তালের কদর, তালের অনাদর
সখা হে, হাঁড়িতে নাই চাল
আছে ভাদর পাকা তাল
ধান রুইয়েছি নামো মাঠে
ফিরবেক কখন হাল!
সে এক দিন ছিল বটে! গাঁ-গ্রামের মানুষের কাছে তালের কী কদর! সে জৈষ্ঠ্য-আষাঢ়ের তালশাঁস হোক কিংবা ভাদ্র-আশ্বিনের পাকা তাল। টিনের পাত কেটে তালঘষা বানিয়ে, পাকা তাল ঘষে ঘষে প্রথমে মাড়ি বের করে নাও। মানে পাকা তালের রস। তারপর আটা মাখিয়ে বানিয়ে নাও নিজের পছন্দ মতো খাবার। তাল ফুলুরি, শিম পিঠে, ধুমসা পিঠে, তালের রুটি, তাল পরোটা, তাল ক্ষীর, খুদ চালের জাও, তাল দিয়ে কতরকম খাবারই না হয়!
আমাদের গ্রামের তালবোনার পুকুরের চারিধার ছিল তালগাছের সারি। এমনি এমনি তো আর পুকুরটার নাম তালবোনা হয়ে যায়নি। বাপ-চাচাদের মুখে শুনেছি তাল পাকার সময়ে মাথায় তাল পড়ার ভয়ে ওই পুকুরের ঘাটে কেউ থালা-বাসন মাজতে, গা ধুতে নামত না। কুবকাব শব্দ করে তাল পড়েই যেত কোনো না কোনো না গাছে। তাল কুড়ানোর জন্য পুকুরের চারিধার সবাই অপেক্ষা করে থাকত। পুকুর পাড়ে মেলা বসে যেত মানুষজনের। এখন আর তালবোনায় সারি সারি তালগাছ নেই। এখন আছে শুধু দু-চারটা বাঁশঝাড়, শ্যাওড়া গাছ আর ভাপড়ি গাছের জঙ্গল।
আমি ছেলেবেলায় ছিলাম খুব রাতবাঘা। মাছধরা, তালকুড়ানো, ঝড়ের রাতে জ্বালানির জোগানের জন্য তাল বেগড়ো, গাছের ভাঙা ডাল কুড়িয়ে আনা, জিওলনালার পুকুর পাড়ের দল-দামড়া থেকে বালিহাঁসের ডিম কুড়িয়ে আনা, হাঁসের গা থেকে খসে যাওয়া সাদা পালক কুড়ানো– এইসবই ছিল আমার নেশা। নালা-ডহরে, খালে-বিলে-ক্যানেলে সন্ধেবেলা ঘুনি পেতে দিয়ে আসতাম। খোল ভাজা আর ভাত মাখিয়ে গোল গোল নাড়ু পাকিয়ে ঘুনির ভেতর ভরে, বাঁধীর পুকুরে দিতাম ডুবো-ঘুনি।
আমি ছেলেবেলায় ছিলাম খুব রাতবাঘা। মাছধরা, তালকুড়ানো, ঝড়ের রাতে জ্বালানির জোগানের জন্য তাল বেগড়ো, গাছের ভাঙা ডাল কুড়িয়ে আনা, জিওলনালার পুকুর পাড়ের দল-দামড়া থেকে বালিহাঁসের ডিম কুড়িয়ে আনা, হাঁসের গা থেকে খসে যাওয়া সাদা পালক কুড়ানো– এইসবই ছিল আমার নেশা। নালা-ডহরে, খালে-বিলে-ক্যানেলে সন্ধেবেলা ঘুনি পেতে দিয়ে আসতাম। খোল ভাজা আর ভাত মাখিয়ে গোল গোল নাড়ু পাকিয়ে ঘুনির ভেতর ভরে, বাঁধীর পুকুরে দিতাম ডুবো-ঘুনি। জলে ডুবিয়ে দিলেই সারারাত চিংড়ি মাছেরা চরতে চরতে খোল ভাজার গন্ধে মাতোয়ারা হয়ে ঘুনির ফুটো দিয়ে ঢুকে মরণফাঁদে আটকে পড়ত। ভোর ভোর গিয়ে সেই ঘুনি তুলে আনতে হতো। না হলে মাছ চুরি যাবার ভয় থাকত। অনেকেই ঘুনির মাছ বের করে নিয়ে আবার ডুবিয়ে দিত। তুমি হয়তো সারারাত মনে মনে কত স্বপ্ন দেখে রাখলে, সকালে ঘুনি তুলতে গিয়ে দেখলে মাছ হাপিস। তাই রাতে চোখে ঘুম আসত না। কখন ভোর হবে, তার জন্য অপেক্ষা করতাম।
