সিনেমার প্রতি তীব্র অনুভব থেকে এ বিষয়ক বইয়ের প্রতি আগ্রহ আমার বরাবরই ছিল। অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২২-এ চন্দ্রবিন্দু কর্তৃক প্রকাশিত ‘সিনেমা দেখার চোখ’ বইটি নিয়ে তাই আকর্ষণের কমতি ছিল না। লেখক তানভীর পিয়ালের সঙ্গে পূর্ব-পরিচয় এক্ষেত্রে অনুঘটক হিসেবে কাজ করলেও, আগ্রহের জায়গাটা বিশুদ্ধভাবে কেবল সিনেমা নিয়েই। বইটি আদৌ সিনেমার সাথে পাঠক-দর্শকের কতটা সংযোগ ঘটাল সেই ভাবনা নিয়েই এ লেখার সঞ্চার।
‘সিনেমা দেখার চোখ’ বইটি মূল্যায়নধর্মী বলাই শ্রেয়। বাংলাদেশের ইন্ডাস্ট্রির উৎপত্তি-সফলতা-ব্যর্থতা-সচলতা-স্থবিরতার সুন্দর গাণিতিক গ্রাফচিত্র এতে তুলে ধরা হয়েছে। তবে ইন্ডাস্ট্রির ভঙ্গুরতার ইতিহাসই যেন বেশি প্রতীয়মান। হ্যাঁ, এ নিয়ে আমাদের নিশ্চিত অনুশোচনা হবার কথা। এক্ষেত্রে অনুশোচনা আর আফসোসের মাঝে বিরাট ভাবান্তর হয় বইয়ের ভূমিকায়, ইন্ডাস্ট্রির ব্যর্থতায় দর্শকের ঘাড়েও কিছুটা দায় আরোপের নতুন ভাবনার সঞ্চার হয়। লেখক এক্ষেত্রে স্বচ্ছতার সাথেই শিক্ষিত-অশিক্ষিত চোখের রেশ টানায় দর্শকেরও রুচি তৈরির প্রয়োজনীয়তা প্রতীয়মান হয়।
ইন্ডাস্ট্রির পাশাপাশি দর্শকের বিবর্তনও এ পর্যায়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। দর্শক যে সিনেমার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ তা মনে করিয়ে দিতেই যেন ইন্ডাস্ট্রির ক্রমপর্যায়ের ইতিহাসের আলোচনা। লেখক ইতিহাস থেকে এরপর যেন আরও গভীরে গিয়ে সরাসরি সিনেমার পর্দায় আলো ফেললেন তার ‘পুনর্বিবেচনা’ অধ্যায়ে।
‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ সিনেমাটি বারবার দেখেও যেন কিছু জায়গা ফাঁক থেকে যায়। ইতিহাস হোক বা মেটাফোর, কোনোটাই মনমত আত্মস্থ হয়না। ‘সিনেমা দেখার চোখ’ নতুন করেই যেন দেখালো সিনেমাটিকে।
‘What you act is the truth, art is a lie’ বাক্যটি পড়ে বোঝা যায় ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’র বাঙ্কারের রহস্যই স্বয়ং যুগোস্লাভিয়ার ইতিহাস নিয়ে স্যাটায়ার। বাঙ্কারের ভেতর এত মানুষের সমাহার। নানানধর্মী কাজের মধ্য দিয়ে দৈনন্দিন জীবন। এ বাঙ্কারেই প্রেমের উদগ্রীব, প্রসব বেদনা, জন্মলগ্নের আনন্দ, মৃত লাশের হাহাকার। হ্যাঁ, আন্ডারগ্রাউন্ড নতুন দেশের হাহাকারই। তাই লেখকও ভাষার সাথে ইতিহাস সমান্তরালে চালিয়ে নিলেন আর ‘হারিয়ে যাওয়া দেশের জন্যে হাহাকার’ শিরোনামে আন্ডারগ্রাউন্ডের হাহাকারময় ইতিহাসের নিখাদ বর্ণনা দিলেন—
