নাসের মামুনের বয়স তেতাল্লিশ। মূল পেশা—লেখক। লেখালেখি করে তিনি দৌলত কিংবা খ্যাতি— কোনোটিই বিপুলভাবে অর্জন করতে পারেননি। সম্ভাবনা শেষ হয়ে গেছে— ব্যাপারটা এমন না। একজন লেখকের জন্য তেতাল্লিশ বছর বয়স— অল্প বয়সই বলা যায়। কবি সাহিত্যিকদের তারুণ্য মনের ভেতর। একে বয়সের ছাঁচে ফেলার কোনো সুযোগ নেই। মানিক বন্দোপাধ্যায়ের মনে হয়েছিল ত্রিশ বছরের আগে লেখালেখি শুরু করা উচিত নয়। জর্জ ইলিয়ট প্রথম উপন্যাস লেখেন ৪০ বছর বয়সে। এরকম আরও বহু উদাহরণ আছে।
আমাদের আজকের গল্প এই তরুণ এস্পায়ারিং রাইটারকে নিয়ে, জীবনের প্রথমভাগে যার নাম ছিল ‘আবু নাসেরউদ্দিন’। বাবা মা অবশ্য ডাকতেন ‘মামুইন্যা’। বড়ো হবার পর জ্বলজ্যান্ত নামের আত্মাহুতি নিয়ে কালেভদ্রে তার মন খারাপ হলেও কিছু করার ছিল না।
আমাদের আজকের গল্প এই তরুণ এস্পায়ারিং রাইটারকে নিয়ে, জীবনের প্রথমভাগে যার নাম ছিল ‘আবু নাসেরউদ্দিন’। বাবা মা অবশ্য ডাকতেন ‘মামুইন্যা’। বড়ো হবার পর জ্বলজ্যান্ত নামের আত্মাহুতি নিয়ে কালেভদ্রে তার মন খারাপ হলেও কিছু করার ছিল না। বাঙালিদের কাছে নাম হলো ময়দা কিংবা কাঁদার চাকের মতো। দলা মোচড়া কিংবা নানা রকম সাফিক্স প্রিফিক্স যোগ করে কুৎসিত আকার দেওয়া তাদের প্রধান কাজ। অবশ্য, বাপ মা বোধকরি সদয়ই ছিলেন। এর চেয়েও নিষ্ঠুরতম উদাহরণ দেখিয়েছিল স্কুলের সহপাঠীরা। সোল্লাসে চেঁচিয়ে উঠতো, ‘কাইল্যা মামুন আজকা ইস্কুলে আইছে.. হিহিহি…’
কৃষ্ণকায় দেহ নিয়ে হাসির খোরাক হবার কষ্ট মামুনের মনে চপোটাঘাত করলেও সে ছিল বয়সের চেয়ে এগিয়ে। সহপাঠীদের সাথে তাল মিলিয়ে নিজেকে ভাঁড় প্রমাণে অংশগ্রহণ করতে তার ভুল হয় না। এমনভাবে হাসে—যেন ভারী মজার কিছু চলছে। অন্য কেউ হলে নেহাৎ রাগারাগি করে সেখানে মারপিট করে আসত। অথচ মামুন কাঁধ ঝাঁকিয়ে প্রাণ খুলে হাসে।
একসময় তার ভুল ভাঙে। কেউ ভাঙায় নাকি আচমকা ভেঙে যায়, সে কথা অবশ্য জানা যায় না। মামুন বুঝতে পারে তাদের হাসির ধরণ আলাদা। এই হাসি তাচ্ছিল্যের হাসি। পানি আর তেলের মতো এই দুই ভিন্ন হাসিও কখনো একসাথে মিশবে না।
বিষণ্ণ হয়ে যায় বালক মামুন। তখন তার বয়স কতো? ছয়-সাত?
