উৎসর্গ
৺অমিতেন্দ্রনাথ ঠাকুর
(১৯২২-২০২১)
যিনি তাঁর লেখার ভিতর দিয়ে সুদূর প্রাচ্যের সঙ্গে আমার প্রজন্মের অনেকের প্রথম পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন
[হান-শান (৭৬০?-৮৪০? খ্রিস্টাব্দ) প্রাচীন চীনের একজন মহাযান বৌদ্ধ ভিক্ষুক এবং সর্বত্যাগী কবি। তাঁর বিচিত্র জীবনের কোনও প্রামাণিক তথ্যের, এমন কি তাঁর প্রকৃত নাম ও আয়ুষ্কালের, সন্ধান পাওয়া যাওয়া না, তিনি আজ সম্পূর্ণ ভাবে গল্পের মানুষ। তাঁর লেখা এবং অন্যান্য পরোক্ষ তথ্যসূত্র থেকে উদ্ধার করা গেছে যে, আর-পাঁচ জনের মতো তিনিও সংসারী ছিলেন, আনুমানিক ত্রিশ বছর বয়সে ঘর সংসার ছেড়ে চীনের পূর্ব সমুদ্র উপকূলের ঝেঝিয়াঙ প্রদেশে অবস্থিত তি’য়েন-তাই পর্বতমালায় বসবাস শুরু করেন। ইংরেজিতে ‘হান-শান’-এর শব্দার্থ ‘কোল্ড মাউন্টেন’(যার বঙ্গীয়করণ ক’রে আমরা নাম রাখলাম ‘তুষার পর্বত’); সেটিই আজ কবির নাম রূপে সর্বজনস্বীকৃত। সেই সময়ের চীনের লেখকরা প্রায় সকলেই ব্যতিক্রমহীন ভাবে লিপিশিল্পীও ছিলেন; হান-শানের না ছিল লেখার কাগজ এবং কালি-কলম, না ছিল ছবি আঁকার তুলি। পাথরের চাঙড়ে, গাছের গায়ে, কখনও-কখনও বন্ধুর ডেরার দেওয়ালে, তিনি কবিতা লিখে রাখতেন। তাঁর শুভানুধ্যায়ীরা সেই কবিতাগুলির নকল সংরক্ষণ ক’রে অন্তত তিনশোটি কবিতা নিশ্চিত অবলুপ্তি থেকে বাঁচিয়েছেন। একজন পৃষ্ঠপোষকের অসমর্থিত সংবাদও পাওয়া গেছে, লু-চি’উ য়িন, কিন্তু প্রসঙ্গটি বিতর্কে উত্তাল।
হান-শানের অভিন্নহৃদয় বন্ধু শীহ্-তে-র গুণকীর্তন না করতে পারলে আমাদের এই প্রশস্তি অর্ধসমাপ্ত রয়ে যাবে। শীহ্-তে ছিলেন সন্ন্যাসী, কবি, এবং তি’য়েন-তাই পর্বতমালায় অবস্থিত গুওকিঙ মন্দির-সংলগ্ন মঠের রন্ধনশালার কর্মী। রান্নাঘরের উদ্বৃত্ত খাবার তাঁর বন্ধুর জন্য প্রত্যহ গুছিয়ে রাখতেন তিনি, এক সময়ে হান-শান উপস্থিত হতেন রান্নাঘরে, এবং সংগৃহীত খাবার নিয়ে তাঁরা দু’জন হই-হই করতে-করতে মঠ ছেড়ে বেরিয়ে যেতেন। আশ্রমবাসীদের কাছে তাঁদের বিশেষ একটা যৌথ পরিচয় জুটে গিয়েছিল: ‘পাগলা-সন্ন্যাসী’। চীনের চিত্রকলায় দুই বন্ধুর জুটি এক বিশিষ্ট স্থান ক’রে নিয়েছে, অজস্রবার তাঁদের প্রতিকৃতি আঁকা হয়েছে, প্রায় প্রতিবারই রন্ধনশালার কর্মী শীহ্-তে-কে চিনিয়ে দেবার জন্য তাঁর হাতে চিত্রশিল্পী একটা বিশালাকার ঝাড়ু তুলে দিয়েছেন।