‘দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত সর্বত্র সবাই একই সংগীত “comrade Tito we swear to you” গাইতে থাকে। জবরদস্তি নয় বরং ভালোবাসা, বিশ্বাস ও সমর্পণের অদম্য আবেগ থেকে উঠে আসে এই গান।
যুগোস্লাভিয়ার সাথে হয়ে যাওয়া অন্যায় টিটোর সেই শিল্প যা মিথ্যা। সে যা তাই বরং সচেতনভাবে প্রকাশ করলে সমর্পণের এই অদম্য শক্তি তার বিরুদ্ধে প্রয়োগ হতো। তাই সিনেমার অমর বাক্যের সাথে পাঠকের সংযোগ সমস্ত সিনেমাকেই দর্শক-পাঠকের কাছে প্রাসঙ্গিক করে তোলে। ফলে যারা এই সিনেমা দেখেননি, তারাও তরিৎ বেগ অনুভব করবে দেখার।
টিটো যা বলে না, তাও যখন টিটোর নাম করে বলা হয়, মানুষ তা বিশ্বাস করে। এভাবে একনায়কতন্ত্রের সমস্ত সমস্যা খুঁটি গেড়ে বসেছিল বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী যুগোস্লাভিয়ায়।’ যুগোস্লাভিয়ার সাথে হয়ে যাওয়া অন্যায় টিটোর সেই শিল্প যা মিথ্যা। সে যা তাই বরং সচেতনভাবে প্রকাশ করলে সমর্পণের এই অদম্য শক্তি তার বিরুদ্ধে প্রয়োগ হতো। তাই সিনেমার অমর বাক্যের সাথে পাঠকের সংযোগ সমস্ত সিনেমাকেই দর্শক-পাঠকের কাছে প্রাসঙ্গিক করে তোলে। ফলে যারা এই সিনেমা দেখেননি, তারাও তরিৎ বেগ অনুভব করবে দেখার।
আদিত্য বিক্রম সেনগুপ্তের ‘আসা-যাওয়ার মাঝে’ সিনেমার কাব্যিক শৈলীর ভাষান্তর ‘ইমেজের গল্প কিংবা গল্পের ইমেজ’। ছন্দময় ভাষাগত শৈলীর প্রেমময় আবেগের এক নিরূপম বহিঃপ্রকাশ এই রিভিউ।
‘প্রেম আদতে এক অলৌকিক পাইন বন। প্রেম আদতে সকালবেলা। প্রেম মূলত সাদাকালো, সে দৃশ্য রঙ্গিন নয়, সে দৃশ্য রঙের, সে দেখা বহু রঙ্গে বর্ণিল, তবুও সে সাদাকালো, সেই রং ফুটিয়ে তোলে এমন আবীর কই? সেই যে মেঘমেদুর পাইন বন, রঙ্গহীন, যার মাঝে ঋত্বিক ও বাসবদত্তার অবাস্তব অথচ ঘোর বাস্তব হেঁটে যাওয়া, পরস্পর স্পর্শ, তা যেন আমাদের, আমাদেরই প্রেমের রঙিনতম রং।’
সিনেমার সকল দৃশ্য যেন এক বিন্দুতেই ছিল অথবা পরিচালক পুরো সিনেমা সব আয়োজন করেছেন যেন কেবল প্রেমের সেই একটি দৃশ্য দেখাতে। মলিন ঘরের দরজা খুলতেই যেন এক পাইন বন। ‘আসা যাওয়ার মাঝে’ সিনেমা বাস্তবতার বাইরে গিয়ে এক অলৌকিক প্রেমের আবেশ দেয়। লেখকের পুনর্বিবেচনায় ‘ইমেজের গল্প কিংবা গল্পের ইমেজ’ তার প্রতিটি শব্দ নিয়েই যেন হয়ে উঠেছে প্রেমেরই এক সিনেমা। লেখকের কাব্যিক ছন্দের গদ্যভাষাকে আধুনিক কবিতা বলেই ভ্রম হয়।