স্কুলে অবশ্য নিয়মিত যাওয়া হয় না। আমরা যেমন মাঝেমধ্যে বেড়াতে যাই, মামুন যায় স্কুলে। বাকি সময় কাটে বাড়ির কাছে একটা রেলস্টেশনে। সেখানে ছোটো মালবাহী গাধার মতো জীবন তার। কখনো কখনো নিজের চেয়ে বড়ো মাল টেনে নেয় মাথার ওপর। হাত পা গুলো নেতিয়ে পড়তে চায়। সর্বশক্তি দিয়ে টেনে তোলে তাদের। সমবয়সী অন্য সবার চোখ যখন বইয়ের ভেতর, তার চোখ খোঁজে নতুন ট্রেন। নতুন যাত্রী। বালক মনে উত্তেজনা জাগায় ট্রেনের হুইসেলের শব্দ।
একবার ক্লাসেরই এক ছেলে, নাম সম্ভবত ননী অথবা ননাই— সঠিক মনে নেই। দন্তন্য দিয়েই কিছু একটা হবে। ধরা যাক, ছেলেটির নাম ননী। বাবা মা, ভাই-বোন সব মিলে ছুটি কাটাতে বেড়াতে গিয়েছে মাসীর বাসায়। কলকাতা থেকে ফেরার পথে এই স্টেশন ধরতে হয়৷ তাদের সঙ্গে তখন অনেক গাট্টি বোঁচকা।
নতুন যাত্রী দেখে মামুন দৌঁড়ে গেল কর্তা লোকটির ব্রিফকেস টানার উদ্দেশ্যে। সেই মুহূর্তে মামুন ননীকে, কিংবা ননী মামুনকে খেয়াল করেনি। দু’জনের ভেতর প্রথম দেখা হয় ননীদের বাসায় পৌঁছানোর পর। স্টেশনের কাছেই বাসা। আলাদা করে রিকশা নেবার প্রয়োজন পড়ে না। কর্তা যখন কুলির হাতে পাঁচ টাকা গুঁজে দেয়, পাশ থেকে ননী হঠাৎ চিৎকার করে উঠে, ‘বাবা ও কাইল্যা মামুন… হিহিহি… আমাদের স্কুলে পড়ে…’
মামুন তার ছোটো জীবনে এতো লজ্জা কখনো পায়নি। তার বাপ অনেকবার ন্যাংটো করে মেরেছে। সবার সামনে কুৎসিত গালিগালাজ করেছে। ব্যাথায় সে কেঁদেছে—কথা ঠিক। কিন্তু যাবতীয় অনুভূতিগুলো তার হয়নি। সেদিন মামুনের চোখ ফেটে পানি বের হতে চাইলো। আটকে রাখার চেষ্টা করলেও কিছুক্ষণের ভেতর টের পেলো, গরম পানির ফোঁটা গাল বেয়ে টপটপ করে মেঝেতে পড়ছে।
সেই রাতে মামুনের তার মা’কে মনে পড়ে। চেহারাটা ভালোভাবে মনে নেই। এক দুঃখী রমনীর আবছা অবয়ব চোখে ভাসে। জর্জেট পর্দার সামনে থেকে অন্যপাশে বসা মানুষ দেখতে যেমন লাগে—তেমন। ছোটোবেলায় মা তাকে রেখে কোথায় যেন চলে গেছে। তাকে নিয়ে গেলে কী এমন ক্ষতি হতো? মায়ের উপর তার প্রচণ্ড অভিমান হয়। অভিমানের দানাগুলো জমাট বাঁধতে বাঁধতে একসময় বিশাল আকার ধারণ করে।
যেদিন সে বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়, সেদিন পূর্ণিমা ছিল। চাঁদটাকে দেখাচ্ছিল সূর্যের মতো। একে ঠিক পালিয়ে যাওয়া বলে না। যেখানে পিছুটান আছে, সেখান থেকে পালানো যায়। এখানে তার পিছুটান নেই।