আমরা যে-সময়ের আলোচনা করছি, তারও তিন শতাব্দী পূর্বে দক্ষিণ ভারতের কাঞ্চিপুরমের প্রাক্তন রাজকুমার বোধিধর্ম সন্ন্যাস গ্রহণ ক’রে, বৌদ্ধধর্ম প্রচারের উদ্দেশে চীনে উপস্থিত হয়েছিলেন (৫২০ খ্রিস্টাব্দ)। তাঁর দ্বারা প্রচারিত ‘ধ্যান’ থেকে চীনে ‘চা’ন’ সাহিত্য উৎপন্ন হতে বেশ কয়েকটি শতাব্দী কেটে যায়। আমাদের মনে রাখতে হবে ‘চা’ন’ সাহিত্যে চীনের ‘তাও’ ধর্মের বহু উপাদানের সংমিশ্রণ ঘটেছে, এবং, সেই কারণে ‘চা’ন’-র উদ্ভাবনে ভারতীয় দর্শনের ভূমিকা পরোক্ষ। হান-শানের লেখার সঙ্গে ‘তাও’ ধর্মের নিবিড় সংযোগ লক্ষণীয়। তিনি বারংবার ‘পথ’-এর সূক্ষ্ম অস্তিত্বের দিকে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন, এটি তাঁর ‘তাও’ শিকড়ের লক্ষণ। এই বঙ্গানুবাদ হান-শানের লেখার ইংরেজি অনুবাদ থেকে প্রস্তুত করা হয়েছে। পাঠকের সুবিধার্থে ক্রমিক সংখ্যা ব্যবহার করা হয়েছে।]
—গৌতম বসু
১.
কয়েক বছর আগে, হঠাৎ
আমার বাড়িওয়ালীর অনেক ধনসম্পত্তি হলো।
যে ছিল আমার চেয়েও গরীব,
পিছিয়ে পড়েছি ব’লে, সে এখন আমার পানে চেয়ে হাসে।
আর আমি হাসি, সে এগিয়ে গেছে ব’লে।
আমরা দু’জনেই হাসি, হেসেই চলি, কে থামাবে আমাদের!
একজন দেশের সম্রাজ্ঞী, অন্যজন পশ্চিমপ্রদেশের প্রভু।
[ঋণস্বীকার: জে. পি. সীটন]
২.
শুভ্রদেহী সারস পাখিটি, মুখে তেতো-স্বাদের একটা ফুল নিয়ে উড়ছিল,
প্রতি চারশো মাইল পার হবার পর, মাত্র একটিবার বিশ্রাম।
সে যেতে চায় সেই পে’ঙ্গাই দ্বীপে,
যেখানে সমস্ত পরীদের বাস।
দীর্ঘ পথের খাদ্য মাত্র ওই একটি ফুল,
প্রথমে তার গায়ের পালক ঝ’রে পড়তে লাগল, তারপর,
সঙ্গীদের থেকে সে যখন অনেক দূরে, খুলে পড়ল তার হৃৎপিণ্ডটাও।
নিজের ছোট্ট বাসাটির জন্য তার মন-কেমন করল খুব,
কিন্তু, তার বৌ-ছেলে সে-কথা জানতেই পারল না।
[ঋণস্বীকার: জে. পি. সীটন]
৩.
তুষার পর্বতে এসে বসবাস শুরু করবার পর,
যেন কত হাজার বছর পার হয়ে গেছে…
দৈবক্রম আর রূপান্তর মেনে, এক প্রস্রবণের ধারের এক ঝোপে
আমি লুকিয়ে বসেছিলাম, চুপটি ক’রে দেখতাম সবকিছু, পরিতুষ্ট ছিলাম।
এই খাড়া, উঁচু পাহাড় থেকে বেরিয়ে আসে না বিশেষ কেউ,
কেবল শ্বেতশুভ্র মেঘ কখনও-কখনও আমায় ছুঁয়ে, পেরিয়ে যায়…
শুয়ে থাকার জন্য কোমল ঘাস,
গায়ের ঢাকা বলতে নীলাকাশ,
মাথায় পাথরখণ্ডের বালিশ। আমি সুখী, বেঁচে আছি।
সমস্ত বদলের দায়, স্বর্গ ও মর্তের ’পরে আমি ছেড়ে দিয়েছি।
[ঋণস্বীকার: জে. পি. সীটন]
৪.
