা নাওয়ে থাকে বলে, তাদের নাও রোজই যায় সহজে-বহজে।

কিন্তু বাড়ির সব কর্মকাজ তো আর সেই দুজনের বেরিয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই থেমে থুবড়ে থাকে না। ঘর-গিরস্তির হাজারোটা কাজ থাকে সমস্তটা দিন। হাজারটা কর্মের ঠেকা পড়ে যায় পুরাটা দিন ভরে। কোষা নাও ঠেলে, আশপাশের কোনো না কোনো পাড়ায় যাওয়ার ঠেকা থাকেই খোদার প্রতিটা দিন। তখন সেই নাওয়ে কে দেয় লগ্গির ঠেলা, কে সামনে বসে কচুরিপানা সরায়! কী যন্ত্রণা কী যে নাই-জ্বালা সহ্য করতে হয় এই বাইরা মাস কয়টার সময়ে!

তবে সেবারের বাইরা মাইস্যা দিনে, নানুর অন্তরের জ্বালাটা অন্য অন্যবারের চেয়ে কিঞ্চিৎ তেজি হয়ে ওঠে। তেমনটা হয় নানুর ওই নাতিনটার কারণে।

তার তখন দশ বছর বয়স। হাইস্কুলে ভর্তি হতে হয়েছে তাকে তখন, ক্লাশ সিক্সে। এই হাইস্কুলটাকে বাবা-মায়ের ভারি পছন্দ, তাই তাকে এখানে ভর্তি করানো। কিন্তু বাবা বা মায়ের তো এখানে, এই নানুবাড়ির দেশে থাকার উপায় নাই। চাকুরির জন্য তাদের থাকতে হয় কুষ্টিয়ায়। তাহলে তাদের মেয়ের এই হাইস্কুলে পড়াটা হবে কীভাবে! হবে এভাবে যে, নাতিন থাকবে তার নানুর কাছে। বাপ-মা তাদের অবকাশমতো এসে, থেকে যাবে মেয়ের সাথে।

হাইস্কুলে তারামালা যখন যাওয়া শুরু করে, তখন সেটা শুকনার মওসুম। নানু বলে সেটা মাঘ মাস। তবে সে সেটাকে জানে জানুয়ারি মাস নামে। সেই শুকনার কালে যাতায়াতে কোনো হাবজাব হয় নাই। হেঁটেগুটে সুন্দর মতনই সে স্কুলে গেছে। স্কুলশেষে বাড়িতে এসেছে। কোনো বিপত্তি ঘটে নাই কোনোসময়। কিন্তু বাইরা মাস কিনা যেই এসে খাড়া হয়েছে দশদিকে, তখনই বিপদ।

এই এতোটুকুন গুঁড়া একটা মাইয়ায়, কেমনে পাড়ি দেবে এই দুস্তর ভেজাইল্লা পন্থ! না সে কোষা নাওয়ের লগ্গি ঠেলতে শিখে উঠেছে, না পারে সামনের মাথায় বসে কচুরিপানা ঠেলে সরাতে। একা একা তো তাহলে সে কিছুতেই যেতে পারবে না। আর নানুই যে রোজ নাও বেয়ে তাকে, নয়া সড়কের কাছে নিয়ে যেতে পারবে, সেই কথা নিচ্চয় করে কে বলতে পারে! সংসার হলো এক নাই-কাজে ভেজাল-বান্ধোনের জায়গা! নিজেদের ঘরে না দশপদের ভেজাল লেগে আছে হরদম! তাহলে নাতিনের স্কুলে যাওয়া কেমনে! কী উপায়ে! কেমন গ্যাঞ্জাম রে মাবুদ এইটা! নানু ভাবনায় ভাবনায় বড়ো বেতালা হতে থাকে।

তবে ওই ভেজালেরে সামলে নেওয়ারও একটা রাস্তা নানু ঠিক খুঁজে বার করে! আল্লায়ই তারে পন্থ মিলাইয়া দেয়। কী সেই পন্থ? নিজেদের পাড়ার শেষ মাথায় যে-বাড়িটা আছে, সেই বাড়ির যে মেয়ে জেবুন্নেসা, সেও তো এই বছরই সেই একই হাইস্কুলেই গেছে। তার সঙ্গে নিজ নাতিনের ইস্কুলে যাওয়ার বন্দোবস্ত করে নানু।

সাব্যস্ত হয় যে, রোজ সকাল করে জেবুন্নেসার ভাই এসে নানুর তারামালাকে নিয়ে যাবে জেবুন্নেসাদের বাড়িতে। সেইখান থেকে নয়া সড়ক বিশেষ কোনো দূরের জায়গা না। ওই ভিটি থেকে, কচুরিপানা ঠেলেও, নয়া সড়কে গিয়ে উঠতে বেশি একটা সময় লাগে না। জেবুন্নেসায় নানুর নাতিনরে নিয়ে ফটাফট মেলা দিয়ে দিলেই দ্ইুজনে সহিসালামতে স্কুলে হাজির হতে পারবে।