বাড়ি থেকে পালানোর পর শুরু হলো এক যুদ্ধের জীবন। এই যুদ্ধের কথা আজ বলতে গেলে উপন্যাস রচনা করতে হবে। অন্যদিনের জন্য বরং তোলা রইল। তবে মামুন টের পেলো গাধার জীবন থেকে হঠাৎ করে মানুষের জীবন যাপন— সহজ ব্যাপার নয়। একদিকে স্বাধীনতার স্বাদ, অন্যদিকে স্বাধীনতার মূল্য, দুইয়ের ভেতর সে দুলছে।
হোঁচট খেতে খেতে মামুন উঠে দাঁড়ায়। বুক চিতিয়ে বাঁচার স্বপ্ন তাকে জীবিত রাখে। কয়েক বছর পর সে ভর্তি হয় জগন্নাথ কলেজে। বাংলা সাহিত্যে। সাহিত্যে ভর্তি হবার জন্যই কিনা জানি না, কিছুদিনের ভেতরই তাকে দেখা যায় পত্রিকা অফিসের আশেপাশে ঘুরাঘুরি করতে। ভীরু ভীরু চোখে আবু নাসেরউদ্দিন মামুন সম্পাদকের অফিসের বাইরে অপেক্ষা করেন, সাহিত্যপাতা গুলোতে নিয়মিত লেখা পাঠান।
কোনো কোনো সম্পাদক উপায়ান্তর না দেখে বিরক্তমুখে লেখা জমা নেন। এসব ভার্সিটিপড়ুয়া নব্য কবির অখাদ্য চেখে দেখবার সময় কই?
বছরখানেক ঘোরাঘুরির পর একদিন এক অখ্যাত পত্রিকার সাহিত্য পাতার একটি ছোটো গল্প মামুনের নজরে আসল।
গল্পের নাম, ‘ব্যথা’। এর নিচেই ছোটো ছোটো অক্ষরে লেখকের নাম— ’আবু নাসেরউদ্দিন’
সম্পাদক নিজের ইচ্ছামতো গল্পের পোস্টমর্টেম করেছেন। আসল গল্পে যদি এক হাজার শব্দ হয়ে থাকে, ছাপানো গল্পে শব্দ সংখ্যা দুইশো। নতুন গল্পকে নিজের বলে চিনতে অসুবিধা হলেও সেদিন তার খুশির অন্ত ছিল না।
সম্পাদক নিজের ইচ্ছামতো গল্পের পোস্টমর্টেম করেছেন। আসল গল্পে যদি এক হাজার শব্দ হয়ে থাকে, ছাপানো গল্পে শব্দ সংখ্যা দুইশো। নতুন গল্পকে নিজের বলে চিনতে অসুবিধা হলেও সেদিন তার খুশির অন্ত ছিল না।
সেদিন রাস্তার মোড়ে গরম চায়ে পুড়ি ভেজানোর সময় আবু নাসেরউদ্দিন অনুভব করল, একজন লেখকের গাম্ভীর্যের সাথে তার নামটি মানানসই নয়। নাম হওয়া উচিত ব্যক্তিত্বপূর্ণ। উচ্চারণের সাথে সাথে যেন সেখান থেকে জ্ঞান এবং দর্শন চুইয়ে পড়ে। এই নাম রেখেছেন তার বর্গাচাষী বাবা। একজন কৃষক কিংবা মাছের আড়তদার হিসেবে নামটি ঠিক আছে। তার বাবা সম্ভবত এমন ভবিষ্যৎ ঠিক করেই নাম রেখেছিলেন.. মনে মনে হাসে সে।
আমরা ফিরে আসি বর্তমানে। প্রায় দুই যুগ কেটে গেছে এর ভেতর। নাসের মামুন এখন সভ্য সমাজের বাসিন্দা। এখানে তাকে ‘মামুইন্যা’ কিংবা ‘কাইল্যা মামুন’ বলে টিটকিরি করার কেউ নেই। তিনি লেখালেখি করেন একান্তই আনন্দের বশে। একটা সময় তিনি যখন বুঝতে পারলেন আনন্দ দিয়ে পেট ভরানো অসম্ভব, যোগ দিলেন একটা বেসরকারি কলেজে। উঠতি কিশোরদের সাহিত্য পড়ান। ‘শকুন্তলা’র জার্মান অনুবাদ পড়ে গ্যেটে মুগ্ধ হয়ে কী বলেছেন, পুশকিন কিভাবে ৩৮তম প্রেমিকা নাতালিয়ার দ্বারে মারা গেল, কিংবা কবি কামিনী রায় কীভাবে বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর প্রেমে ‘সুখ’ কবিতাটি লিখলেন— তার গল্প বলেন।
