মঙ্গলবার, ডিসেম্বর ৩

হামিরউদ্দিন মিদ্যার রবিবারের ধারাবাহিক : ধুলোমাটির ভুবন | পর্ব-০৫ | মাছের সেকাল, মাছের একাল

0

মাছের সেকাল, মাছের একাল


পুঁটিমাছের চরচরানি
ভাত দে লো পাটের রানী
চিংড়ি মাছ কচকচা
রাঁধতে হবে ভাজাভাজা।

মাছ নিয়ে গাঁ-গ্রামে কতরকম প্রবাদই না চালু আছে! মাঠেঘাটে, খালে-বিলে-নদীতে, ডহরে এখন আর তেমন মাছ কোথায়! দাদো-দাদিরা তাই দুঃখ করে বলে, সেই দিনকাল আর নাই রে ভাই! আগে ঝুড়ি ঝুড়ি মাছ উঠোনে শুকোতে দিয়েছি। কাক-পক্ষী, মুরগীতে খেয়েও শেষ করতে পারতনি। পাড়াদিকে তখন শুটকি শুকানোর গন্ধে ঢোকা যেতনি। কুটুম এলে মাছ পচা গন্ধে ছুটে পালাত।

কথাগুলো অবিশ্বাস হয় না। ঝুড়ি ঝুড়ি মাছ না দেখলেও ছোটোবেলায় দেখেছি আশ্বিন মাস পড়লেই ধানজমির আলে ঘাঁই কেটে ঘুনি দিয়ে আসত আব্বা, পরেরদিন সকালে ঘুনি তুলে আনলে পেছে ভরতি হয়ে যেত চুনোপুঁটি, গুঁতে, চিংড়িতে। রহিমকাকা ‘আঁড়াখাল’ করত। মাঠে খাল করে আলে ঘাঁই কেটে একটা বাঁশের চোঙ, কিংবা সরকাঠির বোনা বেড়া বা ছেড়া লাগিয়ে দিত। উজোনি জলে সারারাত কুবকাব করে চ্যাং, ল্যাঠা মাছ পড়ত খালে। সেই মাছ সূর্য উঠার আগেই মাঠে গিয়ে আঁড়াখাল থেকে তুলে খালুই, বালতি ভর্তি করে নিয়ে আসত কাকা। খাবার মতো রেখে কলাতলার ডোবায় মাছগুলো ‘জিইয়ে’ রাখত অসময়ের তরকারির জন্য। যেদিন বেশি মাছ পড়ত, সোনামুখীর আড়তেও দিয়ে আসত কাকা। তবে তখন এত মাছের দাম থাকেনি।

মাঠে খাল করে আলে ঘাঁই কেটে একটা বাঁশের চোঙ, কিংবা সরকাঠির বোনা বেড়া বা ছেড়া লাগিয়ে দিত। উজোনি জলে সারারাত কুবকাব করে চ্যাং, ল্যাঠা মাছ পড়ত খালে। সেই মাছ সূর্য উঠার আগেই মাঠে গিয়ে আঁড়াখাল থেকে তুলে খালুই, বালতি ভর্তি করে নিয়ে আসত কাকা। খাবার মতো রেখে কলাতলার ডোবায় মাছগুলো ‘জিইয়ে’ রাখত অসময়ের তরকারির জন্য। যেদিন বেশি মাছ পড়ত, সোনামুখীর আড়তেও দিয়ে আসত কাকা।

জলের পোকা ছিল আমার ছোটো ফুপু। ছাকনি জাল নিয়ে সেরিনা ফুপু এ-পুকুর সে-পুকুর ঘুরে ঘুরে, দলদামড়ার ভেতর জাল ঢুকিয়ে চিংড়ি মাছ ধরত। ধরে ধরে কোমরে বাঁধা গামছার আঁচলে রাখত। শুধু সেরিনা ফুপু নয়, ফুপুর সমবয়সী পাড়ার অনেক মেয়েই মাছ ধরতে যেত।