কোন গাছের তাল মিষ্টি, কোন গাছের তাল তেতো, সেসব মুখস্থ ছিল আমাদের। ভোর ভোর উঠে টর্চ আর থলে হাতে চলে যেতাম তাল কুড়াতে। ক্যানেলের পাড়ে সামেদ মল্লিকের জমির মাথায় আছে সারি সারি তালগাছ। ঝোপ-জঙ্গলে ভরা জায়গাটা। সামেদ দাদো এককালে কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ছিল বলে গ্রামের মানুষ ওই ঝোপটির নাম দিয়েছে, কমরেডের ঝোপ। কমরেডের ঝোপ ছাড়াও গ্রামে আরও কয়েকটি তালবাগান আছে। তেঁতুলের পুকুর পাড়ে গোটা পাঁচেক গাছ এখনও অবশিষ্ট। দহিজুড়ির পুকুর পাড়ে আছে হাঁড়ি তালের কয়েকটা গাছ। কালো কুচকুচে বড়ো বড়ো হাঁড়ির মতো তাল হয়। সেই তালের মাড়ি খেতে এত মিষ্টি, যে চিনি না মিশিয়েও মুড়ি মেখে খাওয়া যায়। খলিল চাচাদের ঘরের পেছনে দুটো তালগাছ ছিল। খুব গেঁড়া গেঁড়া তাল হতো। মানে, বেঁটে বেঁটে। একটি কি দুটি আঁটি। তালগুলো মধুর মতো মিষ্টি। ওই গাছের তাল মা যখন ঘষতে বসত, তখন তালের নুড়ি খাওয়ার জন্য হ্যাংলার মতো দাঁড়িয়ে থাকতাম, কখন মা তালের খোসা থেকে চুলের মতো হলুদ চঁচগুলো ছাড়িয়ে ছাড়িয়ে গোল নুড়ি পাকিয়ে মুখে পুরে দেবে, আর তা চুষতে চুষতে স্বাদ নেব। সেই গাছ দুটো বছর তিনেক আগে কাটা হলো। মাটির ঘর ভেঙে এডবেস্টার লাগানো পাকা ঘর তুলেছে খলিল চাচা। পাকা তাল ঘরের চালে পড়লে এডবেস্টার কি আর আস্ত থাকবে!
তো এই হলো মোটামুটি আমাদের গ্রামের তালগাছের বংশ পরিচয়। এখন ছানাপোনারাও অনেক বড়ো হয়েছে। কিছু কিছু নতুন গাছেও তাল পাকে, তাল পড়ে, তা নিয়ে মানুষের এত মাথাব্যাথা নেই।
তাল গুড়গুড়ি যখন একটু জোয়ান হয়, তখন সেই কাচা তাল কেটে অপরিণত আঁটিগুলো খাওয়া হয়, যা তালবিচি বা তালশাঁস নামে পরিচিত। তালবিচি কচি ডাবের শাঁসের মতো নরম তুলতুলে খেতে। তখন গরু চরাতে গিয়ে আমরা গরুপালের ছেলেরা মাঠে গরু ছেড়ে দিয়ে নানান খেলা খেলতাম। খেঁজুর পাতা তুলে এনে নরম মাটিতে চোরবিঁধা খেলা, হা ডু ডু, গরু চরানোর পাচন লাঠি দিয়ে গাবগোফানি, কোনো হেলে পড়া গাছের ডাল ঝুলে ঝাপঝোল– আরও কতরকম খেলা! খেলা শেষ হলে বেলা যখন একটু বাড়ত, পেটের ছুঁচো চিঁচিঁ করে ডাক ছাড়ত, তখন খোঁজ পড়ত, কার গাছে আঁজির পেকেছে, কার কলা বাগানে কলার কাঁদি হলদে হয়েছে, কোন চাষি সবজিবাড়িতে শশা-কাঁকুড় লাগিয়েছে, কিংবা তালের সময় বাড়ি থেকে কাস্তে এনে কোনো গেছুড়ে ছেলেকে পাম্প দিয়ে গাছে চড়িয়ে দাও, তারপর তালের কাঁদি কেটে তালবিচি খেয়ে পেট ভরিয়ে নাও। সবই খাওয়া হতো চুরি করে। দস্যিপনার জন্য বাড়িতে কতবার যে শাস্তি পেয়েছি, তার হিসাব নেই।