কালেভদ্রে সুখ্যাতি কিংবা প্রচুর অর্থবিত্তের আকাঙ্ক্ষা তাকে নাড়া দেয় না, এ কথা ঠিক নয়। একটা সময় ছিল যখন তিনি টানা ১৬ ঘণ্টা পর্যন্ত লিখতে পারতেন। মাঝে শুধু খাবার আর কিছুক্ষণের জন্য শৌচাগারমুখী হওয়া। লেখালেখি নিয়ে অদ্ভুত সব স্মৃতি আছে তার।
এক বিয়ের দাওয়াতে গিয়ে তিনি দ্বিতীয় উপন্যাসের শেষ পাতাগুলো লিখেছেন। সেখানে যেতে হয়েছিল স্ত্রী যুথীর জোরাজুরিতে। বাধ্য হয়ে। চুপচাপ ছাদের এক কোনায় বসে লিখতে লিখতে কখন যে সময় ফুরিয়ে গেল, খেয়াল হয়নি। তার স্ত্রী ব্যস্ত ছিলেন আত্মীয়দের সাথে। যখন লেখা শেষ হলো, ততক্ষণে অতিথিরা সব বিদায় নিয়েছেন। যুথীও ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছে। শেষমেষ দুপুরের খাবার না খেয়েই সেদিন বাসায় ফেরত এলেন।
এ সবকিছুই এখন অতীত। শেষ একমাস ধরে খুব অদ্ভুত সময় যাচ্ছে। নাসের সাহেব সারাদিন উশখুশ করেন, রাতেরবেলা এপাশ-ওপাশ করে কাটিয়ে দেন। ঘুম আসে না। গল্পগুলো বুকের ভেতর আটকা পড়েছে। মাঝেমাঝে নিজেকে তার মাথা বিহীন মনে হয়। মাঝেমাঝে মনে হয়, তার মাথার ভেতর অন্য কেউ বসে আছে। কোনোভাবেই সে লিখতে দিবে না।
প্রচণ্ড অস্বস্তি নিয়ে তিনি একবার খাতা কলম নিয়ে বসেন কিংবা কম্পিউটার চালু করেন। এক জায়গায় লিখলেই হলো। অন্তত লেখাটা আসুক।
একেই সম্ভবত ‘রাইটার্স ব্লক’ বলে।
লেখক জীবনের পনেরো বছরের ইতিহাসে কখনো এমন হয়নি। যখনই তিনি কলমকে টেনে নিয়েছেন, কলমও একান্ত অনুগত স্ত্রী’র মতো আচরণ করেছে। ভুলেও ফিরিয়ে দেয়নি। হঠাৎ কেনো এমন হলো তিনি বুঝতে পারছেন না।
সেদিন সকাল থেকে কম্পিউটারের স্ক্রিন সামনে নিয়ে বসে আছেন নাসের। প্রতি দশ মিনিটে নতুন করে লেখা শুরু করার চেষ্টা করছেন। কোন ফাঁকে যে টেবিলের উপর ঘুমিয়ে পড়লেন খেয়াল নেই। ঘুম ভাঙল অদ্ভুত এক স্বপ্ন দেখে।
সকালবেলা উলঙ্গ হয়ে বাজারের ভেতর দৌড়ে বেড়াচ্ছে সে। নাভিতে কিলবিল করছে অসংখ্য কেঁচো। খাজকাঁটা কেঁচো, মসৃণ কেঁচো, লম্বা সরু কেঁচো। গলগল করে রক্ত পড়ছে সেখান থেকে। ব্যাথায় কুঁকড়ে যাচ্ছে সারা শরীর। হঠাৎ করে একটা কেঁচো নাভি ছেদ করে শরীরের ভেতর ঢুকে গেল। রক্তের ভেতর সাঁতরে বেড়াতে বেড়াতে সে চলে গেল উপরের দিকে। মাথায়। সূক্ষ্ম অথচ তীব্র একটা অনুভূতি। ধাঁ করে কিছু একটা ঘটল ভেতরে। কি হচ্ছে তিনি জানেন না। সারা শরীর গুলিয়ে যাচ্ছে তার, প্রচণ্ড বমি আসছে….