আমাদের গ্রামে পাঁচ-ছ’টা বড়ো বড়ো পুকুর। মোড়লগোড়ে, রূপপালি, তালবোনা, পদ্মপুকুর, ডুমুরজলা, বাঁধি। তরকারির জন্য নিজের গ্রামের ছেলেমেয়েরা চুনোপুঁটি, চিংড়ি ধরলে কেউ বাধা দিত না। তখন বাইরের মাছ চাষিদের গ্রামের দিকে এত নজর পড়েনি। পুকুরগুলোর যারা অংশিদার, তারাই চাষ করত। মাছ ধরা হলে যার যেমন অংশ সেই অনুপাতে ভাগ ফেলে দেওয়া হতো।

এক-একটা পুকুর দশ বছর পনেরো বছরের কমে জল সেঁচে মাটি কাটানো হতো না। ফলে পদ্ম, শালুক, পানিফল, কলমির দলদামড়ায় ভরে থাকত পুকুরগুলো। জাল টানা ছিল খুবই হ্যাপার কাজ। অনেক পুরনো পুরনো মাছ ঘাঁপটি মেরে থাকত পুকুরে।

সেরিনা ফুপু মাছ ধরে ভিজে কাপড়ে লপ লপ করে এসে আঁচলটা উঠোনে ঢেলে দিত। আর জ্যান্ত চিংড়িগুলো রোদে ছটফট করত। দু-একদিন তুলে আনত পানিফল, শাপলা ফুল, শালুক, পদ্মটাঁঠি। ছোটোবেলায় সেইসব সম্পদ ছিল আমার কাছে হীরে-জহরত, মণিমাণিক্যের সমান।

সেরিনা ফুপুর খেলার সাথী ছিল পাড়ার সুলতানা, সনজুরা, তহুরা ফুপুরা। শাপলার ফল ‘ঢ্যাপ’ তুলে আনত। ভেতরে কালো কালো মোটা বালির দানার মতো বীজ। লাল ঢ্যাপও হয়। লাল ঢ্যাপের লাল বীজ। কথিত ছিল—‘ও লো সই লাল ঢ্যাপ খাস না। খেলে লাল লাল ছেলে হবে।’ লাল ছেলে হোক কে চায়! ভয়ে ওই ঢ্যাপ কেউই খেত না। কালো ঢ্যাপেরই ছিল বেশি কদর। কালো ঢ্যাপের বীজ শুকনো পাশ মাখিয়ে রোদে শুকোতে দিত। তারপর ঝরঝরে হয়ে গেলে অর্জুন তলাই চুলো কেটে মাটির খোলায় বালি গরম করে কুচি কাঠি দিয়ে ঢ্যাপের মুড়ি ভাজত। শোলার মতো নরম ফসফসে গোল গোল দানা। কী স্বাদ!

আমার দাদো ছিল মেছেল। ছিপ ফেলে মাছ ধরার নেশা ছিল খুব। টগি, ঝিম, মাছধরার বিভিন্ন চার কিনে রাখত দাদো। বর্ষায় নদীতে জল বাড়লে দামদরেও মাছ ধরতে যেত। মুড়ি, পেঁয়াজ, কাঁচালঙ্কা নিয়ে চলে যেত সকাল সকাল। ফিরত অনেক বেলাবেলি।

আমার স্কুলের ছুটি পড়েছে। দাদো বলল, নদী যাবি আমার সাথে?

তখন আমার দেখা নদী বলতে ছিল শালি নদী। শীতকালে জল শুকিয়ে বালির চর জাগলে শুকুরকাকা গরুর গাড়ি নিয়ে বালি আনতে যেত নদীতে। কাকার সঙ্গে আমি, আমার চাচাতো ভাই শরিফুল, বড়ো ফুপুর ছেলে খাইরুল কতবার যে গেছি। শালি নদী হলো একটা সরু লিকলিকে নদী। দামোদর হলো বড়ো গাঙ। দাদো মাছ ধরে এসে বড়ো গাঙের কত গল্প শোনাত। আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। চোখ বুজে কল্পনা করতাম, কত বড়ো নদী! একূল ওকূল পাড় ভাঙে। বড়ো বড়ো নৌকা ভেসে যায় মাঝ গাঙের দিকে। সেই দামোদরে মাছ ধরতে যাওয়ার জন্য দাদো আমাকে সঙ্গী করবে! এমন সুযোগ কেউ ছাড়ে!

