মঙ্গলবার, ডিসেম্বর ৩

সাক্ষাৎকার : ‘সংগঠন সামাজিক এবং মানসিকভাবে একটা শক্তি জোগায়’ —আরিফুল হক কুমার

0

প্রতিবছরের মতো এবারও ২১ এবং ২২ অক্টোবর ২০২২, রাজশাহীতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে কবিকুঞ্জ আয়োজিত জীবনানন্দ কবিতামেলা। এ বছর কবিকুঞ্জ পদক পাচ্ছেন— কবিতায়: ষাটের দশকের অন্যতম কবি মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এবং ‘চিহ্ন’ লিটল ম্যাগাজিন। ‘চিহ্ন’ পত্রিকা সম্পাদনা করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান, অধ্যাপক শহীদ ইকবাল। সংগঠন, মেলার উদ্দেশ্য, প্রতিবন্ধকতা, নিজের লেখালেখি এবং আগামীদিনের কর্মপরিকল্পনা— এরকম বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক কবি আরিফুল হক কুমারের সঙ্গে কথা বলেছেন কবি ও শ্রী ওয়েবম্যাগের সম্পাদক বিধান সাহা


বিধান সাহা : কবিকুঞ্জ কত সালে প্রতিষ্ঠিত হয়? কোন উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে কবিকুঞ্জ প্রতিষ্ঠিত হয়?

আরিফুল হক কুমার : এটা ১লা বৈশাখ ১৪১৯, ইংরেজি ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। রাজশাহী নিউমার্কেটে আমাদের মিন্টু ভাই—বীর মুক্তিযোদ্ধা মিনহাজ উদ্দিন মিন্টু ভাইয়ের একটা দোকান আছে; পুষ্প স্টুডিও। তিনিও খুব সংস্কৃতিমনা মানুষ। আমরা সবাই মিলে এই স্টুডিওতে  বসতাম, আড্ডা দিতাম। তখন রাজশাহীতে সক্রিয় কোনো সাহিত্য সংগঠন ছিল না। কবিদের তো নেই-ই। এই সময় কথা আসে যে নিজেদের একটা সংগঠন দরকার। রাজশাহীতে তখন কবি আসাদ মান্নান সাহেব বিভাগীয় কমিশনার। তাঁর সঙ্গে কথা হয়, কবি জুলফিকার মতিনের সঙ্গে কথা হয় এবং এখানকার আমরা যারা ওখানে নিয়মিত আড্ডা দিতাম, সকলে মিলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে একটা সংগঠন হোক। প্রথম সভাটা হয় তার আগের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে। পুষ্পআড্ডার সামনে একটা চত্বর ছিল সেখানে আমরা একসাথে বসি। সেখানে বসে আলোচনার মাধ্যমে এই প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। কবি রুহুল আমিন প্রামানিককে সভাপতি এবং আমাকে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে মনোনীত করা হয়।

উদ্দেশ্য বলতে যেটা ছিল সেটা হলো যে, কবিদের নিয়মিত কবিতা পড়া, লেখালেখিতে উৎসাহিত করা, সাহিত্য-সংস্কৃতি ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে নিজেদের মধ্যে নিজেদের ভাবনা বিনিময় করা। লক্ষ্য ছিল, নিয়মিত সাহিত্যপত্র প্রকাশ করা ইত্যাদি। এই সমস্ত করতে করতে আমরা যারা একত্রিত হয়েছিলাম, ব্যক্তিগত পর্যায়ে এরাই সব রাজশাহী শহরে কাব্য, সাহিত্য, আবৃত্তি করতাম। আস্তে আস্তে সংগঠনটি একটা রূপ লাভ করে। রাজশাহীতে পদ্মার ধারে বড়োকুঠি বলে একটা জায়গা আছে, এটা পর্তুগীজ আমলের একটা রেশম কুঠি, সেখানেই আমাদের প্রথম অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ১লা বৈশাখ ১৪২৯ সালে সাংগঠনিকভাবে কবিকুঞ্জ আত্মপ্রকাশ করে।

 

বিধান সাহা : প্রতি বছর আপনারা কবিকুঞ্জ জীবনানন্দ কবিতামেলার আয়োজন করে থাকেন। এ ধরনের আয়োজন কেবল লেখকদের মিলনমেলা হয়ে উঠছে নাকি সাহিত্যে এর জরুরি কোনো কার্যকারীতা আছে?