সিনেমাবিশ্বে মৌলিক নির্মাণশৈলীর মধ্যে ইরানী সিনেমাও একটি গুরুত্ব বহন করে ‘সিনেমা দেখার চোখ’ বইটিতে। ইরানী সিনেমার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ডকু-ফিকশনই এক্ষেত্রে প্রাধান্য পেয়েছে।
সিনেমাবিশ্বে মৌলিক নির্মাণশৈলীর মধ্যে ইরানী সিনেমাও একটি গুরুত্ব বহন করে ‘সিনেমা দেখার চোখ’ বইটিতে। ইরানী সিনেমার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ডকু-ফিকশনই এক্ষেত্রে প্রাধান্য পেয়েছে। গণতন্ত্র নিয়ে একটা ডকু-ফিকশন স্বয়ং জনগণের ভাবনার অন্তর্দহন করে গণতন্ত্রের সংজ্ঞাই পালটে দেয়। বাবাক পায়ামিও চেয়েছিলেন গণতন্ত্রের উপর ডকুমেন্টারি বানাতে কিন্তু প্রকাশ ঘটান সম্পূর্ণ একটি সিনেমাতে। বইতে ‘সিক্রেট ব্যালট’ সিনেমার রিভিউ নিয়ে ‘বাক্সটা খুলে দেখা’ লেখায় তানভীর পিয়াল উন্মোচন করেছেন পায়ামির সেই অন্তর্নিহিত নির্মাণশৈলী। চরিত্রকে প্রধান ধরে পায়ামি তৈরি করেছেন দর্শক মনে নানান অনভূতি। সেই অনুভূতিকে আরও তীব্র করতে কলমের আঁচড় এনেছেন স্বয়ং লেখকও। লিখেছেন—
‘সিক্রেট ব্যালট-এ পরিচালক তার বক্তব্য চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন দুই প্রধান চরিত্রের দ্বান্দ্বিকতায়। একজন ইলেকশন এজেন্ট ও তার সহযোগী সৈন্যই এই চলচ্চিত্রের প্রধান চরিত্র। এরা বক্তব্যে ও আদর্শে দুই মেরুর। সৈনিকটি বিশ্বাস করে বন্দুকের জোরেই সমাজে পরিপূর্ণ শৃঙ্খলা আনা সম্ভব,অন্যায় এবং অসঙ্গতি নিশ্চিহ্ন করার শ্রেষ্ঠ উপায় অস্ত্র। অন্যদিকে ইলেকশন এজেন্ট মনে করে নমনীয়তা ও সৎপরামর্শেই সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা আনতে পারে, বন্দুকের নল কখনো শান্তি শৃঙ্খলা আনতে পারে না বরং বিরোধী শক্তি সৃষ্টি করে, পথচারীকেও সন্দেহ করে, আক্রমণ করে, অকারণে গুলি ছোঁড়ে।’
গণতন্ত্রকে অব্জেক্ট ধরে এই সিনেমাকে নিয়ে নতুন ভাবনার খোরাক মেলে বইতে। লিখেছেন, ‘গণতন্ত্র নিজেই হয়ে আছে নির্বাক’। তাই সিক্রেট ব্যালট সেই বাক্সটাই যেটা খুলে দেখার প্রয়োজনীয়তা তৈরি হয়।
আলাপ–সালাপ এর সাক্ষাৎকারগুলো আমাদের প্রথাগত সাক্ষাৎকারের নিয়মে ছিল না, আধুনিক সাক্ষাতকারের সকল নিয়মকে ছাপিয়ে বরং নিজস্ব গদ্যশৈলীতে হয়ে উঠে অনন্য। ফলে সাবলিল এবং আত্মিক শব্দের এই আলাপ নিজেদের ভাষা বলে আনন্দিত হই। জ্যঁ লুক গদার, উডি এলেন, এমির কুস্তরিতসার নির্মাণ প্রসঙ্গে আলাপগুলোদেশীয় ভাষায় আধুনিকতার ছাপ ফেলেছে। নির্মাণ প্রসঙ্গে বিখ্যাত ও সুপরিচালকের দেখা মিললে পাঠক -দর্শক খুশী হোন। যেমন