সকাল সকাল রওনা হলাম। ক্যানেলের পাড় পেরিয়ে মাঠের মোটা আলপথ ধরে হেঁটে হেঁটে ধুলাই। তারপর পাকা রাস্তায় উঠে সোজা রাঙামাটি। দাদোর কাঁধে ছিপ, টগি। আমার হাতে থলে। থলেতে কস্তুরী, মদের মিয়া, খোলভাজা বিভিন্ন সুগন্ধী চার, মাছধরার নানান সরঞ্জাম। মুড়ি আর খাবার জল ভরে দিয়েছে দাদি।

দাদো আমাকে নিয়ে গেল করমচাঁদের ঘাটে। ও বাবারে বাবা! কী জল! কী জল! শেষ আষাঢ়ের দামোদর কেলে সাপের মতো ফোঁসফোঁস করছে। ওই দূরে বর্ধমান জেলার কোনো গ্রামের তালগাছ, টিনের চাল, ইঁটভাটার চিমনি দেখা যাচ্ছে। আমার মনে পড়ে যাচ্ছিল কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিকের সেই কবিতাটা— ‘বাড়ি আমার ভাঙনধরা অজয় নদীর বাঁকে, জল যেখানে সোহাগ ভরে স্থলকে ঘিরে রাখে।’

নদী পাড়ের কুলডাঙা, ছিলামপুর, ভাগলুই এই গ্রামগুলোর ভবিষ্যত কী? নদী যদি কোনো কারণে রুষ্ট হয়, তাহলে সব ভেসে যাবে। ঘর-বাড়ি, গোয়াল, দরমা, হাঁস-মুরগি, গোরু-ছাগল। তখন জলের দিকে আঙুল বাড়িয়ে বলতে হবে, জানিস ওখানে একটা গ্রাম ছিল।

সোহাগ দিয়েই তো স্থলকে ঘিরে রাখে নদী। নদী পাড়ের কুলডাঙা, ছিলামপুর, ভাগলুই এই গ্রামগুলোর ভবিষ্যত কী? নদী যদি কোনো কারণে রুষ্ট হয়, তাহলে সব ভেসে যাবে। ঘর-বাড়ি, গোয়াল, দরমা, হাঁস-মুরগি, গোরু-ছাগল। তখন জলের দিকে আঙুল বাড়িয়ে বলতে হবে, জানিস ওখানে একটা গ্রাম ছিল। ওই যে নৌকাটা চলছে, ওখানে আমাদের ঘর ছিল। উঠোন ছিল। একটা ছাতিমগাছ ছিল। সব ইতিহাস হয়ে যাবে।

করমচাঁদের খেয়াখাটে নৌকা পারাপার হয়। ঘাটটাই দহ পড়ে পড়ে অনেক গভীরতার সৃষ্টি হয়েছে। নদীর মূল স্রোত এখানে বাধা পায়। পুকুরের মতো একটা বড়ো খাল। জল স্থির। ছিপ ফেলতে গেলে তো স্থির জলই চাই। নাহলে মাছে টোপ খেলে ফাতনার নড়াচড়া যে বোঝা যাবে না!

বাঁশতলায় খড় বিছিয়ে একটা লোক ছিপ ফেলেছে। কাছে গিয়ে দেখি, মাছ রাখার জালে কেজি তিনেক ওজনের একটা কালবাউশ খাবি খাচ্ছে।

লোকটা বলল, কোথা থেকে গো তুমরা?

দাদো বলল, সেই পাথরহাটি, রূপপাল।

তুমাদের চঁঙ বটে বাপু! এতদূর থেকে মাছ ধরতে এইচ!

দাদো বলল, মাছ ঠুকারছে?

ওই মাঝে মাঝে খাচ্ছে। এত জলে বোঝা মুশকিল। তা তুমরা বসবে কুথায়! ডিহিপাড়ার ঘাটে গেলেনি কেনে! ওধারে মাছ ভালো উঠছে।

দাদো বলল, একটু নিরিবিলি জায়গা দেখে বসব বলে তো এলাম। ওখানে যা ভিড়!

