বিকেল হতে না হতে আচমকা বৃষ্টি। সঙ্গে ঝড়ো হাওয়া। মোটরবাইক আর এগোতে চায় না কিছুতে। মোড়ের কাছাকাছি এসেও বড়ো আতান্তরে পড়ে যায় কৌশিক। অল্প সময়ের মধ্যে কাছাকাছি কোথাও মাথা গোঁজার মতো কিছু চোখে পড়ে না। কোথায় দাঁড়ানো যায় ভেবেই হকচকিয়ে ওঠে।
ওই তো একটা রেস্টুরেন্ট। সামনের দিকটায় একটু শেডের মতো দেখা যাচ্ছে। বেশি কিছু ভাবার সময় নেই। সঙ্গে সঙ্গে বাইকটা দাঁড় করিয়ে ছুটে যায় সেদিকে। যদিও পুরোপুরি বৃষ্টির হাত থেকে রেহাই দেওয়ার পক্ষে তিন দিক খোলা আড়াই ফুটের শেডটি খুব একটা উপযুক্ত স্থান নয়। কোনোক্রমে দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়ালে মাথাটুকু বাঁচানো যায়। মন্দের ভালো, এই যা।
এদিকে বৃষ্টির ঝাপটা আসছে থেকে থেকে। একটু একটু করে ভিজে যাচ্ছে পায়ের দিক থেকে কোমর অব্দি। একবার মনে হলো কাচের দরজা ঠেলে ভেতরে গিয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু কোথাও যেন একটু সংকোচ বৃষ্টিভেজা চিটে মাটির মতো জমাট বাঁধছে। যা উপেক্ষা করে পা বাড়ানোর সাহস কৌশিকের নেই। এদিকে যা চড়াং চড়াং করে বাজ পড়ছে, সঙ্গে বিদ্যুতের ঝলকানি। এই ভাবে আর থাকাও যায় না। যা হয় হোক, একটু সাহস করে দরজাটা আলতো করে ঠেলে ভেতরে মুখ বাড়ায়। এইরকম প্রবল বৃষ্টিতে চিটে মাটি আর কতক্ষণ জমাট বেঁধে থাকতে পারে?
একবার মনে হলো কাচের দরজা ঠেলে ভেতরে গিয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু কোথাও যেন একটু সংকোচ বৃষ্টিভেজা চিটে মাটির মতো জমাট বাঁধছে। যা উপেক্ষা করে পা বাড়ানোর সাহস কৌশিকের নেই। এদিকে যা চড়াং চড়াং করে বাজ পড়ছে, সঙ্গে বিদ্যুতের ঝলকানি। এই ভাবে আর থাকাও যায় না।
সামনে ক্যাশের টেবিল। সেখানেই বসে রয়েছে প্রায় সমবয়সি একজন। চেহারায় কৌশিকের দ্বিগুণ। তাকে ওইভাবে মুখ বাড়াতে দেখে চোখ দুলিয়ে বলে, ‘ওখানে দাঁড়িয়ে কেন? ভিজে যাবেন যে! ভেতরে এসে বসুন।’
কথাটা শুনে মনে মনে বেশ খুশি হয় কৌশিক। তবুও মুখে সৌজন্যতার হাসি এনে বলে, ‘না না, ঠিক আছে…’
‘আরে বসুন না ভেতরে এসে। সংকোচের কী আছে?’