তালবিচি খাওয়া হলে কাটা তাল দিয়ে আমরা ছেলেবেলায় গাড়ি বানাতাম। একটা একহাত মাপের কঞ্চি কাঠির দু-মাথায় দুটো কাটা তাল চাকার মতো গেঁথে, একটা লম্বা কঞ্জির ডান্ডা বেঁধে দিয়ে ঠেলে ঠেলে চালাতাম। তালের গাড়ি চালিয়েই আমরা কোথায় কোথায় না চলে গেছি!
একবার হলো কী! কালু চাচাদের গাছে তাল কাঁদি কাটতে উঠেছি, একেবারে গাছের ছাত ভেঙে বসে আছি ওপরে, নিচে তাহারুল, রিজাবুল, গাবান পাড়ার ব্যাঙা ওরফে ফাইজুল শেখ। আমাকে গাছে চাপিয়ে দিয়ে ওরা লোক দেখছিল, মানে কালু চাচাকে পুকুরের পাড় ধরে আসতে দেখলেই মুখে শব্দ করে আমাকে সিগন্যাল দেবে। কালু চাচা খুব রাগী মানুষ। একবার লাঠি দিয়ে মেরে চাচির ঠ্যাঙ ভেঙে দিয়েছিল। খুব আ-সাপা লোক। মানে রেগে গেলে হাতের কাছে যা পায় তাই ছুড়ে মারে। কোথায় লাগবে, পরে কী হবে সেসব মাথায় থাকে না। এ হেন মানুষের গাছ থেকে তালের কাঁদি কাটা যে সে ব্যাপার!
কাচাতেই কেটে তালবিচি খেয়ে নিলে, পাকার সময় গাছ ফাঁকা হয়ে যাবে। গাছ মালিক তো আর নিজের গাছ থাকতে লোকের গাছতলায় গাছতলায় ড্যাং ড্যাং করে ঘুরে বেড়াবে না। বছরের স্বাদের জিনিস সবাই দু-একদিন খেতে চাইবে, এটা স্বাভাবিক। তাছাড়া গ্রাম-বাংলায় এখনও রীতি আছে মেয়ের বাড়িতে আম-কাঁঠালের সময় আম-কাঁঠাল, আর তালের সময় তাল পিঠে পাঠাতে হয়। না হলে মেয়ের শ্বশুড়বাড়ির লোকজন মেয়েকে খোটা দেয়।
কয়েকদিন আগেই গরুপালের ছেলেরা কালু চাচার তালগাছের তাল কেটে কতক তালবিচি খেয়েছে, কতক না খেতে পেরে নষ্ট করে তিল খেতে ফেলে গেছে। চাচা কয়েকদিন ধরেই বোধহয় তক্কে তক্কে ছিল। আমি যেমনি এক কাঁদি তাল কেটে নিচে ফেলেছি, ওমনি চেয়ে দেখি তাহারুল, রিজাবুল, ব্যাঙা ওরা মাঠদিকে ছুটছে। ব্যাপার কী! চেয়ে দেখি কালু চাচা পেছনের ঘুরতি পথে একটা কাটারি হাতে নিয়ে পাঁই পাঁই করে ঘুরাতে ঘুরাতে ছুটে আসছে। ভয়ে আমার হাত থেকে কাস্তেটা খসে পড়ল নিচে। থরথর করে কাঁপছি। এত তাড়াতাড়ি গাছ থেকে নামাও সম্ভব নয়, কী হবে এবার! নির্ঘাত আজ প্রাণটাই খোয়াতে হবে। মরতে কেন যে ওদের কথা শুনে গাছে চড়তে গেলাম! এখন তো কারও টিকিটিরও দেখা নেই। তাল কাঁদিটিও নিয়ে যেতে পারেনি, না হলে কোনোরকম পাতার আড়ালে গা-ঢাকা দেওয়া যেত। এতগুলো গাছ, চোরকে খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে শেষমেশ ভাবত, গাছ থেকে বুঝি চোর নেমে পড়েছে। তাতে ফাঁড়া কেটে যাবার সম্ভবনা ছিল।