এখানে তো আমি চার দিয়েছি। এক কাজ করো, তুমি বরং খেয়াঘাটের ওপাশটাই যাও। ওখানেও দহ পড়েছে। চার ফেলে বসো গা।

গাছতলায় কতকগুলো যাত্রী বসে আছে নদীর দিকে চেয়ে। অনেক দূরে তাকাতে চোখে পড়ল একটা যাত্রী বোঝাই নৌকা এগিয়ে যাচ্ছে। সবাইকে নামিয়ে দিয়ে, ওপারে যাত্রী বোঝাই করে আবার এপারে ফিরে আসবে। জল বয়ে যাচ্ছে পশ্চিম থেকে পুবে। পুব হলো নিচু। এই নদীর জল গিয়ে মিশবে হুগলি নদীতে।

এপাশে একটা বড়ো অর্জুন গাছ। অর্জুন তলায় বসে দাদো চারগুলোয় ভিজে মাটি মিশিয়ে গোল গোল লাড্ডু বানাল। তারপর জলে ছুড়ে দিল। কুব কাব শব্দ হলো। জলের তলায় মাছেরা চারের গন্ধে হাজির হবে।

দাদো ছিপ ফেলে বসে থাকে। বুড়োর কত ধৈর্য। বকের মতো চেয়ে থাকে ফাতনার দিকে। কখন মাছে ঠোকরাবে! ময়দার টোপ, পাউরুটির টোপ লাগানো হচ্ছে বঁড়শিতে। ‘কুরকুট’ মেশানো। অপরিণত সাদা সাদা ডেঁয়ো পিঁপড়ের বাচ্চা হলো কুরকুট। কেউ কেউ উইমাটির ঢিবি খুঁড়ে উইপোকাও টোপের সাথে মেশায়। মাছেদের খুব প্রিয় খাবার।

আমি খেয়াঘাটের আশেপাশে ঘুরঘুর করি। ওপার থেকে নৌকা এসে এপারে ভিড়ল। মাঝি পাটাতন ফেলে রশি বাঁধছে বাঁশের খুঁটির সঙ্গে। যাত্রীরা একে একে নেমে গেল। বুড়ো-বুড়ি, মেয়ে-মরদ, বাচ্চা ছেলে কোলে মা। হয়তো বাপের বাড়ি থেকে ফিরছে, কিংবা এপারে বাপের বাড়ি। কত মানুষ! কত জায়গায় তাদের ঘর! দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মানুষজনের যাওয়া আসা দেখি। আর মাঝেমাঝেই দাদোর কাছে গিয়ে দেখি মাছ পেয়েছে কি না।

দাদোর ভাগ্যটা খারাপ, বেলা বেড়ে সূর্য মাথার ওপর উঠে গেল, এখনও একটা মাছ পাড়তে পারেনি। এদিকে ওপাশের সেই লোকটাকে দেখো, তিন-তিনটে মাছ পেয়েছে।

আমার হাতে পয়সা দিয়ে দাদো বলল, বাস মোড়ের কাছে চা-চপের দোকান আছে। চপ কিনে আন যা। মুড়ি খাব।

সেই টগির সুতোয় একসময় টান পড়ল। চড়চড় করে সুতো খুলতে থাকে মাছটা। দাদোর মুখ উজ্জ্বল দেখায়। সুতো ধরে ধীরে ধীরে গোটাতে থাকে। মাছটা যত কাছাকাছি আসে, তত তেজ দেখায়। জল ঘাটিয়ে দো-মাতাল করে দিচ্ছে। আঁকশি জালটা দিয়ে মাছটাকে তুলে নেয় দাদো। বাপরে বাপ! সে কী মাছ! কেজি ছয়েক তো হবেই।