আরিফুল হক কুমার : দুটো বিষয়ই একসঙ্গে ঘটছে। সেটা হলো বাংলাসাহিত্যে এপার-ওপার দুই বাংলার যে সকল মহীরূহ ছিলেন তারা কিন্তু ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছেন। বিভিন্ন জায়গায়, কোনোসময় লিটল ম্যাগাজিন কেন্দ্রিক, কোনো জায়গায় এলাকাভিত্তিক বিভিন্ন চর্চা হচ্ছে। তো এই চর্চাগুলিকে একসঙ্গ, এক প্ল্যাটফর্মে জানার জন্য ভাববিনিময় করার জন্য পারস্পরিক মিথষ্ক্রিয়ার জন্য প্রথমত এটা মিলনমেলা। আর দ্বিতীয়ত হচ্ছে এই কাজটা করতে গিয়ে মঞ্চে নিশ্চয়ই কিছু আলাপ আলোচনা হয়, নতুন মাত্রার কিছু কবিতা উচ্চারিত হয়, ভাববিনিময় হয়, এবং আমরা প্রত্যেক মেলা উপলক্ষ্যে একটি স্মারকপত্র প্রকাশ করি—সেটার নামও ‘কবিকুঞ্জ’—সেখানে কিছু লেখা প্রকাশিত হয়। এভাবে আমার মনে হয় চলমান যে সাহিত্যচর্চা সে চর্চার ক্ষেত্রে যৎসামান্য হলেও আমরা একটু অবদান রাখতে পারছি। তবে প্রশ্নে যেটা বলা হলো যে, এটার উদ্দেশ্য মিলনমেলা কি না, সেটা কিন্তু সত্য। সেটা ভারত-বাংলাদেশ—সবাইকে নিয়েই আমরা করার চেষ্টা করে যাচ্ছি।

 

বিধান সাহা : শুরুতে যে লক্ষ্য নিয়ে কবিকুঞ্জ যাত্রা শুরু করেছিল তা কতটুকু অর্জিত হয়েছে?

আরিফুল হক কুমার : একটা বিষয় ভালোভাবে অর্জিত হয়েছে।  ভারত বাংলাদেশ মিলে—এমনকি দেশের বাইরেও যে সকল বাংলা ভাষাভাষি লেখক রয়েছেন তাঁদের কাছেও কবিকুঞ্জের এই ধারাবাহিক প্রচেষ্টাটা পৌঁছেছে। যে, আমরা এটা ধারাবাহিকভাবে করছি। এটা একটা লক্ষ্যের বড়ো দিক, সেটা অর্জিত হয়েছে। আরেকটা কথা বলি, এই ধরনের সমাবেশ বা মেলা—একে কেন্দ্র করে শিল্প চর্চার ক্ষেত্রে, শুধু কবিতা নয়; শিল্প চর্চার ক্ষেত্রে, যে বিরাট কিছু একটা নতুন ধারা চিহ্নিত করা যায় তা নয়। কিন্তু ইতোমধ্যেই আমরা লক্ষ করেছি বেশ কিছু নতুন কণ্ঠস্বর কবিতার ক্ষেত্রে এসেছে। যারা আমাদের সঙ্গে বা আমরা তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হতে পেরেছি। কারণ শিল্প বা কাব্য সাধনা একার কাজ। আমরা শুধু তাদেরকে জানতে চেয়েছি। আমরা শুধু তাদের কাছে একটা বড়ো অডিয়েন্স দিয়েছি। যাতে করে নিজেরা নিজেদেরকে আমাদের সামনে বা আগ্রহী পাঠক বা শ্রোতার সামনে নিজেদের মেলে ধরতে পারেন।

 

বিধান সাহা : এই যাত্রাপথে প্রধান প্রধান প্রতিবন্ধকতা কী?