চাচা কয়েকদিন ধরেই বোধহয় তক্কে তক্কে ছিল। আমি যেমনি এক কাঁদি তাল কেটে নিচে ফেলেছি, ওমনি চেয়ে দেখি তাহারুল, রিজাবুল, ব্যাঙা ওরা মাঠদিকে ছুটছে। ব্যাপার কী! চেয়ে দেখি কালু চাচা পেছনের ঘুরতি পথে একটা কাটারি হাতে নিয়ে পাঁই পাঁই করে ঘুরাতে ঘুরাতে ছুটে আসছে। ভয়ে আমার হাত থেকে কাস্তেটা খসে পড়ল নিচে। থরথর করে কাঁপছি। এত তাড়াতাড়ি গাছ থেকে নামাও সম্ভব নয়, কী হবে এবার! নির্ঘাত আজ প্রাণটাই খোয়াতে হবে।
না ফাঁড়া কাটল না। যেমন ভাবা তেমনই কাজ। তাল কাঁদিটি যে গাছের তলে পড়ে ছিল, কালু চাচা গট গট করে সেখানেই এসে দাঁড়াল। তারপর ওপরদিকে তাকাতেই আমার চোখাচোখি। সঙ্গে সঙ্গে কালু চাচার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো এক হাইভোল্টেজ কাচা খিস্তি। রেগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল, সুড় সুড় করে নেমে আয় হারামজাদা! বাপুতি গাছ পেইচিস? কাচা তালগুলো কেটে কেটে রোজ শেষ করে দিচ্ছিস, তুদের জ্বলনে কি দুটো পাকা তালও খেতে পাব না!
পাতার সঙ্গে ভয়ে সিঁটিয়ে যেতে থাকি। হাত-পা কিছুই কাজ করে না। উঠে তো পড়েছি এত উঁচু গাছে, নামব কী করে! নামলেই যদি কাটারি দিয়ে কুপিয়ে দেয়?
আমি নামছি না দেখে কালুচাচার রাগ চড়চড় করে মাথায় আরও চেপে যেতে থাকে।
শালা তবে রে! বলে একটা শুকনো ঢিল কুড়িয়ে নিয়ে ওপরদিকে সাঁই করে ছুড়ে মারল। গায়ে পেল না ঢিলটা, কাছাকাছি একটা তাল বেগড়োই লেগে খড়াক শব্দ করে নিচে পড়ে গেল। বিফল হয়ে আবার একটা ঢিল তুলে নিল হাতে। চোখ বুজে কতক্ষণ যে বসেছিলাম তার ঠিক নেই। সেই দিনের কথা মনে পড়লে এখনও গায়ে কাঁটা দেয়।
শেষমেশ রক্ষা করেছিল আমার এক কাকা। শুকুর কাকা ছাগলের জন্য ঘাস কাটতে গিয়েছিল মাঠের পগারে। কাকাকে দেখতে পেয়ে ব্যাঙা বিস্তারিত বলেছিল ঘটনাটা। মাঠে ঘাসের বস্তা ফেলে রেখেই ছুটে এসেছিল কাকা। ততক্ষণে হাঁকাহাঁকি শুনে ওপারের পুকুরঘাটে স্নান করতে আসা মানুষজন ছুটে এসে ভিড় জমিয়েছিল। অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে কালু চাচাকে ঘর পাঠানো হয়েছিল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ধীরে ধীরে নেমে এসেছিলাম নিচে। সেবার আব্বার হাতে যা মার খেয়েছিলাম, সে কথা বলতে গেলে পিঠটা এখনও চড়চড় করে উঠবে।