আমি চপ কিনে আনি। দাদো ছিপ ফেলে রেখেই ঘাটে হাত-পা ধুয়ে আসে। তারপর মুড়ি খেতে বসি। খিদেই পেট চুঁইচুঁই করছিল। মুড়ি খেয়ে একটু ধাতস্থ হই। দাদো আবার ছিপের কাছে গিয়ে বসে। একটা টগি ফেলে রেখেছিল। দশটা বঁড়শি লাগানো টগি। সেই টগির সুতোয় একসময় টান পড়ল। চড়চড় করে সুতো খুলতে থাকে মাছটা। দাদোর মুখ উজ্জ্বল দেখায়। সুতো ধরে ধীরে ধীরে গোটাতে থাকে। মাছটা যত কাছাকাছি আসে, তত তেজ দেখায়। জল ঘাটিয়ে দো-মাতাল করে দিচ্ছে। আঁকশি জালটা দিয়ে মাছটাকে তুলে নেয় দাদো। বাপরে বাপ! সে কী মাছ! কেজি ছয়েক তো হবেই। দামোদরের পুরনো মাছ। খেয়াঘাটে নৌকা ধরতে আসা কিছু লোকজনও মাছটা দেখতে আসে। কেউ কেউ বলে, চাচা বিক্রি করবেনি? কাটবে তো কাটো, আমরা সব ভাগাচারি করে নিই। এমন মাছ আর দেখা যায় না গো!

দাদো বলল, না গো! এই মাছ আমি কাঁধে করে বাড়িতে নিয়ে যাব।

দাদোর ইচ্ছে দাদিকে মাছটা দেখাবে। হয়তো পর পর দু’দিন এসেছে, মাছ পায়নি। তখন দাদি কথা শোনাত, খামোকা যাও কেনে! একটাও মাছ আনতে পারছনি, খুব আমার মেছেল হয়েছে!

দাদো আর ছিপ ফেলল না। মাছ কাঁধে নিয়ে বাড়ির পথ ধরল। রাস্তার লোকেরা চেয়ে চেয়ে মাছটাকে দেখছিল। বাহবা দিচ্ছিল দাদোকে, বটে বাপু! একখান পাকড়েছ!

দাদো বলল, জানিস, এমন একটা মাছ নিজের হাতে ধরব, তা কতদিনের ইচ্ছে! আজ সেই আশা পূরণ হলো।

দাদো মাছ নিয়ে কত কথায় না শোনায়। সোনামুখীর চৌধুরীবাবু নাকি একবার এগারো কেজি ওজনের একটা মাছ লাগিয়েছিল। টেনে তুলতে পারেনি একা। কিন্তু চৌধুরীবাবুও ছাড়বার পাত্র নন। ছিপটা হাত থেকে ছাড়েননি। কথায় বলে না, মাছের শক্তি জলে। সেই এগারো কেজি ওজনের মাছ চৌধুরীবাবুর মতো অমন একজন তাগড়াই মানুষকে টেনে নামিয়ে নিয়েছিল জলে। মাছ যত সুতো টেনে নিয়ে যায়, চৌধুরীবাবুও ছিপ ধরে ভেসে যেতে থাকে। কয়েকজন জেলে ডিঙি নৌকা নিয়ে মাছ ধরছিল নদীতে। ওরা দেখতে পেয়ে জালে খেয়া মেরে তুলেছিল মাছটাকে।

মোড়লগোড়ের পুকুরে একটা বিশাল বড়ো মাছ ছিল, জালে ধরা যেত না, হাঁস চরতে নামলে পা ধরে টেনে খেয়ে নিত। বাচ্চারা কেউ ভয়ে স্নান করতে নামত না। দাদোর মুখে শোনা কথাগুলো এখন গল্প মনে হয়।

সময় দ্রুত বদলে গেছে। গ্রামের পুকুরগুলো এখন চাষ করে বাইরের বড়ো বড়ো চাষিরা। মাছ চাষ করাই তাদের পেশা। মোটা টাকার বিনিময়ে একবছর তিনবছরের লিজ নেয়। কেউ মাছ ধরতে পাবে না। টলি টলি পোলট্রির লিটার, মল দিয়ে কয়েক মাসের ভেতরেই ছানা মাছকে বাড়িয়ে তোলে। যারা পুকুরে স্নান করত, তারা এখন জলে নামতে ভয় পায়। গা কুটকুট করে।