এই যে জেবুন্নেসার ভাইয়ে তারামালারে এমনে নেওন্তি-আনুন্তি, আগান্তি-পাচ্ছান্তি দেবে, সেটা সে মাগনা-মোগনা করবে না। সেই কর্মের জন্য নানু তারে মজা খাওনের পয়সা দেবে। মাসকাবারি চারআনা করে দেবে।

আরো সাব্যস্ত হয়, এই যে জেবুন্নেসার ভাইয়ে তারামালারে এমনে নেওন্তি-আনুন্তি, আগান্তি-পাচ্ছান্তি দেবে, সেটা সে মাগনা-মোগনা করবে না। সেই কর্মের জন্য নানু তারে মজা খাওনের পয়সা দেবে। মাসকাবারি চারআনা করে দেবে। এই বাইরার কালের সব কয়টা মাসের জন্যই এই ব্যবস্থা থাকলো।

আকাশে সেদিন ভোরবেলা থেকেই তুক্ষার রোদ। আকাশে আকাশে একটুও কোনো মেঘ নেই। কালো মেঘ তো নেইই, সাদা মেঘও নেই। সেই রোদ ভেঙে ভেঙে জেবুন্নেসার ভাই নানুবাড়ির ভিটির পুব মাথায় তার কোষ নাও ভিড়িয়ে ডেকে ওঠে: ‘ও বুজি! আমি আইছি গো!’

‘আইছস রে জয়নাল হোসেন? আয় ভাই, আয়!’ নানু বেচঈন পা নিয়ে হুড়দুড় করে এসে দাঁড়ায় ভিটির পুব মাথায়, ‘আয়রে ধন, দুগা মুড়ি খাইয়া ল!’

‘না গো বুজি। মুড়ি খামু না। মায় নাস্তা বানাইতাছে। আমারে তরাতরি যাইতে কইছে গা’—জয়নাল হোসেন কথা বলতে বলতে দেখে, নানু তার নাতিনেরে এনে নাওয়ে বসায়ে দিয়েছে।

‘দেহিস রে জয়নাল হোসেন, নাও কাইত কইরা কইলাম আমার নাতিনরে পানিত ফালাইয়া দিস না। উয়ে কইলাম ইস্কুলে যাইতাছে।’ নানুর কথা কানে নিতে নিতে জয়নাল হোসেন লগি ঠেলা শুরু করে। কোষা নাওখানা আগাতে গিয়ে কচুরিপানার ঝাড়ের দঙ্গলে বাড়ি খেতে থাকে, কিন্তু তার আগানো বন্ধ হয় না! হুশহাশ খাসখুস আওয়াজ দিতে দিতে কোষা নাওটায় আগান্তি দিতে থাকে।

কী তাজ্জবের ঘটনা এইটা! জয়নাল হোসেনে একা-একলাই তার নাওয়েরে চালান্তি দিতে পারতাছে! জয়নাল হোসেনের লগিতে এতো জোর! এমন এতো জোর! কচুরিপানারা কিনা তার নাওয়েরে আটকানি দেওনের শক্তি পাইতাছে না! দেখো দেখো, একেক লগির ঠেলায় কোষা নাওটা ঘড়াস ঘড়াস করে করে, মোটা ডাঁটো কচুরিপানাদের শরীরকে মাড়িয়ে-ঝারিয়ে আগান্তি দিতাছে! সামনের দিকে আগায়েই চলেছে। হুমদাম করে করে এগোচ্ছেই। জয়নাল হোসেনে তো তাইলে অনেক শক্তিঅলা একজন! একা একজন হয়েই সে নাওরে এমন আগায়ে নিতে পারে! অন্য সকল নাওয়েরে আগায়ে নেওয়ার জন্য না দুইজন লাগে! কিন্তু এইখানে একা জয়নাল হোসেন। পারতাছে সেয়!

নানুর তারামালায় এতোগুলা বিষয় ঠিক বুঝে উঠতে পারে! পেরে তার খুব আহ্লাদ হতে থাকে। জয়নাল হোসেনের জন্য তার অন্তরে ভারি এক মায়া জাগনা দিতে থাকে। তার কেমন জানি বেভুলা বেভুলা লাগতে থাকে। যদিও সে সেই তখন, ওই বেভুলা লাগতে থাকার আবেগটাকে কোন নাম দেবে, তার কিছুই নিশ্চিত জানে না! কিন্তু তার পরান, ভেতরে নিরালায়, একটু একটু টলকে উঠতে থাকে। টলকে টলকে উঠতে থাকে।

জয়নাল হোসেনের কোষা নাওয়ে নিজের সামনের দিকের কচুরিপানাদের নোয়ায়ে-নেতায়ে পথ করে নিতে থাকে ঠিক, কিন্তু নাওয়ের দুপাশে কচুরিপানারা তো তেমন লেটকানো-থোকলানে না। তারা থাকে তেজি শরীরে থাকে মাথা উঁচায়ে। মাথা জাগায়ে জাগায়ে ইতিল-বিতিল চক্ষে, দুই পাশের ওই কচুরিপানারা তখন কী করতে থাকে? তারা তারামালারে চেয়ে চেয়ে দেখতে থাকে! দেখতে থাকে এই নাওয়ের লগ্গিঅলা ছেড়াটার মাথা-গরম কাজকারবারটারে। কেমন নিদয়া হইয়া সেয় সামনের দিকের কচুরিপানাগুলারে এমনে ধেমসায়ে দিতাছে! এমনে মিসমার করে দিতাছে! কী কাঠুইরা দিলের কসাই এই জয়নাল হোসেন!