একরকম জোর দিয়েই কথাটা বলে লোকটি। কী ভারী কণ্ঠস্বর! এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। অবশ্য চায়ও না এসময়। উনি যখন নিজে থেকে বলছেন, তখন আর মিছেমিছি বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে কষ্ট ভোগ কেন? দুর্যোগে যখন আশ্রয় নিয়েইছে, তখন একটু ভালোভাবেই নেওয়া যাক। কথাটা ভেবে ধীরে ধীরে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে একটা ফাইবারের চেয়ারের ওপর বসে পড়ে কৌশিক। গা গড়িয়ে টপ টপ করে জল ঝরে পড়ছে মেঝেতে। সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে রুমালটা বের করে হাত মুখের জল মুছে নেওয়ার চেষ্টা করে।
লোকটি চেয়ার থেকেই একদৃষ্টিতে কৌশিকের দিকে তাকিয়ে থাকে। এতে যে তার অস্বস্তি হয় না তা নয় । তবুও তা না দেখার ভান করে দেওয়ালে টাঙানো খাবারের লিস্টের দিকে তাকিয়ে থাকে। ভেজ, ননভেজ, চাইনিজ, ইন্ডিয়ান রকমারি কত খাবারের আইটেম। মাঝে মাঝে দু-একটা খাবারের নাম শুনেছে বটে, কিন্তু চেখে দেখার সুযোগ হয়নি কোনো দিন। পাড়ার মোড়ে দুলু কুমারের ঠেলাগাড়িতে মাঝে মধ্যে বউ-ছেলের আবদারে চাওমিন, এগরোল, চিকেন পকোড়া মুখে উঠেছে। ব্যস, ওই পর্যন্তই। কিন্তু এই রকম ছিমছাম রেস্টুরেন্টে ঘটা করে আসার সৌভাগ্য কোনো দিন হয়নি তার।
‘যদি ভুল হয়ে না থাকে, তাহলে আপনি কি রানা..?’ হঠাৎ করে বলে উঠে লোকটি।
বিস্ময়ে চোখের ভ্রু কুঁচকে যায় কৌশিকের। উনি তার নাম জানলেন কী করে? এ তো তার ছেলেবেলার ডাকনাম! টিউশনি পড়ানোর সুবাদে এলাকার বেশিরভাগ লোক তো তাকে কৌশিক স্যার বলেই চেনে।
‘কী, রানাই তো…!’ ধারালো চাহনিতে জবাবের জন্য অপেক্ষা করে থাকে লোকটি।
ঘাড় নাড়ে কৌশিক, ‘হ্যাঁ, কিন্তু আপনি জানলেন কী করে? মানে, আপনি কি আমাকে… ’
‘আরে, আমাকে চিনতে পারলি না?’ আপনি থেকে সরাসরি তুইতে এসে ক্যাশের টেবিল ছেড়ে ধড়ফড়িয়ে উঠে পড়ে লোকটি। তারপর কাছে এসে একটা চেয়ার টেনে এনে বসে পর বলে, ‘আমি হারাধন, হারাধন ঘোষাল! মনে নেই, আমরা একসাথে ইঁদপুর হাই স্কুলে পড়তাম?’
কেঁপে উঠে কৌশিক। এ কী শুনছে সে? এই সেই হারাধন ঘোষাল! চোখের সামনে ভেসে উঠে ক্লাস সেভেনে পড়া ছোট্ট একটি ছেলের কচি মুখ। জ্বলজ্বল করে উঠে ইঁদপুর হাই স্কুল… খসখসে দেওয়ালে চুনকাম করা ক্লাসরুম… চন্দ্রনাথ বাবু… হারাধন ঘোষাল…
‘তুই সেই হারাধন?’ ঢোঁক গিলে ভ্রু কুঁচকে কৌশিক বলে, ‘চেহারায় এত পরিবর্তন হয়েছে যে চিনতেই পারিনি। অথচ তুই আমায় ঠিক চিনে ফেললি।’
‘তোকে চিনতে পারব না, তাও কী হয়!’ ঈষৎ হেসে চোখে চোখ রাখে হারাধন।
চোখ সরিয়ে নিয়ে বাইরের দিকে তাকায় কৌশিক। দরজার কাচ দিয়ে দেখে কীভাবে মেঘের জল বৃষ্টির নকশা নিয়ে রাস্তা ছাপিয়ে বয়ে চলেছে নিচের দিকে। শত শত বুদ্বুদ কৌতূহলী মাথা তুলে ভাসতে ভাসতে মিলিয়ে যাচ্ছে আবার। হারাধন তখন কিচেনের দিকে মুখ করে গলা উঁচিয়ে হাঁক পাড়ে, ‘এই, কে আছিস? দুকাপ কফি নিয়ে আয় শিগ্গিরই। ডাবল ডিমের অমলেট আনবি দুটো।’ তারপর কৌশিকের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘চিকেন বিরিয়ানি খাবি তো? দাঁড়া, এই ভালোভাবে গরম করে চিকেন বিরিয়ানি বানা।’
‘না, না, এসব কী হচ্ছে?’ সজোরে আপত্তি জানায় কৌশিক, ‘এক কাপ কফিই তো যথেষ্ট ছিল। বিশ্বাস কর, আমি এসব খাই না।’
‘খাস না তো কী হয়েছে! আজ নাহয় আমার এখানে খাবি।’ গদগদ স্বরে বলে হারাধন, ‘আজ এত দিন পরে যখন তোকে পেয়েছি, তখন কি আর না খাইয়ে কেউ ছাড়ে?’
