বৃহস্পতিবার, নভেম্বর ২১

হামিরউদ্দিন মিদ্যার রবিবারের ধারাবাহিক : ধুলোমাটির ভুবন | পর্ব-০৯ | হাতি আসার দিনগুলো

0

হাতি আসার দিনগুলো


শীতকাল পড়লেই আমাদের রাঢ় বাংলার জঙ্গল ধারের গ্রামগুলোতে বুনো হাতির দল হানা দেয়। মাঠে মাঠে এই সময় আলু, কপি, মুলো—নানান শাক-সবজির চাষ হয়। আমন ধান মাঠ থেকে চাষিদের খামারে উঠে যায়। কেউ কেউ ধান ঝেড়ে মরাইও বেঁধে ফেলে। বাবাজীরা রোজ কোনো না কোনো গ্রামে টহল দেয়। বনের শাল-মহুয়া গাছগুলি পাতা ঝরিয়ে উলঙ্গ হয়ে যায়। হাতিদের পেটের টান পড়ে। এত বড়ো বড়ো পেটগুলো তো আর বনের হাওয়া খেয়ে ভরবে না। খিদের জ্বলনে থাপুস-থুপুস পা ফেলে বেরিয়ে আসে সব। তখন আমাদের রাতের ঘুম মাঠেই মারা যায়। বাবাজীরা তো আর ধনী-গরীব বোঝে না। চোখের সামনে যার খেত পায়, সেটাতেই হামলে পড়ে। যত না খায়, তার থেকেও বেশি তছনছ করে। তারপর স্বাদ বদলের আশায় একটু গাঁয়ের ভেতর ঢুঁ মারে।

বনের শাল-মহুয়া গাছগুলি পাতা ঝরিয়ে উলঙ্গ হয়ে যায়। হাতিদের পেটের টান পড়ে। এত বড়ো বড়ো পেটগুলো তো আর বনের হাওয়া খেয়ে ভরবে না। খিদের জ্বলনে থাপুস-থুপুস পা ফেলে বেরিয়ে আসে সব। তখন আমাদের রাতের ঘুম মাঠেই মারা যায়। বাবাজীরা তো আর ধনী-গরীব বোঝে না। চোখের সামনে যার খেত পায়, সেটাতেই হামলে পড়ে।

তখন হয়তো গৃহস্থ নাক ডেকে ভং ভং করে ঘুমাচ্ছে। ঘরের চালের ওপর লতানো লাউ-পুঁইয়ের লতা ধরে সর-সর করে টান মারল। গৃহিণী যদি কান খড়কা হয়, তাহলে ঘুম ভেঙে যাবে। ঘুম ভাঙলে একা বেরিয়ে দেখার সাহস তো আর পাবে না; সারাদিন মাঠে-ঘাটে খেটে ক্লান্ত হয়ে শুয়ে থাকা মরদটাকেই ঠেলা মেরে ওঠাবে।

ওগো শুনছ! চালের ওপর সর-সর শব্দ কেনে গো! বাবাজী আসেনি তো?

রাতদুপুরে বাবাজীর কথা শুনলে মরা মানুষও জেগে ওঠবে না! গৃহস্থ তখন তড়াক করে উঠে, চুপি চুপি দরজার কপাটটা ফাঁক করে বাইরে উকি মেরে দেখে। যা অনুমান করেছিল, তাই ঠিক। দরজা বন্ধ করে বিছানায় বসে ভয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকে। গৃহিণীরও একই হাল। জোড়হাত করে অনুরোধ করতে লাগল, দোহাই বাবাজী, সুরসুর করে চলে যাও। গরীবের পেটে লাথি মেরো না। লাউ-পুঁই যা খাবে খাও, ধানের মরাইটার দিকে নজর দিও না।

বাবাজীর বড়ো বড়ো কান হলে কী হবে। সে কারও কথার ধার ধারে কি? মন যেটা চাইবে সেটাই করবে। হয়তো মন গেল, ধান খাবে না, মরাইটা নিয়ে একটু ফুটবল খেলবে। তখন গোদা পায়ে দিল এক শর্ট। ওমনি ধানের মরাই লদাস করে উলটে পড়ল। কিংবা মনে হলো একটু জল খাবে, তো সুঁড় দিয়ে পেঁচিয়ে টিপকলের হাতলটা ধরে একজন টিপে দিল। নে হাতি তুই জল খা।
হাতি ঢুকলে গ্রামবাসীর টের পেতে বেশি দেরি হয় না। হুজুগে ছেলে-ছোকরারা হুলো, মশাল জ্বেলে হৈচৈ করে সারা গাঁ মাত করে দেয়। ফরেস্টার অফিসের নিয়োগ করা হুলাপার্টির থেকে তারা কম কী!