খাড়া হয়ে থাকতে পারা কচুরিপানারা এইমতে যতোই কিনা জয়নাল হোসেন আর তার নাওয়ের চড়নদার মাইয়াটারে নিন্দামন্দা করতে থাকুক, তাতে কোষা নাওখানের কী! তার তো কোনো কিছুরেই গ্রাহ্য করার ঠেকা নাই। কোষা নাওয়ে, তার নিজের রকমে, ঘসর-ঘস-ঘসর-ঘস থাবড়ানি দিতে দিতে, নিজের জন্য রাস্তা করে নিতে থাকে। করে নিতেই থাকে।

একটু পর পর সেইখানে তখন আওয়াজ উঠতে থাকে—ঘসর-ঘস-ঘস! ঘসর-ঘস-ঘস! ওইটা কোষা নাওয়ের আগান্তির আওয়াজ। তখন খাড়া থাকতে পারা কচুরিপানাদের তাগড়া শরীর থেকে কইচ্চা বরনের একরকম ঘন গন্ধ লাফিয়ে নামতে থাকে কোষা নাওখানের ওপরে। লাফিয়ে নেমে আসতে থাকে নানুর নাতিন তারামালার দিকে। কচুরিপানার ফাঁকে ফাঁকে এট্টু-সেট্টু করে করে ফুক্কি দিতে থাকে কালো কচ্চর চিকচিকা পানি। সেই নাই-হয়ে থাকা পানির ওপর, সামনের দিকের কচুরিপানার থেবড়ে যেতে থাকা শরীরের ওপর, জয়নাল হোসেন বানায়ে নিতে থাকে একটা পথ। কইচ্চা গন্ধঅলা এক পথ।

কোনোদিকে তখন একটা কোনো মানুষের চিহ্নসুদ্ধ নেই। কোনো একটা গলার একটা কোনো তেরা-বেঁকা আওয়াজসুদ্ধ কোনোদিক থেকে ভেসে আসতে শোনা যায় না তখন।

শুধু মাথার ওপরে ফকফক্কা রইদ-ঝমকানো তুরাবুরা আসমান। নিচে কুচুরিপানার ঘেরের ভেতর দিয়ে চলতে থাকা কোষা নাওখানা। সেই নাওটায় তার আপনা রাস্তা ঠিকঠিকই বানায়ে নিতে পারে। একটা অতি আপনা রাস্তা।

সেই রাস্তাটা কার জন্য বানায় কোষা নাওয়ে?

বানায় তারামালার জন্য।

তারামালার অন্তরে তখন কেমন যে এক মায়া জাগনা দিতে থাকে! সেই রাস্তাখানার জন্য মায়া। সেই দাঁড়-কাউয়া বরনের পানির জন্য মায়া! মায়া জাগনা দিতে থাকে অন্তরে। থাকে।

যেতে যেতে যেতে তারপর আচমকাই কচুরিপানার ঝাড়জঙ্গলের রাজত্বি শেষ হয়ে যায়। সামনে অনেকটা জায়গা, অই যে-ফাঁকা ফকফকা! সেইখানে পানির ওপরে কচুরিপানার কোনো নামনিশানা নাই। সেইখানটুকুতে খোলা-উদাম পানি কেবল টলটলায়, কেবল তিরতিরায়! সেই খোলা পানিতে পানিতে শুধু বাতাসের আচন-নাচন, সেইখানে শুধু তিরতিরা ঢেউ।

আহ! এমন কুইচকুইচ্চা কালাও হইতে পারে পানি! দাঁড়-কাউয়ার তেনেও বেশি কালো এই পানি। দেখতে তাকে কেমন যে শীতল দেখায়! তারামালা এই পানিরে এট্টু একটু ছোঁবে এখন। ধরবে সে। এই পানিরে নাড়বে-চাড়বে সে। অল্প-এট্টুক্ষণ না, অনেক অনেকক্ষণ ধরে এই পানিরে সে ছুঁয়ে থাকবে! একদম থাকবে। নাওটা কিনারে ভিড়োনোর আগে পর্যন্ত, এই পানিরে ছুঁইয়া থাকবো তারামালায়!