জ্যঁ লুক গদারের আলোচনায় আমরা দেখতে পাই, ‘অভিনেতারা তাদের অভিনয়ের মাধ্যমে চরিত্রকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে পারে- এ বিশ্বাস করিনা। অভিনেতাদের নির্দেশনা দিইনি আমি কখনোই। বড়জোর বলেছি, যদি এটি তোমার কাছে সত্য মনে হয়, তাহলে তা এমনভাবে করো যাতে তা আমার কাছে সত্য বলে মনে হয়।’
নিজের ভাষার চেয়ে সহজ-আনন্দের আর কিছু নেই। বিদেশী ভাষায় যারা পড়তে সংকোচ করেন এবং আফসোস করেন তাদের জন্যে সুখকর খবরই বলা চলে। সিনেমা পরিচালকের সৃষ্টি, তাই পরিচালকের ভাবনার বহিঃপ্রকাশ জানাও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
নিজের ভাষার চেয়ে সহজ-আনন্দের আর কিছু নেই। বিদেশী ভাষায় যারা পড়তে সংকোচ করেন এবং আফসোস করেন তাদের জন্যে সুখকর খবরই বলা চলে। সিনেমা পরিচালকের সৃষ্টি, তাই পরিচালকের ভাবনার বহিঃপ্রকাশ জানাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। তাই এরিক রোমের আলাপের সাবলীল অনুবাদ ‘সিনেমা দেখার চোখ’ বইতে ‘এরিক রোমের কহে, শোনে পুণ্যবান’ শিরোনামে পাঠককে সহায়তা করবে।
‘সার্বিকভাবে নির্বাক ছবি কতোটা সরাসরি প্রভাব ফেলেছে আমি জানি না। লোকে বলে আমার সিনেমায় নাকি প্রচুর কথা; আমি নাকি আমার বক্তব্য ইমেজের পরিবর্তে কথার মাধ্যমে প্রকাশ করি; অথচ আসল ব্যাপার হলো আমি সিনেমা সম্পর্কে যা জানি তার বেশিরভাগই জেনেছি গ্রিফিথ, স্ট্রোহাইম ও মুরনৌ, এমনকি নির্বাক কমেডি ছবি দেখে’।
এ বইটি পড়তে খানিক কষ্ট হতে পারে কেননা লেখকের নিজস্ব ভাষাশৈলী দেশীয় ভাষাতে নতুন। যারা এক্সপেরিমেন্টাল বা নতুন কিছু পড়ে অভ্যস্ত নন তাদের ক্ষেত্রে এটা গ্রহণ করা কষ্টেরই। আধুনিকতার সাথে শব্দের সুষ্টু ব্যাকরণের গড়ন অবশ্যই বইটি পড়তে আগ্রহী করে তুলবে। নতুন শব্দ বা বিষয় চিনে নিতে টিকা আর পরিচালকদের সিনেমার তালিকা আমাদেরকে আরও সমৃদ্ধ করুক। এক বাক্যে তাই বলা যায় সিনেমা রিভিউ নিয়ে ‘সিনেমা দেখার চোখ’ একটি ফ্রেশ সামারি। তাই সচ্ছভাবে এরচেয়ে বেশি সমালোচনা করতে আমাদের সিনেমা দেখার চোখ তৈরি হোক।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী। একটি জাতীয় দৈনিকে খণ্ডকালীন প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি নানান পত্রিকা, সাময়িকী ও ওয়েব প্ল্যাটফর্মে নিয়মিত লেখালেখি করছেন। নানামূখী বিষয়ে লেখালেখির আগ্রহ থাকলেও নারী অধিকার, সাক্ষাৎকার ও বইপর্যালোচনা নিয়ে তিনি উল্লেখযোগ্য কাজ করে চলেছেন।