আরিফুল হক কুমার : প্রথম প্রতিবন্ধকতা যেটা সমাজের মধ্যে নতুন করে এক ধরণের মৌলবাদী, শিল্পবিরোধী মানসিকতা—ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদাকিতা বাড়ছে। আমরা যখন শুরু করেছিলাম তখন থেকেই বাড়ছে। এই বৃদ্ধি পাওয়াটা আমাদেরকে কখনও কখনও বাধাগ্রস্থ করেছে। আরেকটা বড়ো বাধা হচ্ছে, আর্থিক সামর্থ। এখানে বিভিন্ন মানুষের সহযোগিতা—দেশের সব প্রান্ত থেকে সহযোগিতা জোগাড় করে এই কাজগুলো করতে হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে এক ধরণের প্রতিবন্ধকতা আছে।

তবে আমি মনে করি না যে, এই প্রতিবন্ধকতা আমাদের আটকে দিতে পারবে। কারণ আমরা তো ইতোমধ্যেই বারো তেরো বছর অতিক্রম করে ফেললাম। এবং মানুষের সহযোগিতাতেই করলাম। এছাড়া ইতোমধ্যেই রাজশাহী শহরের অন্যতম সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবেও আমরা দাঁড়িয়েছি। বহুবিধ কর্মকাণ্ডে আমাদের অংশগ্রহণ রয়েছে।

তো, বাধা আছে। বাধা তো সব ক্ষেত্রেই থাকে। তবে আমার মনে হয় এই বাধা অতিক্রম করার জন্য যে দৃঢ়তা, যে সাংগঠনিক প্রচেষ্টা—সেটিই আমদের অনুপ্রেরণা।

 

বিধান সাহা : প্রযুক্তির এই যুগে সাহিত্য সংগঠনগুলো নিজেদের কোন পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে নিয়ে গেলে সময়পোযগী হয়ে উঠবে বলে মনে করেন।

আরিফুল হক কুমার : খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। ইদানীং একটা প্রশ্ন বড়ো হয়ে উঠেছে, আমাদের লিখিত যে সাহিত্য, যেটাকে আমরা পুস্তক, ম্যাগাজিন বা পত্রিকা বলছি—সেটা আর কতদিন টিকবে। মূলত ইলেট্রনিক্স বুক এবং ম্যাগাজিন—যা আমাদের বাংলাদেশেও আমরা লক্ষ করছি—এগুলির জনপ্রিয়তা বাড়ছে। এবং এগুলির ব্যাপকতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে ক্রমে। আমি মনে করি প্রযুক্তির এই যে অগ্রগতি এটাকে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে না নিয়ে বরং প্রযুক্তি আয়ত্ত্ব করে এটাকে খুব পজেটিভ অর্থে ব্যবহার করা উচিত।

 

বিধান সাহা : কবিকুঞ্জ সেই পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেকে কতটুকু মানিয়ে নিতে পারছে?

আরিফুল হক কুমার : ব্যক্তিগত পর্যায়ে আমরা অনেকেই এটার সঙ্গে হয়তো আছি। খুব শীঘ্রই আমরা সাংগঠনিক উদ্যোগ গ্রহণ করতে যাচ্ছি। আমাদের একটা ফেসবুক পেজ আছে কবিকুঞ্জ নামে। কিন্তু সেটি যথেষ্ট নয় বলে আমি মনে করি। আমাদের কবিদের নিয়মিত পাবলিকেশন্স, আলোচনা এবং এক্ষত্রে একটা ওয়েল অর্গানাইজড প্ল্যাটফর্ম আমরা তৈরি করার চেষ্টা করব। যার মধ্য দিয়ে বিশ্ব জুড়েই হয়তো একটা যোগাযোগের সুযোগ সৃষ্টি হবে।

 

বিধান সাহা : একজন তরুণ লিখিয়ের জন্য সংগঠন আদৌ জরুরি কি না।

আরিফুল হক কুমার : সংগঠনে আসা তরুণ বা প্রবীণ কারো জন্যই জরুরি না। কারণ শিল্প সৃজন শিল্পীর একার সাধনার বিষয়। কিন্তু সংগঠন যেটা করে তা হলো সামাজিক এবং মানসিকভাবে একটা শক্তি জোগায়। এই অনুভবের জায়গা থেকে নবীন এবং প্রবীণ সকলেই আত্মপ্রকাশের জন্য আমাদের মঞ্চটা ব্যবহার করতে পারে। এটা আমি মনে করি না যে সংগঠন কোনো লেখকের জন্য অনিবার্য কোনো ব্যাপার।