ঘুম ভাঙার সাথে সাথে সটান হয়ে বসল সে। ঘামে ভিজে আছে পুরো শরীর। নাভির জায়গাটায় চিনচিনে ব্যাথা করছে। এই ব্যাথা কি সাইকোলজিক্যাল? শার্ট উঠিয়ে নাভির কাছে অস্পষ্ট ক্ষত দেখে সে শিউরে উঠল। শরীরের ভেতর একটা পরিবর্তন টের পাচ্ছে। মাথাটা হালকা লাগছে, মনে হচ্ছে ভেতর থেকে ভারী কিছু একটা নেমে গেছে।
রাগ করে চলে যাওয়া শব্দগুলো কি ফেরত এসেছে?
সম্ভবত হ্যাঁ। এতো আনন্দ তার বহুদিন হয়নি। দ্রুত কম্পিউটারের ঝিমিয়ে পড়া স্ক্রিনটা চালু করল। ঠিক হলো আজ সে বৃষ্টির গল্প লিখবে। বেশ কয়েকদিন ধরে এই গল্প তাকে খোঁচাচ্ছে।
গল্পটা শুরু হলো এভাবে, ‘হঠাৎ করে ঝুম বৃষ্টি নামল। বলা নেই-কওয়া নেই, এমন অসময়ের মেহমানের মতো বৃষ্টি আমার অসহ্য লাগে…’
গল্পটা এগুচ্ছে উত্তম পুরুষে। উত্তম পুরুষে লেখা সহজ। তালগোল পাকার সম্ভাবনা কম। দ্বিতীয় লাইন শুরু করার আগ মুহূর্তে রান্নাঘর থেকে যুথীর গলা ভেসে আসল।
‘বৃষ্টি নামতেছে নাসের… ছাদ থেকে কাপড়গুলা একটু নিয়ে আসো তো…’
নাসের মনে মনে একটু অবাক হলো। হোয়াট আ কো-ইনসিডেন্ট…এমনও হয়! কাপড় আনতে বেশি দেরি করল না। ফিরে এসে লেখায় মনোযোগ দিলো।
‘এমন বৃষ্টিতে সর্ষে ইলিশ আর খিচুড়ি খেতে ভীষণ ইচ্ছে হলেও আজ পেটে কিছু পড়বে না। আমার স্ত্রী কিছুক্ষণ আগে চুলায় হাত পুড়ে ফেলেছে। অনেকবার সাবধান করেছি তবুও….’
হঠাৎ করে চিৎকার চেঁচামেচিতে আবারও মনোযোগ বিচ্ছিন্ন হলো। এবার মনে মনে চটে গেল নাসের। এতদিন পর লিখতে বসে এতো জ্বালাতন ভালো লাগছে না। যুথীর এইমাত্র হাত পুড়ে গেছে। সে জানিয়ে দিয়েছে, আজ বাসায় রান্না হবে না।
নাসের হতভম্ব হয়ে বসে রইল। গা ছমছম করছে। সে কি স্বপ্ন দেখছে? সম্ভবত হ্যাঁ, সম্ভবত না। মনে হচ্ছে বাস্তব আর স্বপ্নকে আলাদা করার ক্ষমতা ক্রমে কমে যাচ্ছে। সে কি কাউকে বলবে ঘটনাগুলো? কাকে বলবে? যুথী?