তালবিচির কথা হলো, এবার শোনায় পাকা তালের কথা।
পাকা তাল কুড়ানোর উপযুক্ত সময় ছিল ভোরের বেলা। দিনের বেলা প্রতিযোগী বেশি থাকত। তাল যখন গাছের কাঁদি থেকে খসে নিচে পড়ার আগে শুকনো পাতায় ধাক্কা খেয়ে খড়াক শব্দ করে, তখনই ছেলেপুলেরা ছুটে যায়। পুকুরের জলে তাল পড়লে একটা তালের জন্য একসাথে কতজন যে ঝাঁপ দিয়েছি! জামা-প্যান্ট ভিজে একসা হয়ে যেত। তালের নেশা এমনই নেশা। তালগাছের কাছাকাছি কোনো সমতল জায়গাতে আমরা মারবেল খেলতাম। মুরগা মুরগা, গাইবাছুর, চোখ চোখ। ফলে তাল কুড়ানোও হতো, মারবেল খেলাও হতো। দুষ্টু ছেলেরা অনেক সময় পুকুরে ভাঙা ইট ছুড়ে ঠকাত। শুধু পুকুরে ইট ছুড়লেই হবে না, প্রথমে একটা ছোটো ঢিল ওপরদিকে ছুড়ে শুকনো তালপাতায় খড়াক শব্দ করতে হতো, তারপর ইটটা টবাং শব্দ করে ফেলতে হতো পুকুরের জলে। তাতে নিশ্চিত ঠকানো যেত।
এই সব ঠকাঠকির পাল্লায় না পড়তে চাইলে ভোর ভোর উঠে তাল কুড়িয়ে আনাই ভালো। সারারাত ধপ ধাপ করে তাল পড়ে থাকে নিচে। হাতে থলে আর টর্চ নিয়ে তালতলায় তালতলায় ঘুরে বেড়ালেই হলো। ভোরে কি প্রতিযোগী থাকত না! থাকত, থাকত। তাল তো আর প্রতিদিন খেতে ভালো লাগবে না। তাল কুড়িয়ে কুড়িয়ে জড়ো করা হয় প্রধানত আঁকুড় করার জন্য। মানে পাকা তালের আঁটি মাটিতে গর্ত করে ভরে পোয়াল চাপা দিয়ে রেখে দেওয়া হয়। কালি পুজোর সময় বের করলে সব আঁটিতে পং বেরিয়ে যায়। মানে তাল আঁটির অঙ্কুরোদগম ঘটে। সেই পং বেরনো তাল আঁটি, যাকে গাঁ-গ্রামের মানুষ আঁকুড় বলে, সেই আঁকুড় বা অঙ্কুর বেরনো তালের আঁটি কাটারি দিয়ে চোঁটিয়ে দুফালা করে চামচ দিয়ে ভেতরের সাদা নরম শাঁসটা বের করে খাওয়া হয়। ঘরের ছেলেপুলেদের জন্য বাপ-মাকে কিছু তালের আঁটি পুঁতে রাখতেই হয়। না হলে পরের আঁকুড় খাওয়া দেখে বাচ্চা কাঁদবে। ভোরেও প্রতিযোগী থাকত। রাতবাঘা, রাতচরা মানুষজন তাল কুড়াতে যেত। কখনও হয়তো দেখা যেত আমার আগেই কেউ গাছতলায় হানা দিয়ে গেছে রাতারাতি উঠে। তখন খালি হাতে ঘুরে আসতে হতো।
আঁকুড় করার জন্যেই তখন তাল কুড়াতে যেতাম। যে গাছের তালগুলো মিষ্টি সেগুলো কিছু বেছে বেছে খাওয়ার জন্য মা সরিয়ে রাখত। বাকিগুলো ডুমুরতলার গাবায় চুড় করে রাখতাম। মনে পড়ে কালি পুজো না পেরনো পর্যন্ত আঁকুড়ে হাত দিতে দিত না মা। বলত, পুজো না পেরলে যদি আঁকুড় কেটে খাই, তা হলে কালি ঠাকুরে জিভ কেটে নেবে। অল্প বয়সে কে আর নিজের জিভটা খসাতে চাইবে!