কিন্তু সেই মেয়ে ওই পানিতে হাত রাখবে কী, জয়নাল হোসেন তার আগেই চিক্কুর দিয়ে ওঠে: ‘এই এই, এই যে! লড়ে না। খবোরদার কইলাম, লড়বা না! এট্টুও লড়োন যাইবো না এইনে। এইটা হইলো খাড়া পুষ্কুনি! নাও কাইত হইলেই কইলাম পুট্টুস কইরা ডুইব্বা যাইবো গা! কোষা নাওয়ের শক্তি কইলাম কম!’

ওহ! তাহলে এই পানিরে একটুও ধরা যাবে না? একটুও কাত হতে দেওয়া যাবে না নাওটারে? ওহ! কিন্ত দেখো রে! পানিরা য্যান তারামালারে ডাক পাড়তাছে! ‘আয় আয়, আহো আহো! এট্টু ধরো আমারে! ধরো গো,এট্টু অল্প ধরো!’ কিন্তু তারামালা তারে ধরবে কেমনে? জয়নাল হোসেনে খর চক্ষে চাওন দিয়া আছে না তার দিকে! তারামালা একটু খালি, পানির দিকে কাৎ হতে গেলেই না সে ঝুক্কুর চিল্লান দিয়ে উঠবে!

‘তাইলে থাকো তুমি বাইন্না পানি। দূরের তেনে চাওন দিয়াই খালি থাকো। আজকা এমুনই থাকো। আমার দিগে খালি চাওন দিয়া থাকো আজকা। আমিও তোমার দিকে আজকা খালি চাওনটাই দিয়া থুই, অখন। তারবাদে কালকা আমি তোমারে আমি ঠিকঠিক ধরমু। দেইক্ষো, ধরমু! কালকা তোমারে ধরমুই ধরমু!’

আর অল্প দূরে জেবুন্নেসাগো বাড়ির ঘাটা। ঘাটার কিনারে,ওই দেখা যায়, একখানা হিজলের গাছ! এই শ্রাবণ মাইস্যা দিনেও, সেই গাছে লহরে লহরে হিজলের ফুল ফুইট্টা রইছে! ওম্মা! সেই ফুল হিলিক-বিলিক, ঝুর-ঝুর-ঝুর-ঝুর করে করে ঝরে পড়ছে পানিতে পানিতে, আর ভেসে যাচ্ছে এদিক-ওদিক। কালা কুচকুইচ্চা পানির ওপরে গুঁড়া-গুঁড়া লাল হিজলের ফুল। আরে! কতো সোন্দর তো! অনেক সোন্দর! তারামালার পরানে মায়ার দুলুনি ওঠে। তার অন্তরের ভিতরে মায়া য্যান, এই একবার দুলুনি দিয়ে কোন উঁচুতে উঠে যেতে থাকে! ঝুক্কুর করে কোন উপরে! আবার ঝুপ্পুর করে নেমে আসতে থাকে কুচকুইচ্চা পানির কাছে। শীতল বাতাস আইসা তারামালারে ঝাটকা দিতে থাকে। এই বাতাসের নাম কি? তার নামই নি মায়া? মায়া?

ওই যে ওই দূরে, বউন্না গাছখানা। ওই দেখা যায়! এই বাইরা মাইস্যা দিনে, পাতরের কিনারের ওই গাছটার, গলা পর্যন্ত ডুবে গেছে। শুধু কোনোরকমে সে মাথাটা উঁচিয়ে রেখেছে। আর চেয়ে চেয়ে দেখছে লোকসকলের ইট্টি-পিট্টি লড়ন-চড়নেরে! এমনরকমে আধা-ডোবা হয়ে থাকতে থাকতে বউন্না গাছের মিজাজ তিরিবিরি করে না? চেত হয় না তার? হয়?

কিন্তু এখন, এই সকালে, তার দিকে তাকায়ে তারামালা কী দেখতে পাচ্ছে? দেখতে পাচ্ছে যেনো, বউন্না গাছে হাসতাছে! য্যান এমুন আধা-ডোবা হইয়া থাকতে পারতাছে দেইক্ষা, বউন্না গাছের অনেক ফুর্তি লাগতাছে। তুফান ফুর্তি।

কেমন মায়া যে লাগে ওই বউন্না গাছের জন্য! কেমন যে ছপছপা ঠান্ডা এক মায়া!

 

 

তিন. প্রথম কলাবতী ফুল—অবাধ সুরুজমুখী; তার আশপাশে কতকটা আঁধার!

সেই সকালে জেবুন্নেসা, নিজেদের উঠানে দাঁড়ায়ে ভেজা চুল ঝাড়তে ঝাড়তে বলে, ‘আহো তারামালা! ঘরে গিয়া বও। আমি গামছাটা রইদে দিয়া আহি!’

জেবুন্নেসাদের ভিটিতে একটাই মাত্র ঘর। বেড়ার এক ঘর! চালে তার খয়েরা-খয়েরা টিন। যেনো এই এক্ষণই ঝিরিঝিরি গুঁড়া-গুঁড়া হয়ে হয়ে উঠানে পড়ে যেতে পারলেই শান্তি পাবে সেই টিনেরা! এই ভিটির টিনেরা এমন কেনো? এমন কেনো?