পরবর্তী দিনগুলো কাটলো শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায়।
স্ক্রিনে কিংবা খাতায় লেখা গল্পগুলো সত্যি হচ্ছে। নাসেরের মনে হলো সে আলাদীনের প্রদীপ পেয়েছে। একই সাথে সে চিন্তায়ও পড়ে গেল। এটা কি বিজ্ঞানসম্মত কোনো কথা? মানুষ শুনলে পাগল বলবে।
স্ক্রিনে কিংবা খাতায় লেখা গল্পগুলো সত্যি হচ্ছে। নাসেরের মনে হলো সে আলাদীনের প্রদীপ পেয়েছে। একই সাথে সে চিন্তায়ও পড়ে গেল। এটা কি বিজ্ঞানসম্মত কোনো কথা? মানুষ শুনলে পাগল বলবে। ফ্যান্টাসি গল্প বা সিনেমায় এমন ঘটলে সেটা গ্রহণযোগ্য হতে পারে, কিন্তু বাস্তবে— অবিশ্বাস্য।
তবুও কিছু ঘটনা আমাদের ইন্দ্রিয়কে ফাঁকি দিয়ে ঘটে যায়। বিজ্ঞান দিয়ে একে ব্যাখ্যা করা যায় না। বিজ্ঞান এখনো সবকিছুর ব্যাখ্যা দিতে পারেনি। ধর্ম থেকে কি যুক্তিসঙ্গত হতে পারে? সৃষ্টিকর্তা চাইলে সব পারে— এর চেয়ে আরামদায়ক বাক্য পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই।
প্রথমে পুরো ব্যাপারটা অশরীরী লাগলেও ক্রমেই সেটা ক্ষমতায় রূপ নিল। তবে গল্পগুলো লিখতে হয় উত্তম পুরুষে। নাসের এখন ইচ্ছামতো নিজের জীবনের ঘটনা পরিবর্তন করে। সে টের পেয়েছে বর্তমান বলতে কিছু নেই। অতীত আর ভবিষ্যতের ভেতর দুলছি আমরা।
পরের মাসগুলোতে খুব দ্রুত কিছু ঘটনা ঘটল। বেশ কিছুদিন আগে তিনি লটারি কিনেছিলেন দুটো। তিনি সাধারণত এসবের ভেতর যান না। জীবনের ইতিহাসে লটারিতে একটি সামান্য সাবান পাওয়ার রেকর্ড ও তার নেই। সেদিন কী ভেবে কিনলেন কে জানে।
সেই লটারির রেজাল্ট দিল দুইদিন আগে। সেখানে নাসের পেয়েছেন ৪০ লাখ টাকা। ইদানিং বইয়ের কাটতিও হুহু করে বাড়ছে৷ সেই সাথে বাড়ছে প্রসিদ্ধি। প্রায়ই সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য বাসায় লোক আসে, কেউ কেউ সামাজিক মাধ্যমে তাকে লাইভে ডাকে।
এক দুপুরে গ্রাম থেকে খবর আসে তাদের ভিটাবাড়ি আগুনে ছাই হয়ে গেছে। কারো সাথে আক্ষরিক অর্থে যোগাযোগ ছিল না। মানুষের মুখে মুখে কান পর্যন্ত চলে এলো। বাড়ি থেকে একটা সুতাও অক্ষত অবস্থায় পাওয়া যায়নি।
এই সংবাদ নাসেরকে স্পর্শ করে না। নির্বিকারভাবে সে বসে থাকে কম্পিউটারের সামনে কিংবা খাতা কলম নিয়ে। এরমধ্যে যুথীর অসুস্থ মা শনিবার সন্ধ্যাবেলা কাশতে কাশতে মারা গেল। শাশুড়িকে নিয়ে তার বিরক্তির শেষ ছিল না। একে তো টানাপোড়েনের সংসার, তার ওপর প্রতিদিন এই চাই, ওটা চাই… রাতের বেলা টয়লেটে যেতে ডাকাডাকি… কী যন্ত্রণা!
‘এগুলো তুমি কেন করতেছ?’ যুথী কাঁদতে কাঁদতে একদিন জিজ্ঞেস করেই ফেলল।
‘কি করছি?’
‘তুমি নিজে জানো না?’
‘আমি কীভাবে বলব? সময় হইলে মানুষ মরবে না ধইরা রাখবো নাকি?’