বড়ো হয়ে বুঝলাম, সেসব ছিল মায়েদের বাহানা। তাড়াতাড়ি আঁকুড় খেয়ে শেষ করে দিলে, পরে যদি লোকের ছেলের আঁকুড় খাওয়া দেখে কান্নাকাটি করি। ওসব নিষেধাজ্ঞার আড়ালে বাপ-মায়েরা অভাবকে লুকিয়ে রাখত। পাড়ায় আইসক্রিমওয়ালা ঢুকলে যখন বাপ-মায়ের হাতে পয়সা থাকত না, তখন বলত, ড্রেনের পচা জল দিয়ে আইসক্রিম তৈরি হয়। আইসক্রিম খেলে পেটে পোকা হবে। কই যখন পয়সা থাকত, তখন তো সেই একই আইসক্রিম কিনে দিত, তখন তো পচা জলের কথা বলত না!
আঁকুড় যে শুধু ছেলেপুলেরাই খায়, তেমন নয়। আঁকুড়ের শাঁস শিলে মিহি করে বেটে আটা দিয়ে একপ্রকার পিঠে বানানো হয়। সে পিঠের এত সুগন্ধ আর স্বাদ, খেলে ভোলা যায় না। বার বার খেতে ইচ্ছে করে। মহুয়ার ফুল বা মোল দিয়ে যে পিঠে বানানো হয়, আঁকুড় পিঠের স্বাদ অনেকটা সেরকম।
রাত-বিরেতে তাল কুড়াতে গেলে আমাদের ভয় থাকত ভূতের। মাছধরা আর তাল কুড়াতে যাওয়ার জন্য কখনও কাউকে কথা দিয়ে রাখতে নেই।
একবার আনারুল মামা সন্ধেবেলা তাদের পাড়ার আবুলকে বলেছিল, খুব ভোর ভোর উঠে যেন তাকে ডাকতে আসে, শিয়ালগোড়ের পুকুর পাড়ে তাল কুড়িয়ে আনবে। সেই কথা মতো নিশ্চিন্তে ভং ভং করে ঘুমাচ্ছিল মামা। রাত তখন আড়াইটা বাজে, আনারুল মামা দরজার কাছ থেকে আবুলের গলা পেল, কই রে আনা, এখনও ঘুমচ্ছিস। টপ টপ উঠ, লোকে সব তাল কুড়িয়ে নিল যে!
একবার আনারুল মামা সন্ধেবেলা তাদের পাড়ার আবুলকে বলেছিল, খুব ভোর ভোর উঠে যেন তাকে ডাকতে আসে, শিয়ালগোড়ের পুকুর পাড়ে তাল কুড়িয়ে আনবে। সেই কথা মতো নিশ্চিন্তে ভং ভং করে ঘুমাচ্ছিল মামা। রাত তখন আড়াইটা বাজে, আনারুল মামা দরজার কাছ থেকে আবুলের গলা পেল, কই রে আনা, এখনও ঘুমচ্ছিস। টপ টপ উঠ, লোকে সব তাল কুড়িয়ে নিল যে!