ওই টিনগুলাকে ধরে দেখবে এট্টু সে? ধরবে? ধরার বড়ো ইচ্ছা করতে থাকে তারামালার! কিন্তু সেই টিনের চালটা কত্তো ওপরে! তারামালা তার নাগাল পাবে নিকি?

টিনের চালের নিচের অই যে ঘর, তার ভেতরটা কতো যে বড়ো! এই মাথা থেকে ওই মাথাকে যেনো ভালো করে দেখাও যায় না! এত্তো বড়ো ঘর! ঘরের ওই কোন ভেতরে, মস্ত একটা চৌকি পাতা! তার ওপরে বিছানো আছে শুধু একটা পাটি। আর কিচ্ছু নাই। ঘোলা ঘোলা হলদে হয়ে যাওয়া সেই পাটির শরীরটা আর আস্ত নাই। জায়গায় জায়গায় পাটির বেত, ভেঙে-মুচড়ে নান্দিনাশ হয়ে আছে!

এখন সেই ছেঁড়া পাটিপাতা চৌকিটা দেখো? সেই পাটিয়ে কিনা এখন খালি আহা-আহা করে যাচ্ছে! খালি যেনো বিলাপ দিচ্ছে।

কেনো এমন ককিয়ে যাচ্ছে সে?

নিজের ওপরে একটা ভারভারান্ত কাঁথা পাওয়ার জন্য এমন ককাচ্ছে চৌকিয়ে!

তাইলে চৌকির ওপরে, একটা কোনো কাঁথা, কেনো বিছায়ে দেয় না জেবুন্নেসারা? তাইলেই তো চৌকিয়ে আর এমনে ককাবে না! ওহো রে!

কিন্তু দেখো! শূন্য-খালি-পড়ে থাকা চৌকিরা এমনে ককায় নাকি? ককায়? তারামালা আগে কোনোদিন শোনে নাই তো!

চৌকিটার পরেই আছে একটা জানালা! এই জানালা কেমন জানালা! বেড়ার গায়ে কতোখানি জায়গা জুড়ে খোপ খোপ ফাঁক। সেই ফাঁকটুকুই জানালা! ওই ফাঁক দিয়ে তখন তেড়ে-গেড়ে ঢুকছে সকালের রোদ! চৌকির ওপরটা রোদে রোদে কী যে গলগলাচ্ছে! ওইদিকে একটুখানি যাক তারামালা? ওই খোপ খোপ জানালাটারে একটুখানি ছুঁয়েবুঝে নিক সে?

চৌকিটার পরেই আছে একটা জানালা! এই জানালা কেমন জানালা! বেড়ার গায়ে কতোখানি জায়গা জুড়ে খোপ খোপ ফাঁক। সেই ফাঁকটুকুই জানালা! ওই ফাঁক দিয়ে তখন তেড়ে-গেড়ে ঢুকছে সকালের রোদ! চৌকির ওপরটা রোদে রোদে কী যে গলগলাচ্ছে! ওইদিকে একটুখানি যাক তারামালা? ওই খোপ খোপ জানালাটারে একটুখানি ছুঁয়েবুঝে নিক সে? আর ওই চৌকিটারে, একটুখানি ধরেধুরে, বুঝ দিয়ে আসুক? সেটা করুক? একটু করুক সেটা তারামালা?

চৌকির দিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায় সে।

‘আয় হায় হায়!’ ক্যাটমেটায়ে ফুঁসে ওঠে জেবুন্নেসার মায়ে: ‘কিগো মাইয়া? অইদিগে তোমার কী কাম? অইনে যাওন ধরছো ক্যান? এইটা কী! মাইনষেগো ঘরের ভিতরে এমনে হড়বড়াইয়া যাউন্তি! এইটা কেমুন খাসলত! তোমার বুজিয়ে তোমারে দেহি ভালাই ভালাবুরা শিক্ষা দিতাছে! আউ!’

ও হো! এভাবে তবে কারো ঘরের ভেতরের দিকে যেতে নাই! তাহলে তো ওদিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়ানোটা খুব শরমের এক কাজ হয়ে গেছে। তারামালা এমন শরমের কাজটা করলো! ইস! কেনো করলো! নিজেকে নিয়ে লজ্জা পেতে থাকে সে। ইস!

‘এই যে! এই জলপিঁড়াখান নিয়া অইনে গিয়া বও গা।’ জেবুন্নেসার মায়ে ঘরের অন্য মুড়ার দরোজাটা দেখিয়ে দেয়। দরোজার বাইরে এই তো, খটগটা বিরিক্ষিশূন্য উঠানটা। উঠানে রইদ রইদ! উফ! দেখো তো! উঠানখানেও ককাইতাছে! সেয়, একটা কোনো বিরিক্ষির ছেমা পাওনের লেইগা ককাইতাছে! উফ! এতো ককানি কেনো, এই ভিটিটাতে!