একটু পেছনে গিয়ে যদি বলি, ষাটের দশকে বা পঞ্চাশের দশকে আমাদের অনেক সংগঠন ছিল। কিন্তু আমাদের অনেক বড়ো বড়ো লেখক শিল্পীকেই পেয়েছি যাঁরা এরকম কোনো সংগঠনের ফসল নন। আমি মনে করি সংগঠনের উচিত নতুন প্রতিভা খুঁজে বের করা। তাদের পরিচর্যা করা। তাদের পথকে প্রসারিত করা।

সংগঠনে আসা তরুণ বা প্রবীণ কারো জন্যই জরুরি না। কারণ শিল্প সৃজন শিল্পীর একার সাধনার বিষয়। কিন্তু সংগঠন যেটা করে তা হলো সামাজিক এবং মানসিকভাবে একটা শক্তি জোগায়। এই অনুভবের জায়গা থেকে নবীন এবং প্রবীণ সকলেই আত্মপ্রকাশের জন্য আমাদের মঞ্চটা ব্যবহার করতে পারে। এটা আমি মনে করি না যে সংগঠন কোনো লেখকের জন্য অনিবার্য কোনো ব্যাপার।

 

 

বিধান সাহা : বাংলাদেশে বেশ কিছু অঞ্চলে প্রতি বছর এই সাহিত্য সমাবেশ হয়। এই সমাবেশগুলোর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে যদি কিছু বলেন।

আরিফুল হক কুমার : প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে বলতে গেলে শুরুতে আমি যেটা বললাম যে আমাদের প্রতিবন্ধকতা—সমাজের ভেতরে এই যে শিল্প-বিরোধী এবং ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা—এইসব ক্ষেত্রে এই সমাবেশগুলি খুব ভালো প্রভাব বিস্তার করে। এর মধ্য দিয়ে নিজেদের সংহতি আমরা প্রকাশ করতে পারি। তবে সব সমাবেশ, সব মেলা, সব আয়োজনের গুণগত মান একই রকম হবে, সেটা  ভাববার কোনো কারণ নেই। সেটা হচ্ছেও না।

কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমি শুনেছি—দুর্ভাগ্যজনকভাবে যে—একধরনের বাণিজ্যিক ব্যাপারও নাকি এর মধ্যে ঢুকেছে। যদিও আমার প্রত্যক্ষ কোনো অভিজ্ঞতা নেই। তবে বিভিন্নজনের মুখে এমন একটা কথা প্রায়ই শোনা যায়। আমার যেটা মনে হয়, এই সমাবেশগুলির প্রয়োজন রয়েছে; সেই প্রয়োজনগুলিকে যদি আমরা খুব কার্যকরিভাবে ব্যবহার করি তাহলে খুব ভালো হতে পারে। আমাদের অর্থাৎ সংগঠকদের, সততা এবং আন্তকরিতা এইক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ।

 

বিধান সাহা : একজন লেখকের সংগঠক হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে লেখক সত্তা ক্ষতিগ্রস্থ হয় কি না?

আরিফুল হক কুমার : হ্যাঁ, অবশ্যই হয়। এ ব্যাপারে নির্দ্ধিধায় আমার নিজের কথাই বলতে পারি। একটা সংগঠন করতে গেলে শুধু সেখানেই সীমাবদ্ধ থাকা যায় না। প্রত্যেক সংগঠনেরই একটা সামাজিক দায়বদ্ধতা থাকে। যার ফলে নানান সামাজিক দায়িত্ব এসে পড়ে। সময়ও অনেক ব্যয় হয়। নিজের একান্ত মগ্ন সময় পাওয়া মুশকিল হয়ে পড়ে।

 

বিধান সাহা : সেক্ষেত্রে একজন লেখককে সংগঠক হয়ে উঠতে আপনি কি নিরুৎসাহিত করতে চান?