আনারুল মামা ধড়ফড় করে উঠে বসল বিছানায়, বলল, দাঁড়া আমি যাচ্ছি।
গায়ে একটা চাদর ঢাকা দিয়ে থলি হাতে বেরিয়ে গেল মামা। তারপর মনে পড়ল টর্চটা নিতে ভুলে গেছে। যেই ভাবা, অমনি আবুল বলল, টর্চ নিতে হবেকনি রে! সবকিছু কেমন ঝকঝকে দেখা যাচ্ছে।
আনারুল মামা বলল, কই আমি তো দেখতে পাচ্ছি না।
তু আমার পিছু পিছু চল।
আবুল লপ লপ করে হেঁটে চলে, মামা তার নাগাল পায় না। অন্ধকার রাত, চারপাশ শুনশান। হাঁটতে হাঁটতে একসময় আনারুল মামার মালুম হয় তারা যেন ভুল পথে যাচ্ছে। পথটা তো শিয়ালগোড়ের পথ নয়, বুড়হাইচণ্ডীর শ্মশানতলার পথ। ওই তো সামনে একরাশ অন্ধকার তালের মতো প্রাচীন বটগাছটা দাঁড়িয়ে। আবুল তাকে এখানে কেন এনেছে! মামার সম্বিত ফিরে আসে। সামনের ব্যক্তিটি আবুল বটে তো! গলাটাও কেমন যেন একটু খনা খনা না? আর টর্চ নিতেই বা বারণ করল কেন! ভয়ে থর থর করে কাঁপতে থাকে মামা। হি হি করে হেসে আবুল তখন নাকি সুরে বলে, ভঁয় কীঁ রেঁ, চঁল বঁটগাছে ঠ্যাং ঝুঁলিয়ে বঁসে দুঁটো মঁনের কঁথা বঁলি।
আনারুল মামা পিছন ফিরে তখন প্রাণের ভয়ে ছুটতে থাকে। তারপর হোঁচট খেয়ে পড়ে যায়। সকালে অজ্ঞান অবস্থায় বুড়হাইচণ্ডীর মাঠ থেকে মামাকে উদ্ধার করা হয়েছিল। নিশিভূত আবুলের রূপ ধরে মামাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছিল, আর একটু দেরি করলেই হয়তো মামাকে বটগাছে তুলে আছাড় মারত।
এই গল্প আমার নানি অনেকবার বলেছে, মায়ের কাছেও শুনেছি। রাতবিরেতে তাল আর মাছ থেকে খুব সাবধান। নিশিভূত নানান রূপ ধরতে পারে। হয়তো তুমি দেখলে গাছের নিচে একটা কালো কুচকুচে হাঁড়ির মতো বড়ো তাল পড়ে আছে, কুড়তে গেলে, তালটা গড়িয়ে গেল; তাল যত গড়াল, তুমিও পিছু পিছু চলতে লাগলে, এক সময় পুকুরের জলে গড়িয়ে পড়ল তাল—ভুল করেও ওই তাল বাহাদুরি দেখিয়ে কুড়াতে যেও না, না হলে নির্ঘাত তোমাকে জলে ডুবে মরতে হবে। তাল আর মাছ ধরা নিয়ে গাঁ-গ্রামে নানান গল্প ছড়িয়ে আছে। সেইসব গল্প ছোটোবেলায় আমরা চোখ গোল গোল করে শুনতাম, আর মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতাম। ভূতের হাত থেকে বাঁচার জন্য ইমাম সাহেবেরে কাছে মাদুলি নিতাম। সুরা ইয়াসিন মুখস্ত করে নিয়েছিলাম। কখনও কোমরের ঘুনসিতে একটা লোহার কোনো বস্তু বেঁধে রাখতাম, সেটা অপ্রয়োজনীয় নাট হোক কিংবা চাবিকাঠি। বিশ্বাস ছিল কাছে লোহা থাকলে কোনো খারাপ জিনিস কাছে ঘেঁষতে পারে না।
গরমকালে এখন তালবিচি খাওয়া হলেও পাকা তালের আর আগের মতো কদর নেই। আগে অভাব-অনটনের দিনে খুদ চাল আর তাল মাড়ি হাঁড়িতে ফুটিয়ে জাঁও রাঁধা হতো। সেই পায়েসের মতো পাতলা জাঁও রাঁধা খেয়ে মাঠে কাজে যেত বাপ-চাচারা। আকাশের দিকে তাকিয়ে একবার চাষ। খাওয়া-পরার খুব অভাব ছিল।
দিনকাল অনেক বদলেছে। এখন বছরের স্বাদের ফল হিসাবে বড়োজোর দু-একদিন তাল ঘষে খাওয়া হয়, তালের পিঠে বানানো হয়। এখনকার গাঁ-গ্রামের ছেলেপুলেদের মনে এত জোশও নেই, আর আঁকুড় খাবার জন্যেও এত টুঁটি ফেঁড়ে কান্নাকাটি করে না। পুকুরে ঝাঁপ দেওয়া তো দূরের কথা, চোখের সামনে তাল পড়লেও সবজন কুড়িয়ে নিয়ে যায় না। তালতলায় তাল পড়ে পড়ে পচে। নীল মাছিরা তালের গন্ধে ছুটে এসে ভন ভন করে গান গায়।
সোনামুখীর বাজারে গিয়ে সেদিন দেখলাম আমাদের গ্রামের কানকাটা লটবরের বউকে। পোস্ট-অফিসের পাশে সবজি-হাটতলার শুরুতেই কতকগুলো তাল নিয়ে বসে আছে। চোখাচোখি হতে জিজ্ঞেস করলাম, কী খবর কাকি? তাল নিয়ে বসেছ! কেউ কিনছে?