‘যাহ! আমি তাইলে আর উঠানটার দিকে চামুই না!’ তারামালা মন স্থির করে।

তাহলে কোনদিকে তাকাবে সে?

সে তাকাবে ওই যে ওদিকে। ওই যে আছে এই বেড়ার ঘরের এক কোণা! সেখানের লেপে খরখরা করে তোলা মাটির মেঝেতে আছে এক দুইমুখা চুলা। ওই দেখা যায়, সেই চুলায় এখন তকতকা কমলা আগুন! শুকনো কড়–ইপাতা জ্বালানোর আগুন। কমলা কমলা হামলি-হুমলি আগুন।

ওই যে, চুলার এক মুখে বসানো আছে একটা তোবড়ানো মতো সিলভারের পাতিল। পাতিলে ডাল। হলদে ডাল। এটার নামই তো মুসুরির ডাল, তাই না? নিজেকে নিজে জানান্তি দিতে থাকে তারামালা।

দেখো, সেই ডাইলরে অখন দেখতে কতো না বাহারের লাগতাছে! কতো সোন্দর! রান্ধন হইতে থাকা মুসুরির ডাইলেরে দেখতে এমুন সোন্দর দেখায়! আর দেখো, আরো কী আশ্চর্য! চুলার আগুনেরা এদিকে কোন কারবার ঘটাইতাছে! আগুনে কিনা পাতিলের ডালকে উথাল-পাথাল করে দিচ্ছে, কেবলই উথাল-মাতাল! সেই ডালে তখন কেমনে থির-ঠান্ডা হয়ে পড়ে থাকবে পাতিলের ভিতরে! আগুনে যে তারে খালি ডাক দিতাছে। খালি ফুসলান্তি দিতাছে! ‘আয় আয়, পাতিলের ভিতরে থাকোনের কোন কাম তোমার! আহো! আগুনের ভিতরে আহো গো ডাইল!’ তাইলে মুসুরির ডাইলে আর কেমনে পাতিলের ভিতরে পড়ে থাকবে! এমনে ডাকলে সেয় নি বেতালা না হইয়া পাড়ে! ডাইলে তাই দেখো, আর ওই পাতিলের ভিতরখানে, থাকতে চায় না চায় না! সে খালি উলকে-বলকে বেরিয়ে আসতে চায়। পাতিলের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। কেবল ঝাঁপিয়ে পড়তে চায় চুলার ভেতরের আগুনের ওপরে!

উথলানো ডাল দেখতে থাকলে বুঝি কইলজার ভিতরে টনটন করে? ডাইলের লেইগা অনেক মায়া লাগতে থাকে, তাই না? সেইজন্যই তো এখন তারামালার কইলজার ভিতরটা কেমন টনটন ঠুং, টনটন ঠুং লাগতাছে! অনেক মায়া লাগছে তার!

মায়া কি শুধু ওই উথলে-উঠতে থাকা ডালের জন্যই লাগছে? না না। মায়া লাগছে জেবুন্নেসার মায়ের হাত দুইটার জন্যও! উফ! ওই মায়ের হাতে না—অনেক অনেক বুদ্ধি আর বুঝ আছে! অনেক অনেক শক্তি আছে! নাইলে কেমন করে সেয় এক হাতে ডাবুর দিয়া লাইড়া লাইড়া, পাতিলের ডাইলেরে থামান্তি দিতাছে! আবার অন্য হাতে চট-ফটান্তি দিয়া দিয়া আটার রুটিও বেলতাছে, সেই রুটিরে সেঁকতাছে, আবার রুটিরে কাঠার মিদে তুইল্লাও থুইতাছে! কেমনে সেয় পারতাছে এতো কিছু!

কীভাবে পারছে এমন তুরুত হাতে সব সামলে নিতে! দেখতে দেখতে তারামালার চোখদের য্যান ঘুরুন্তি লাগতে থাকে! তারপরেও তার চোখেরা ওই চুলার পাড় থেকে সরে আসার কোনো ইচ্ছা পায় না। তারা কেবল চেয়ে থাকে, ওই চুলার দিকে চেয়ে থাকে। এমন করে বুঝি দমক দিয়ে দিয়ে আটার রুটিরা ফুলে ফুলে ওঠে? সেই রুটি খেতে কেমন লাগে? মুসুরির ডাল দিয়ে তপ্ত রুটি খেয়ে যেতে কেমন লাগে? তারামালা সেইটা জানে না।

তাদের বাড়িতে শুধু ভাত। শুধু দুধভাত আর খেজ্ইুরা গুড়! শুধু গরম ভাত। আর ডিমভাজা। আর মুগডাল আর মাছ! শুধু ওইই! কেমন লাগে আটার রুটি দিয়ে ডাল খেয়ে উঠতে?