ব’সে আছি, সর্বোচ্চ চূড়ার পানে চেয়ে আছি অপলক,
যেদিকেই চাই, দূর, বহুদুর, দূরের শেষ দেখা যায় না।
সম্পূর্ণ একা আমি, কেউ জানে না আমি কোথায়,
পুকুরের শীতল জলে, নিঃসঙ্গ এক চন্দ্রমার প্রতিবিম্ব প’ড়ে আছে।
নিচের পুকুরে ঐ, প্রকৃত চন্দ্রমা নেই:
চন্দ্রমা একটিই, রয়েছে ঊর্ধ্বে, আকাশে।
এইখানে ব’সে আমি তোমায় একটি গান শোনাচ্ছি বটে,
কিন্তু, জেনো, এ-গানে ধ্যান নেই কোনও।
[ঋণস্বীকার: আর্থর ওয়েলী]
৫.
কেন যে এত মন–খারাপ ক’রে থাকি?
মানুষের জীবন অবিকল প্রভাতবেলার ছত্রাকের মতো।
মাত্র কয়েক গণ্ডা বছরের অবসরে, এতজন
নূতন ও পুরাতন বন্ধুর বিদায়গ্রহণ, কে সইতে পারে?
এই ভাবে, দুঃখে আমি পরিপূর্ণ,
এমন এক দুঃখ, যা বহন করার সাধ্য আমার নেই।
কী করব আমি? বলো, আমি কী ক’রে উঠতে পারি?
আমার এই জীর্ণ দেহ ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যাও, লুকিয়ে রাখো পর্বতকন্দরে।
[ঋণস্বীকার: বর্টন ওয়াট্সন]
৬.
তৃতীয় মাসে, গুটিপোকাগুলি যখন ততটা বড় হয়ে ওঠে নি
বালিকাদের সময় হল ফুল কুড়োবার,
দেওয়ালের ধার ঘেঁষে, তারা ছুটে-ছুটে প্রজাপতিদের সঙ্গে খেলত,
ডোবার পাড় থেকে ঢিল ছুঁড়ত বুড়ো ব্যাঙটার দিকে।
কোঁচড়ে ভ’রে নিত পাকা কুল।
সোনার তৈরি চুলের কাঁটা দিয়ে বাঁশগাছের অঙ্কুর খুঁড়ে তুলত।
বাইরের অত ঝলমলানি নিয়ে, তুষার পর্বত,
তুমি কি এই বালিকাদের সঙ্গে পেরে উঠবে?
[ঋণস্বীকার: আর্থর ওয়েলী]
৭.
লোকে আমার কাছে তুষার পর্বতে পৌঁছবার পথ জানতে চায়
তুষার পর্বত: এখানে পৌঁছবার কোনও সোজা রাস্তা নেই।
গ্রীষ্মকালেও এখানে বরফ গলে না
চক্রাকারে ঘূর্ণায়মান কুয়াশার মধ্য থেকে ঝাপ্সা সূর্য ওঠে।
কী ক’রে পৌঁছলাম এতদূর?
আমার অন্তর তোমার মতো নয়।
তোমার অন্তর আমার অন্তরের মতো হত যদি
তুমিও সন্ধান পেতে ঠিক, আমার পাশে হতে উপস্থিত।
[ঋণস্বীকার: গ্যারী স্নাইডর]
৮.
সংসারী মানুষেরা যখন মেঘেদের ফাঁকে এই পথের সন্ধান করে
সে যে ঠিক কোথায়, তার সমস্ত চিহ্ন মুছে ফেলে, অদৃশ্য হয় পথ।
উঁচু শিখরগুলির কোলে অগণিত খাদ;
সবচেয়ে প্রশস্ত গিরিপথেও, দেখি, সূর্যকিরণ এসে নামে না।
হরিৎবর্ণ দুয়ারগুলি একে-একে বন্ধ হতে থাকে সমুখে পশ্চাতে;
পুবে,পশ্চিমে শুভ্র মেঘপুঞ্জ জড়ো হয়।
মেঘের পথ কোথায়, জানতে চাও?
মেঘের পথ চ’লে যায় এক আকাশ হতে অন্য আকাশে।
[ঋণস্বীকার: আর্থর ওয়েলী]
৯.