‘আমি জানি তুমিই এগুলা করতেছো। সেদিন আমাকে গল্প সত্যি হওয়ার ব্যাপারটা বলছো। ভুলে গেছো? তুমি ভাইবো না আমি কিছু বুঝি না। আই আন্ডারস্ট্যান্ড এভরিথিং।’
চুপ করে দাঁত দিয়ে নখ কাটছিল নাসের।
‘দেখো তুমি যদি এসব বন্ধ না করো আমি সবাইকে বলে দিবো’ ফুপিয়ে ফুপিয়ে বলে ওঠে যুথী।
হঠাৎ করে নাসেরের মাথায় আগুন ধরে গেল। সে আর নাসের নেই। যুথীর চুলের মুঠি আঙুলে ভরে চিৎকার করে বলল, ‘চোপ.. একদম চোপ… তোরে চোপ করানোর দায়িত্ব আমার.. দ্যাখ খালি।’
হিংস্র পশুর মতো জ্বলজ্বলে চোখ দেখে যুথী প্রচণ্ড ভয় পেল। কিছুদিনের ভেতর প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে রইল। মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হচ্ছে না।
যুথী জানত খুব বেশিদিন তার বেঁচে থাকা সম্ভব হবে না।
তবে হাল ছাড়ল না যুথী।
অঞ্জুর মা কে নিয়ে মাঠে নেমে পড়ে সে। বিছনায় শুয়ে চোখের পানি ফেলা ছাড়া সে আর তেমন কিছুই করতে পারে না।
দিনের পর দিন শরীর খারাপ হচ্ছে। রান্নাবান্না, ঘরমোছা থেকে শুরু করে নাসেরের যত্নআত্তি বেশিরভাগ সময় এখন অঞ্জুর মা নেয়।
যুথী বিছানায় শুয়ে শুয়ে কি যেন ভাবে। কেবল ভাবে। কেবলই ভাবে।
কয়েকমাস পরের কথা।
তখন শরৎকাল। নাসেরের ঘুম ভেঙেছে কিছুক্ষণ আগে। ক’টা বাজে বিছানায় শুয়ে অনুমান করতে পারে না। আশেপাশের সাদা রং বিশেষভাবে তার মনোযোগ কাড়ে। বিছানার পাশেই স্টিলের একটা টেবিল। তার উপর সেদ্ধ ডিমের খোসা পড়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে বেশ আগের।
তখন শরৎকাল। নাসেরের ঘুম ভেঙেছে কিছুক্ষণ আগে। ক’টা বাজে বিছানায় শুয়ে অনুমান করতে পারে না। আশেপাশের সাদা রং বিশেষভাবে তার মনোযোগ কাড়ে। বিছানার পাশেই স্টিলের একটা টেবিল। তার উপর সেদ্ধ ডিমের খোসা পড়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে বেশ আগের। দরজার পাশে একটা লাল বালতি। বড়ো করে নিঃশ্বাস নিতেই নাকে ধাক্কা লাগে ফিনাইলের গন্ধ।
জায়গাটা পরিচিত নয়। তবে স্ট্রাকচার বিশ্লেষণ করে মনে হচ্ছে এটা কোনো হাসপাতাল। কিন্তু হাসপাতালে তার কী কাজ? তার কী এপিলেপটিক অ্যাটাক হয়েছিল? অনেক আগে থেকেই তার এপিলেপ্সি’র সমস্যা আছে। কয়েকমাস অন্তর অন্তর অ্যাটাক হয়। তখন প্রচণ্ড খিঁচুনি দিয়ে শরীর কাঁপে, হাত পা শক্ত হয়ে আসে,মুখ দিয়ে ফেনা পড়ে…ভীষণ খারাপ অবস্থা হয়।
অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও সে কিছুই মনে করতে পারে না। খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে। মনে হচ্ছে বহুদিন ধরে সে ঘুমিয়ে আছে। শেষ কী খেয়েছে তাও মনে নেই। সম্ভবত অঞ্জুর মা এক গ্লাস দুধ দিয়েছিল।
দুধ খাওয়ার পরই কী সে বেহুঁশ ঘুম দিলো? কী জানি..