আরিফুল হক কুমার : এটা ঠিক কারো নিষেধ করা বা নিরুৎসাহিত করা না-করার উপর নির্ভর করে না। কারণ হলো এটা এক ধরণের অনিবার্যতা। সামাজিক অনিবার্যতা। কখনও কখনও কারো উপর সেই দায়িত্ব এসে পড়ে। যেটা অস্বীকার করা যায় না। আবার এমনও দেখা যায় যে সংগঠনের মধ্য দিয়েই অনেকের বিকাশ ঘটে।

 

বিধান সাহা : আপনার নিজের লেখালেখি নিয়ে কিছু বলুন। আগামী দিনে আপনার নতুন কোনো প্রকাশনা আসছে কি না।

আরিফুল হক কুমার : বিগত কয়েক বছর আমার কোনো প্রকাশনা নেই। আমি এমনিতেই খুব কম লিখি। আমি বহুপ্রজ লেখক নই। লেখার ক্ষেত্রে উপলব্ধির প্রয়োজনীয়তা যেমন আছে, তেমনি নিজের লেখার পুনর্জন্মও ঘটাতে হয়। আমাদের এখানে কবিতার নামে প্রচুর ন্যারেটিভস লেখা হচ্ছে। এটা অলমোস্ট সংবাদপত্রের প্রতিবেদনের মতো হয়ে উঠছে আর কী। যেহেতু মাইকেল মধুসুদন দত্ত আমাদের চরণান্তিক মিলের বিপদ থেকে উদ্ধার করে দিয়েছেন, তিরিশের দশকের কবিরা সেটাকে আরও প্রসারিত করেছেন। এখন যারা সেরকমভাবে লিখছেন এটা হয়তো তাদের যোগ্যতারই দিক। আমি ইতিবাচকভাবেই দেখতে চাই। তবে আমি ওভাবে পারি না। ফলে আমার লেখার পরিমান বরাবরই কম। শুরু থেকেই আমি বেশি লিখতে পারি না।

তাছাড়া আমার লেখা বেশ বিষয়ভিত্তিক। বর্তমানে আমরা সামাজিক যে সংকট, বৈশ্বিক যে সংকটের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি এ বিষয়গুলো আমার মধ্যে কাজ করে। তো এ বিষয়গুলো নিয়ে যদি আমি লিখতে যাই—সেটা তাৎক্ষণিকভাবে হয়তো আবেগতাড়িত কিছু একটা হয়ে উঠবে, কিন্তু সত্যিকার অর্থে সেটাকে রসোত্তীর্ণ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ভাবনা-চিন্তার প্রয়োজন আছে। এগুলো হয়তো আমার কম লেখার পেছনে একটা কারণ। আরেকটি জিনিস হলো, একুশে মেলা কেন্দ্রিক যে লেখা, এগুলোর মধ্যে আমি আগেও ছিলাম না, এখনও নেই। এর মধ্যে আমি কোনো সার্থকতা খুঁজে পাই না। তবে এটাও সত্য, আমাদের প্রচুর লেখককে এটা প্রণোদিত করে এবং অনেক ভালো লেখাও আমরা এর মধ্য থেকে পেয়েছি। ফলে এটাকে উপেক্ষা করার কিছু নেই। কিন্তু ব্যক্তিগত পর্যায়ে আমি এর মধ্য দিয়ে যেতে পারি না।

 

বিধান সাহা : তার মানে, আপনার পরবর্তী বইটি পেতে পাঠকের একটু অপেক্ষা করতে হবে, তাই তো?

আরিফুল হক কুমার : খুব বেশি অপেক্ষা না-ও করতে হতে পারে। দেখা যাক।

 

বিধান সাহা : কবিকুঞ্জের আগামী দিনের লক্ষ্য কী?