এখন আর ছাকনি জাল দিয়ে চিংড়ি ধরতেও দেয় না, ছেলেপুলেদের ছিপ ফেলে পুঁটিমাছ ধরতেও দেয় না। প্রত্যেক পুকুর মালিক একজন করে পুকুর দেখভালের জন্য লোক রেখেছে।

ডি.ভি.সি-র ক্যানেলে এখন দামোদর থেকে কিছু মাছ আসে। মাঠে মাঠে ঢুকে যায়। আশ্বিন মাসে আঁড়াখাল করলে চারটা-পাঁচটা আঁড়া মিলিয়ে হয়তো তরকারিটা হয়। পাঁচবার-ছ’বার কীটনাশক দিয়ে স্প্রে করার ফলে মাঠে মাছ বাঁচবে কী করে! চুনোপুঁটি, চ্যাং-লাটার জন্য তো আর মাঠের ধানগুলোকে পোকামাকড়ের গর্ভে দিয়ে দিতে পারে না চাষিরা। তখন হতো গোবর সারের ভরসায় চাষ।

আমাদের গ্রামের তালবোনার মাছ ছিল সবথেকে মিষ্টি। যারা ওই পুকুরের মাছ আগে খেয়েছে, তারা মুখে দিয়েই বলে দিতে পারত, আরে, এ তো তালবোনার মাছ!

আমার দাদোর কিছুটা অংশ আছে তালবোনায়। দাদো দুনিয়া ছেড়ে চলে গেলেও যখন পুকুরে জাল নামে, মাছের ভাগ দাদিকে দিয়ে যায়। ভাগিদারদের খাবার মতো মাছ দিতে হয় চাষিকে। দাদি একা খায় না, মাছ কেটে ভাগ করে বাপ-চাচাদের দু-চার পিস হলেও দিয়ে যায়।

সেদিন তালবোনার রুইমাছ দিয়ে গেল দাদি। মা ভেজে টমেটো, সরষেবাটা দিয়ে ঝোল ঝোল করে রেঁধেছিল। ভাবলাম, কতদিন পর তালবোনার মাছ খাব। তাও আবার রুই মাছ। কথায় আছে না, শাকের মধ্যে পুঁই, মাছের মধ্যে রুই। তো খেতে বসে একগ্রাস ভাত তুলে মাছ মুখে নিতেই মনে হলো যেন কাদা খাচ্ছি। তালবোনার মাছের এই ছিরি! কোথায় হারিয়ে গেল সেই স্বাদ!

 


‘ধুলোমাটির ভুবন’ ধারাবাহিকের অন্যন্য পর্ব
প্রথম পর্ব : ঘরামী চালের ভাত
দ্বিতীয় পর্ব : দু’চাকার বাহন
তৃতীয় পর্ব : পৌষসংক্রান্তির মেলা
চতুর্থ পর্ব : মোরা এক সুরে গান গাই

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

হামিরউদ্দিন মিদ্যার জন্ম ১৪ই জানুয়ারি ১৯৯৭ সালে পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার সোনামুখীর একটি প্রত্যন্ত গ্রামে। মূলত গল্পকার। প্রথম গল্প প্রকাশিত হয় ২০১৬ সালে। বর্তমান, এই সময়, সাপ্তাহিক বর্তমান, আজকাল, প্রতিদিন, অনুষ্টুপ, পরিচয় প্রভৃতি পত্র-পত্রিকায় গল্প লিখেছেন। বিভিন্ন ওয়েব পোর্টালেও লিখে থাকেন। ২০১৯ সালে কলকাতা বইমেলায় 'সৃষ্টিসুখ' প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হয়েছে গল্পগ্রন্থ 'আজরাইলের ডাক'। লেখালেখির জন্য ২০১৮ সালে পেয়েছেন 'প্রতিশ্রুতিমান গল্পকার সম্মান'। ২০২১ সালে 'আজরাইলের ডাক' গল্পগ্রন্থটির জন্য পেয়েছেন 'দৃষ্টি সাহিত্য সম্মান'। তাঁর গল্প ইংরেজি ও হিন্দিতেও অনুবাদ হয়েছে।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।