বিছানা থেকে উঠতে যেয়ে নাসের টের পেল মাথাটা প্রচণ্ড ভারী হয়ে আছে। আবার সেই সমস্যাটা ফিরে এসেছে। মাথার ভেতর বাসা বেঁধেছে কেউ। আগেরবার একা ছিল, এবার বউ বাচ্চা নিয়ে এসেছে।
সে আর উঠার চেষ্টা করে না। চোখ বুজে শুয়ে থাকে। ধীরে ধীরে হাতের আশেপাশে একটা অস্বাভাবিক অনুভূতি তাকে নাড়াচাড়া দেয়। খানিক অবশ লাগে জায়গাটুকু। চোখ খুলতে ক্লান্ত লাগে তার। আধবোজা চোখে সেদিকে তাকাতেই গগনবিদারী চিৎকার দেয় সে…! নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। কবজির মাথাটা সাদা ব্যান্ডেজে মোড়ানো, এ কী! তার হাত কোথায়! আর আঙুলগুলো? ভয়ে কাঁপতে লাগল মামুন। ঘুম থেকে উঠে হাতবিহীন শরীর দেখার জন্য সে একদমই প্রস্তুত ছিল না।
আচমকা মনে পড়ল, সে লেখক হতে চেয়েছিল। সামান্য একজন লেখক। ধন-দৌলত,নারী, যশ কিছুই চাই না তার। শুধু কলম ধরার জায়গাটুকু চাই। নাসের মামুন হাউমাউ করে কাঁদছে। একজন পূর্ণবয়স্ক পুরুষমানুষ হাউমাউ করে কাঁদছে, এটি কোনো চমৎকার দৃশ্য নয়।
এভাবে কতক্ষণ গেল সে জানে না। সে কেবল কাঁদছে। কখনো নিঃশব্দে, কখনো তীব্র চিৎকার করে।
একসময় একজন ভদ্রমহিলা হাসিহাসি মুখে সাদা ট্রে হাতে কেবিনে ঢুকল। এই মহিলা তার পরিচিত। তার নাম যুথী, সম্পর্কে নাসেরের স্ত্রী। শাড়ি পড়ার স্টাইলের জন্য তাকে আজ দেখাচ্ছে টেলিভিশনের সংবাদ পাঠিকাদের মতো। হালকা মেকাপের জন্য চেহারার অসুস্থ ভাব প্রায় চাপা পড়ে গেছে।
কেবিনে ঢোকার সময় তার ট্রে’র একপাশ থেকে উঁকি দিচ্ছিল পাউরুটি, ডিম, কলা। এই তিন ভাই বোন হাসপাতালের জাতীয় খাবার। ভদ্রমহিলা স্টিলের টেবিলের উপর ট্রে রাখল। তার চোখেমুখে দুঃখের লেশমাত্র নেই। সে যেভাবে এলো, সেভাবেই নিঃশব্দে চলে গেল।
নাসের কেবিনে আবারও একা। তার চোখ ফেটে অনবরত পানি পড়ছে। পৃথিবীতে আর কত ধরনের কষ্ট আছে? মনে মনে ভাবে সে।
কিছুক্ষণ পর তার ক্ষুধা আবারও জানান দেয়।
হাতের কষ্ট ভুলে সে ভেজা চোখে উঁকি দেয় ট্রে’র দিকে। ডিম-কলার অন্যপাশে সাদা পলিথিনের একটা ব্যাগ রাখা। এই ব্যাগটাকে সে প্রথমে দেখেনি। তার কিঞ্চিৎ আগ্রহ হয়। শরীরটাকে ঠেলে পলিথিনের আরেকটু কাছে নিয়ে যায়। জিনিসটাকে সে দেখে— খুব কাছ থেকে। তার দু’টো চোখ উগড়ে আসতে চায়, নাড়িভুড়ি উল্টে আসে। সেখানে মোড়ানো আছে দুটো বিচ্ছিন্ন হাত…
প্রথমত পাঠক, দ্বিতীয়ত পাঠক, তৃতীয়ত লেখক।