নিজের কথা উঠলে, বলি, কুয়াশায় জড়ানো লতাবনের মাঝ দিয়ে,
পাথুরে গুহার পাশ দিয়ে বহমান সাধারণ দৈনন্দিন পথেই আমি খুশী।
এইখানে এই পরিত্যক্ত প্রান্তরে আমি সম্পূর্ণ স্বাধীন,
শাদা, অলসমন্থর মেঘেদের বন্ধুসঙ্গে বেশ আছি।
রাস্তা এখানে আছে ঠিকই, কিন্তু তারা কেউই জগৎসংসারে পৌঁছয় না।
মন আমার শূন্যময়, কে জাগাবে ভাবনাপ্রবাহ আমার ভিতর?
পাথরের শয্যায় ব’সে আছি রাত্রিকালে, একা,
গোলাকার চাঁদ ধীরে-ধীরে তুষার পর্বতের গা বেয়ে উঠছে।
[ঋণস্বীকার: বর্টন ওয়াট্সন]
১০.
গতকাল, নদীর ধারের গাছটিকে লক্ষ করছিলাম,
দুমড়ে মুচড়ে এমন ভাবে ভেঙে প’ড়ে রয়েছে যে, চোখে দেখা যায় না।
হাজার কুঠারফলকের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত,
কেবল দু-তিনটে গুঁড়িই তখনও দাঁড়িয়ে রয়েছে।
হলুদ হয়ে–যাওয়া পাতাগুলি ঝরিয়ে দিচ্ছে জমাট হিমকণা,
নদীর মৃদু ঢেউ, শুকিয়ে-আসা, কুঞ্চিত শিকড় কুরে কুরে খাচ্ছে।
জীবিতদের জন্য জীবনধারণ এইরকমই,
স্বর্গলোক ও মর্তলোককে অভিসম্পাত দিয়ে কী লাভ?
[ঋণস্বীকার: বর্টন ওয়াট্সন]
জন্ম ১৩ মে, ১৯৫৫ / ২৯ বৈশাখ ১৩৬২, দার্জিলিং, পশ্চিমবঙ্গ। প্রকাশিত বই : ১. অন্নপূর্ণা ও শুভকাল [১৩৮৮/১৯৮১, লেখক কর্তৃক প্রকাশিত] ২. অতিশয় তৃণাঙ্কুর পথে [১৩৯৮/১৯৯১, মহঃ রফিক, ‘বাক্চর্চা’, বর্ধমান] ৩. রসাতল [১৪০৮/২০০১, ইন্দ্রাণী অনির্বাণ, ‘অনুবর্তন’, কলকাতা] ৪. নয়নপথগামী [১৪১৪/২০০৭, গৌতম মণ্ডল, ‘আদম’, কৃষ্ণনগর, নদীয়া] ৫. কবিতা সমগ্র [১৪১৪/২০০৮, সুবীর মণ্ডল, ‘কবীর’, কলকাতা] ৬. স্বর্ণগরুড়চূড়া [১৪২০/২০১৩, স্বাতী রায়চৌধুরী, ‘সপ্তর্ষি প্রকাশন’, কলকাতা] ৭. কবিতাসংগ্রহ [১৪২১/২০১৫, গৌতম মণ্ডল, ‘আদম’, কৃষ্ণনগর, নদীয়া] গ্রন্থ-সম্পাদনা : ১. শ্রেষ্ঠ কবিতা দেবদাস আচার্য [২০০৮, গৌতম মণ্ডল, ‘আদম’, কৃষ্ণনগর, নদীয়া] ২. সঞ্জয় ভট্টাচার্যের কবিতা (যৌথ সম্পাদনা, ভূমেন্দ্র গুহ-এর সঙ্গে) [২০১৩, অণিমা বিশ্বাস,‘গাঙচিল’, কলকাতা] পুরস্কার (কবির অনিচ্ছাসত্ত্বেও এ তথ্য সন্নিবেশিত হলো) : ১. বীরেন্দ্র পুরস্কার ২০০৩—’রসাতল’-এর জন্য (এটি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় স্মরণ কমিটি কর্তৃক প্রদত্ত একটি বার্ষিক পুরস্কার) ২. রবীন্দ্র স্মৃতি পুরস্কার ২০১৫—’স্বর্ণগরুড়চূড়া’-এর জন্য (পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত বার্ষিক পুরস্কার)