আরিফুল হক কুমার : আগামী দিনে কবিকুঞ্জ কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কাজ করবে। বলছি এক এক করে—

প্রথমত, রাজশাহী শহরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান—স্কুল-কলেজে গিয়ে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে শিল্প-সাহিত্য বিষয়ক বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে চাই। তাদের মধ্য থেকে প্রতিভাবানদের খুঁজে বের করা, তাদের সংগঠিত করা আমাদের উদ্দেশ্য। হয়তো তাদের মধ্য থেকেই আগামী দিনের লেখক শিল্পীদের খুঁজে বের করা সম্ভব হবে। এর পেছনে আরেকটি বড়ো উদ্দেশ্য হলো, যে রক্ষণশীল মানসিকতা, যে সাম্প্রদায়িক অপশক্তি আমাদের গ্রাস করছে এই উদ্যোগের মধ্য দিয়ে এসবের বিরুদ্ধে একটা সামাজিক আবহ তৈরি করা।

দ্বিতীয়ত হলো, প্রতি শুক্রবারে আমরা যে সাহিত্য আসর আয়োজন করি, সেখানে প্রতি মাসে অন্তত একজন লেখককে ঘিরে একটা আয়োজন করতে চাই। তাকে যে রাজশাহীরই হতে হবে এমন নয়। দেশের বিভিন্ন জায়গারই হতে পারেন। সেখানে লেখকের একাধিক লেখা পাঠ করার পাশপাশি নির্দিষ্ট করে বিশেষ একজনকে দায়িত্ব দেওয়া, যাতে তার লেখার বিষয়ে তাৎপর্যপূর্ণ আলোচনা উপস্থাপন করা যায়।

আরেকটি বিষয় হলো, ভাষা আন্দোলনের আমরা ৭০ বছর অতিক্রম করছি। কিন্তু ইংরেজির আধিপত্য যেন আজ সব জায়গায়। ইংরেজি জানাটাকে আমি খারাপ বলছি না। কিন্তু নিজের ভাষাটাকে যথাযথভাবে জানা এবং পরিচর্যা করাটাও তো জরুরি। এসব বিষয় নিয়েও আমরা ভাবছি।

এছাড়া জাতীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক বিষয়গুলি নিয়ে বছরে এই মেলার বাইরে অন্তত দুতিনটি জাতীয় পর্যায়ের মানসম্পন্ন সেমিনার আমরা আয়োজন করতে চাই। মোটাদাগে আগামী দিনে এটাই আমাদের কর্মপরিকল্পনা। আরেকটি কথা যুক্ত করি। আমরা ঋতুভিত্তিক প্রকাশনা শুরু করেছি। এবরাই বর্ষাসংখ্যা আমরা প্রকাশ করেছি ‘প্রথম কদম ফুল’ নাম দিয়ে। শরতে তো ‘কবিকুঞ্জ’ সংকলনটি হলো। এর পরে পর্যায়ক্রমে আমাদের সাধ্যের মধ্যে আমরা এক এক করে প্রকাশনাগুলো অব্যাহত রাখতে চেষ্টা করব।

 

বিধান সাহা : আপনার ভীষণ ব্যস্ততার মধ্যেও আমাদের সময় দিলেন এবং কথা বললেন সে জন্য অশেষ ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা জানাই। কবিকুঞ্জ আয়োজিত জীবনানন্দ কবিতামেলার সার্বিক সাফল্য কামনা করি।

আরিফুল হক কুমার : অনেক ধন্যবাদ, বিধান। শ্রী ওয়েবম্যাগাজিনের উত্তোরত্তর সমৃদ্ধি কামনা করি।


 

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম ১৯৮৪ সালের ২১ মার্চ বাংলাদেশের টাঙ্গাইল জেলার ভূয়াপুরে, মামাবাড়িতে। পৈতৃক নিবাস বগুড়া জেলার ধুনটে। চারুকলা বিষয়ে স্নাতকোত্তর করেছেন। বর্তমানে ঢাকায় থাকেন। প্রকাশিত বই : অব্যক্ত সন্ধির দিকে [কবিতা; চৈতন্য, ২০১৫], এসো বটগাছ [না-কবিতা; চৈতন্য, ২০১৭], শ্রীদেবী অপেরা [কবিতা, তবুও প্রয়াস, কলকাতা, ২০১৯], অবিরাম বিস্মরণ [কবিতা, বৈভব, ২০২৩] এবং সম্পাদিত বই শতবর্ষে সত্যজিৎ [শ্রী, ডিসেম্বর ২০২১]। কলকাতা থেকে পেয়েছেন ‘আদম সম্মাননা-২০১৭’। সম্পাদনা করেন ওয়েবম্যাগাজিন ‘শ্রী’।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।