তারামালা সেইটা জানে নাই তো কোনোদিন! কীভাবে জানবে! নানু কি বাড়িতে পারতে কোনোদিন আটার রুটি বানান্তি হতে দেয়? দেয় না। বাড়িতে রুটি যদি কোনোদিন হয়, তো সেটা হবে চালের রুটি। ব্যস ওইই। আটার রুটি কক্ষনো না! তাইলে তারামালা কেমনে জানবে, আটার রুটির এইসব ব্যাপার-স্যাপার?

কীভাবে জানবে, আটার রুটি সেঁকতে থাকার সময়ে কতোটা ওম ওম, পাকা বিলাতি গাব গাব গন্ধ আসে? জানে নাই তো কোনোদিন! জানে নাই তো কোনোদিন যে, আটার রুটি-সেঁকার গন্ধ এমুন মায়া-বাস্না জাগান্তি-দেউনি! গরম আটার রুটির গন্ধ নাকে লাগলে এমন মায়া যে লাগতে থাকে চক্ষের ভিতরে, জানে নাই তো সে। মায়া লাগতে থাকে তার কইলজার সবখানে। এতো মায়া লাগে সেঁকা রুটির দিকে চোউখ গেলে! এমন আঠাইল্লা মাটির মতন ঘন মায়া? লাগতে থাকে? লাগে?

‘জলদি কইরা তরা যে যার রুটির তেনে এক চিলতা কইরা কইরা ছিঁড়। ছিঁড়া থুতু দে। আর টুকরাটিরে জলদি চুলার আগুনের মিদে ফিক্কা ফালা। ইছ। এইটা কিমুন বদ-খাছলতের মাইয়া হইছে এই ছেড়ি! পরের খাওনের দিকে এমনে বেলেহাজ চক্ষে চাইয়া থাকে! ডাইনের চউখ দিয়া চাইয়া আছিলো ছেড়িয়ে! খাওনটির দিকে কী বদনজর যে দিয়া থুইছে। তোবা আছতাগফিরুল্লা! তরা আগে নজর লাগুন্তির দোষ তো কাটা! হেইর পরে খাওন মোখে দিস!’ পাতে পাতে রুটি আর গরমাগরম ডাল দিতে দিতে জেবুন্নেসার মায়ে ঘিন্নায় ছটছটাতে থাকে: ‘য্যান জিন্দিগিতে কোনোদিন কিছু খায় নাই, এই ছেড়ি! এমুন ভুক্ষা এইটার নজর! ইছ তোবা! চউখটা নি একটাবারের লেইগা ফিরাইছে ছেড়িয়ে। চক্ষের শরমটা নি আছে!’

‘ওহ! তারামালায় এইটা কী করছে! কী করছে এইটা সেয়! সত্যই তো সে চেয়ে থেকেছে দ্ইুমুখা চুলাটার দিকে! খুব চেয়ে থেকেছে, ওই মায়ামায়া লাগানো লাল আগুনের লাফের দিকে। বলকে ওঠা ডালের থেকে তো তার চোখ একটুও সরে আসে নাই এতোক্ষণ! ফুলে ফুলে ওঠা আটার রুটিদের দেখতে দেখতে তো তার চোখেরা ঝিলকে ঝিলকে উঠেছে একদম।

কিন্তু কিন্তু অমন করাটা তবে খুব খারাপ একটা কাজ! ওই চেয়ে থাকাটা, অনেক খারাপ কিছু?

ইইস! তাহলে কেনো সে ওটা করলো!

উফ! সে তো নজর দেওয়ার জন্য অমনে চেয়ে থাকে নাই! অর যে মায়া লাগতাছিলো সবকিছুরে দেইক্ষা! মায়া করতাছিলো অর! হেইর লেইগাই তো এমনে সে তাকান্তি দিয়া আছিলো! হায় হায়! এইটা কী করছে তারামালায়!’

তার মুখ তখন আতকার উপরে গরম হয়ে যেতে থাকে! ওই যে চুলার আগনের মতো খনখনা গরম! আর, তার তখন খুব চক্ষু টনটন করতে থাকে। অনেক টনটন! শরম লাগতে থাকে, আর অমন পুড়–ন্তি-পুড়–ন্তি আগুন-আগুন লাগতে থাকে, আর চোখের সামনাটা আন্ধার লাগতে থাকে।

জেবুন্নেসার মায়ের কথারা তারামালাকে কী শরম যে দিতে থাকে! কতো যে শরম! তার মুখ তখন আতকার উপরে গরম হয়ে যেতে থাকে! ওই যে চুলার আগনের মতো খনখনা গরম! আর, তার তখন খুব চক্ষু টনটন করতে থাকে। অনেক টনটন! শরম লাগতে থাকে, আর অমন পুড়–ন্তি-পুড়–ন্তি আগুন-আগুন লাগতে থাকে, আর চোখের সামনাটা আন্ধার লাগতে থাকে। আর তার চক্ষু টনটনাতে থাকে।

এমন টনটন কখন করে তার? যখন তার অজ্ঝোরে-পিজ্ঝোরে কান্দন পায়, তখন। তখন এমন টনটনাইতে থাকে তার চউখ।

যাহ! এখন, এই নতুন চেনা লোকেদের সামনে সে কান্দবে নাকি? ধুস! একটুও না! একটুও না! ত্বরাভরা পায়ে সে নিজেকে উঠানে নিয়ে ফেলে। কেনো সে আগেই ওই ঘর থেকে বেরিয়ে আসলো না? ইস! কেনো আসলো না! কেনো বসে থাকলো! আচ্ছা! গরম ডাল দিয়ে গরম রুটি খেতে কেমন লাগে? তারামালা সেইটা কোনোদিন জানতে পাবে না!