হাতিকে গ্রাম থেকে বের করে মাঠে মাঠে হাঁটিয়ে বনে ভরে দিয়ে আসে তারা। কেউ কেউ বাহাদুরি দেখিয়ে এভারেস্ট জয় করার মতো উল্লাসে ফেঁটে পড়ে—

বনের হাতি বনকে যা,
চরে চরে ঘাস খা।

 

মানে হাতি তাদের কাছে কিছুই নয়, গোরু-ছাগলের মতো ব্যাপার।

সকালে উঠে কার কী ক্ষতি হলো সে সব তদারকি চলবে খানিকক্ষণ। গাঁয়ের অঞ্চল মেম্বারকে দেখিয়ে ক্ষতিপূরণের দরখাস্ত লেখাতে হবে। তখন দিন কতক চায়ের দোকানে, হাটে-বাজারে, সেলুনে, মুদিখানায় সবখানেই বাবাজীর কথা।

সেবার হলো এক কাণ্ড। আমাদের গ্রামের হাসমত চাচা হাতির গায়ে একটা ঢিল ছুঁড়ে দিয়েছিল।

প্রচণ্ড কুয়াশা দিয়েছিল সেদিন। তারওপর হাড় হিম করা শীত। শীতের তাড়সে খেঁক শিয়ালগুলো ক্যানেলের মুড়ি থেকে, শিঁয়াকুলের ঝোঁপ থেকে বেরতেও সাহস পাইনি। খিদের জ্বালায়-হুক্কা হুয়া, হুক্কা হুয়া করে ডেকে ডেকে কান মাত করেছে। জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসেছিল একপাল বুনো হাতি। হাতিরা সাধারণত রাতে বেরিয়ে এসে পেটপুজো করে পুবের আকাশে ঝুঁঝকো আলো ফোটার আগেই বেরিয়ে পড়ে। সেবার কুয়াশার কারণে বোধহয় পথ খুঁজে পায়নি। তাই ডুমুরজলার দিঘির পাড়ে কাদু সেখের বাঁশবনটা তছনছ করে, সরষে খেতে গড়াগড়ি দিয়ে যখন ফেরার কথা মনে হলো, তখন সকাল হয়ে গেছে। হাসমত চাচা গিয়েছিল তলপেটের চাপটা ফেলে আসতে। সরষে খেতের অবস্থা দেখেই মাঠের দিকে তাকিয়েছিল। আর তাকাতেই চমকে ওঠে। একপাল হাতি চোরের মতো চুপিচুপি এসে চলে যাচ্ছে ! কেউ দেখতেও পাবে না!

ধানের কাজ সারা হয়ে গেছে চাষীদের। গাঁয়ের বুড়ো-ছোকরা সবাই হাত-পা ঝেড়ে বসে আছে। কোনো কাজকামও নেই। মকরসংক্রান্তির পর দিন পীরপুকুরের মেলা শেষ হলে আবার কাজের গতি ফিরে পাবে সবাই। বোরো চাষের জন্য তোড়জোড় শুরু হবে। এই সময় হাতি এসে লক্ষী ছেলের মতো চুপিচুপি ফিরে যাবে, তা তো হাসমত চাচা হতে দিতে পারে না। হাতিদের নিয়ে একটু আমোদ-ফূর্তি করতে হবে না! লুঙির কাছায় শক্ত গিঁট মেরে হাসমত চাচা চোঁ করে দিল দৌড়। গাঁয়ে ঢুকেই খবরটা রাষ্ট্র করে দিল।

ধানের কাজ সারা হয়ে গেছে চাষীদের। গাঁয়ের বুড়ো-ছোকরা সবাই হাত-পা ঝেড়ে বসে আছে। কোনো কাজকামও নেই। মকরসংক্রান্তির পর দিন পীরপুকুরের মেলা শেষ হলে আবার কাজের গতি ফিরে পাবে সবাই। বোরো চাষের জন্য তোড়জোড় শুরু হবে। এই সময় হাতি এসে লক্ষী ছেলের মতো চুপিচুপি ফিরে যাবে, তা তো হাসমত চাচা হতে দিতে পারে না।

কিছুক্ষণের ভেতরেই যে যেখানে ছিল বেরিয়ে এলো। মাঠে লোক গিজগিজ করছে। ঘরের বউ-ঝিরা মাঠে না নামলেও পাশ দিয়ে বইয়ে যাওয়া মোড়াম রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাতি দেখছে। কেউ ছেলে কাঁকালেই চলে এসেছে। পুরুষদের হাতি দেখার সুযোগ হলেও, ঘরের মেয়েদের সবার তো সেই সৌভাগ্য হয় না।