একগাল হেসে লটবর কাকার বউ বলল, বেলা একটু বাড়তে দে বাপ, তারপর দেখবি কাড়াকাড়ি। একটাও তাল ঘুরে নিয়ে যেতে হবেক নাই। তালের কদর এখন শহরে রে! শহরে! বাবুরা দশটাকা পনেরটাকা পিসে এক-একটা তাল লুখে নিয়ে যায়।
একগাল হেসে লটবর কাকার বউ বলল, বেলা একটু বাড়তে দে বাপ, তারপর দেখবি কাড়াকাড়ি। একটাও তাল ঘুরে নিয়ে যেতে হবেক নাই। তালের কদর এখন শহরে রে! শহরে! বাবুরা দশটাকা পনেরটাকা পিসে এক-একটা তাল লুখে নিয়ে যায়।
ভাবলাম, বাহ! ভালোই তো ব্যাবসা ধরেছে লটবরের বউ। এই তাল পুকুর পাড়ে, খালে-খন্দে পড়ে পড়ে পচে। গরীব মানুষ সিজনে তো কিছু টাকা আয় করতে পারবে। মনে পড়ে যাচ্ছিল নশিপুরের ময়সিন ফকিরের গাওয়া সেই গানের কলি দুটি—
তুমার কাছে হেলাফেলা
আমার কাছে সোনা হে—
তুমি যাকে কালো বলো
বৃন্দাবনের কৃষ্ণ সে।
‘ধুলোমাটির ভুবন’ ধারাবাহিকের অন্যন্য পর্ব
প্রথম পর্ব : ঘরামী চালের ভাত
দ্বিতীয় পর্ব : দু’চাকার বাহন
তৃতীয় পর্ব : পৌষসংক্রান্তির মেলা
চতুর্থ পর্ব : মোরা এক সুরে গান গাই
পঞ্চম পর্ব : মাছের সেকাল, মাছের একাল
ষষ্ঠ পর্ব : আমন ধানের মরশুম
সপ্তম পর্ব: যত কথা বই নিয়ে
হামিরউদ্দিন মিদ্যার জন্ম ১৪ই জানুয়ারি ১৯৯৭ সালে পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার সোনামুখীর একটি প্রত্যন্ত গ্রামে। মূলত গল্পকার। প্রথম গল্প প্রকাশিত হয় ২০১৬ সালে। বর্তমান, এই সময়, সাপ্তাহিক বর্তমান, আজকাল, প্রতিদিন, অনুষ্টুপ, পরিচয় প্রভৃতি পত্র-পত্রিকায় গল্প লিখেছেন। বিভিন্ন ওয়েব পোর্টালেও লিখে থাকেন। ২০১৯ সালে কলকাতা বইমেলায় ‘সৃষ্টিসুখ’ প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হয়েছে গল্পগ্রন্থ ‘আজরাইলের ডাক’। লেখালেখির জন্য ২০১৮ সালে পেয়েছেন ‘প্রতিশ্রুতিমান গল্পকার সম্মান’। ২০২১ সালে ‘আজরাইলের ডাক’ গল্পগ্রন্থটির জন্য পেয়েছেন ‘দৃষ্টি সাহিত্য সম্মান’। তাঁর গল্প ইংরেজি ও হিন্দিতেও অনুবাদ হয়েছে।