এই ভিটির উঠানের কোণে ফুলের ঝোপও আছে! তারামালা সেই ঝোপের কাছে যায়।

‘ঝোপ, ঝোপ, কী ফুল দেও গো তুমি?’

‘আমি দেই কলাবতী ফুল! আমার ফুল চির সুরুজমুখী, বুজলা তারামালা?’

‘কলাবতী ফুল? আহারে! না-জানি সেই ফুল দেখতে কেমন! তারামালায় কলাবতী ফুল কোনোদিন দেখে নাই!’

‘সেই ফুল জানবা, অবিকল তোমার মতন দেখতে!’

‘ফুল বুঝি কোনো সময় মাইনষের মতন দেখতে হয়! কী বলে এইসব!’ তারামালা বেধুম হাসতে শুরু করে।

‘এমনে লোকে আমার পুষ্পের কোনো গন্ধ পায় না! কিন্তু তারামালা,আমি তোমার জন্য গন্ধ আনমু! দেখবা, কেমুন সোন্দর খুশবু পাইবা তুমি, আমার পুষ্পরে তোমার নিকটে নিলে!’

‘কেমুন হইবো সেই গন্ধ? কও তো ঝাড়?’

‘তপ্ত মুসুরের ডাইলের মিদে আটার গরম রুটি ভিজাইলে যেমুন গন্ধটা আহে, তেমুন সুঘ্রাণ গো!’

‘তাইলে তুমি ফোটাও! ফোটাও ফুল, কলাবতী ঝাড়! ফুল ফোটাও!’

‘তুমি কিন্তুক আমার পুষ্পের লেইগা বার চাইতে থাকবা? থাকবা তো? কও, জবান দেও?’ কলাবতী ঝাড় কঠিন বিনয় করতে থাকে।

থাকবে তারামালা। অপেক্ষা করতে থাকবে সে। অপেক্ষা করতে থাকবে, আর ভুলে যেতে থাকবে এইসব অন্ধকারের কামড় পাওয়ার ব্যথা-বিষাদেরে। অপেক্ষা করতে থাকবে, আর পেয়ে উঠতে থাকবে নয়া নয়া দংশনকে। অপেক্ষা করতে থাকবে, আর আশায় ফলেও উঠতে থাকবে, আর নিঃস্বও হয়ে যেতে থাকবে। আর মায়ায় জেবড়ে-মেবড়ে যেতে থাকবে তার ভিতর-বাহির।


নোট : লেখকের নিজস্ব বানানরীতি অক্ষুণ্ন রাখা হয়েছে।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

বাংলা ভাষার একজন ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক ও গল্পকার। আকিমুন রহমানের গ্রন্থসমূহ হলো : ‘আধুনিক বাংলা উপন্যাসে বাস্তবতার স্বরূপ (১৯২০-৫০)’, ‘সোনার খড়কুটো’, ‘বিবি থেকে বেগম’, ‘পুরুষের পৃথিবীতে এক মেয়ে’, ‘রক্তপুঁজে গেঁথে যাওয়া মাছি’, ‘এইসব নিভৃত কুহক’, ‘জীবনের রৌদ্রে উড়েছিলো কয়েকটি ধূলিকণা’, ‘পাশে শুধু ছায়া ছিলো’, ‘জীবনের পুরোনো বৃত্তান্ত’, ‘নিরন্তর পুরুষভাবনা’, ‘যখন ঘাসেরা আমার চেয়ে বড়ো’, ‘পৌরাণিক পুরুষ’, ‘বাংলা সাহিত্যে বাস্তবতার দলিল (১৩১৮-১৩৫০ বঙ্গাব্দ)’, ‘অচিন আলোকুমার ও নগণ্য মানবী’, ‘একদিন একটি বুনোপ্রেম ফুটেছিলো’, ‘জলের সংসারের এই ভুল বুদবুদ’, এবং ‘নিরুদ্দেশের লুপ্তগন্ধা নদী’।

আকিমুন রহমান ভালোবাসেন গন্ধরাজ আর বেলীফুল আর হিজলের ওড়াভাসা! আর তত্ত্বের পথ পরিক্রমণ! আর ফিকশন! ঊনবিংশ শতকের ইউরোপের সকল এলাকার গল্পগাঁথা আর এমিল জোলার কথা-বৈভব! দূর পুরান-দুনিয়ায় বসতের সাথে সাথে তিনি আছেন রোজকার ধূলি ও দংশনে; আশা ও নিরাশায়!

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।