হাতিগুলো এতক্ষণ দুলকি চালে হাঁটছিল। মানুষের চিৎকার চেঁচামেচি শুনে পেছন ফিরে দাঁড়াল। দলের দাঁতাল হাতিটা আকাশ দিকে মুখ তুলে পোঁ-ও-ও’ করে এমন ভেঁপু বাজাল, গাছের শুকনো পাতাও বুঝি খসে পড়ল। দাঁতালটার ডাক শুনেই হাতিগুলো থস থস করে মাঠে বসে গেল।

ছেলে-ছোকরাদের একটা দল সাহস দেখিয়ে কাছেই চলে গিয়েছিল, ওমনি দাঁতাল হাতিটা পাঁই করে পেছন ঘুরে নিয়ে গেল তেড়ে। দৌড়! দৌড়! চাচা আপনা জান বাঁচা। পাগলা হাতি খেপেছে রে! দৌড়তে দৌড়তে হাসমত চাচার লুঙির কাছার গিঁটটা গেল আলগা হয়ে। সে এক বিতিকিচ্ছিরি ব্যাপার!

হাতিটা কিছুটা দৌড়ে এসে আর এগোয়নি। এদিকে কারও তো আর পেছন ফিরে দেখার সাহস নেই। যখন টের পেল, তখন দেখল সব হাতিগুলোই উঠে পড়েছে। সবাই আবার হাতিদের পিছু নিল।

হাসমত চাচা এত সহজে দাঁতাল হাতিটাকে ছাড়ল না। লুঙি খোলার প্রতিশোধ নিতেই নাকি কে জানে! একটা ঢিল কুড়িয়ে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে পেছনে দড়াম করে মারল। দাঁতালটা কিছু করল না, শুধু একবার রুখে দাঁড়াল খানিক, তারপর গুটগুট করে দলটার দিকে হাঁটা দিল।

পরের দিন রাত্রে কেউ কোনো টুঁ শব্দটি পেল না। সকালে উঠে সবাই দেখল, হাসমত চাচার ধানের মরাই চিটপটাং দিয়ে উলটে পড়ে আছে। সব ধান ছড়ানো ছেটানো। টিপকলের পাইপটা দুমড়ে মুচড়ে ফেলে রেখেছে। রান্নাশালের ছাউনিটা কাঠামো সমেত তুলে নিচে নামিয়ে দিয়েছে।

কে করল এমন কাজ? ভালো করে মাটির দিকে তাকিয়ে পায়ের পাঁজ দেখে বোঝা গেল, রাত্রে একটি হাতি এসেছিল। কারও কোনো ক্ষতি না করে, পাশের বাড়ির উঠোন দিয়ে সন্তর্পণে পেরিয়ে এসে শুধুমাত্র হাসমত চাচার বাড়িতেই হানা দিয়েছিল। কেউ না জানুক, হাসমত চাচার জানতে বাকি নেই কোন হাতিটার কাজ।


‘ধুলোমাটির ভুবন’ ধারাবাহিকের অন্যন্য পর্ব
প্রথম পর্ব : ঘরামী চালের ভাত
দ্বিতীয় পর্ব : দু’চাকার বাহন
তৃতীয় পর্ব : পৌষসংক্রান্তির মেলা
চতুর্থ পর্ব : মোরা এক সুরে গান গাই
পঞ্চম পর্ব : মাছের সেকাল, মাছের একাল
ষষ্ঠ পর্ব : আমন ধানের মরশুম
সপ্তম পর্ব: যত কথা বই নিয়ে
অষ্টম পর্ব: তালের কদর, তালের অনাদর

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

হামিরউদ্দিন মিদ্যার জন্ম ১৪ই জানুয়ারি ১৯৯৭ সালে পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার সোনামুখীর একটি প্রত্যন্ত গ্রামে। মূলত গল্পকার। প্রথম গল্প প্রকাশিত হয় ২০১৬ সালে। বর্তমান, এই সময়, সাপ্তাহিক বর্তমান, আজকাল, প্রতিদিন, অনুষ্টুপ, পরিচয় প্রভৃতি পত্র-পত্রিকায় গল্প লিখেছেন। বিভিন্ন ওয়েব পোর্টালেও লিখে থাকেন। ২০১৯ সালে কলকাতা বইমেলায় 'সৃষ্টিসুখ' প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হয়েছে গল্পগ্রন্থ 'আজরাইলের ডাক'। লেখালেখির জন্য ২০১৮ সালে পেয়েছেন 'প্রতিশ্রুতিমান গল্পকার সম্মান'। ২০২১ সালে 'আজরাইলের ডাক' গল্পগ্রন্থটির জন্য পেয়েছেন 'দৃষ্টি সাহিত্য সম্মান'। তাঁর গল্প ইংরেজি ও হিন্দিতেও অনুবাদ হয়েছে।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।