বাগে পেয়ে তাকে অপমান করছে না তো হারাধন? ভাবতে ভাবতে লজ্জায় যেন কুঁকড়ে যেতে থাকে কৌশিক। বাইরের শীতল স্রোত তখন সারা শরীর জুড়ে বয়ে চলেছে শিরা-উপশিরায়। রাস্তার ওই বুদ্বুদগুলোকে বড্ড ভাগ্যবান বলে মনে হচ্ছে। যদি তাদের মতো এই মুহূর্তে মিলিয়ে যেতে পারত, তাহলে হয়তো খানিক স্বস্তি পেত।
স্কুলে বরাবরই ফাস্ট হতো কৌশিক। হারাধনের সাথে প্রথম পরিচয় ক্লাস সিক্সে। সে তখন পরপর দুবছর ফেল করে তৃতীয় বছরের জন্য সিক্সেই পড়ে ছিল। পরের বছর একসাথেই উঠল সেভেনে। চন্দ্রনাথ বাবু ভৌতবিজ্ঞান পড়াতেন। ভীষণ রাগী মাস্টার ছিলেন। স্কুলসুদ্ধ সবাই তার নাম শুনলেই পিলে চমকাত। বেধড়ক পেটাতেন ছেলেদের। ক্লাসে এসে প্রথমেই বেছে বেছে যাকে তাকে আগের দিনের পড়া ধরতেন। না পারলেই মার। বাইরে লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়ে পিঠের ছাল চামড়া তুলে নিতেন।
সেবার, তখন গ্রীষ্মকাল। অসহ্য গরম। মর্নিং স্কুল চলছে পুরোদমে। হলে কী হবে? টিফিনের পর থেকেই রোদের তেজে বাইরে বেরোনো যায় না। এমনই এক দিনে চন্দ্রনাথ বাবু এসেই পড়া ধরলেন হারাধনকে। হারাধন কোনো দিনই পড়া পারত না। সেদিনও পারেনি। চন্দ্রনাথ বাবু কানে ধরে বাইরে দাঁড় করিয়ে দিলেন। অন্য দিন তিনি সাথে করে লাঠি নিয়ে আসতেন। কিন্তু সেদিন আনতে ভুলে গিয়েছিলেন। অগত্যা কৌশিককে বললেন, ‘যা তো রানা, মোটা দেখে লাঠি নিয়ে আয় দুটো।’
কৌশিকের তো আনন্দের সীমা নেই। স্যার তাকে লাঠি আনতে বলেছেন। এ যেন বিরাট সৌভাগ্যের ব্যাপার। কৌশিকও বলামাত্রই ছুটে চলে গেল স্কুলের পেছনের দিকে। সেখানে বিশাল খেজুর আর পুটুসের ঝোপ। কৌশিক তখন আবেগের বশে পুটুসগাছের মোটা মোটা দুটো ডাল ভেঙে নাচতে নাচতে নিয়ে আসছিল। লাঠির গাঁয়ে ছোটো ছোটো কাঁটা।
বাইরে তখন আরও জনা পাঁচেক দাঁড়িয়েছিল হারাধনের সঙ্গে। চন্দ্রনাথ বাবু অন্যজনের পড়া ধরছিলেন সেই সময়। হারাধন দূর থেকে লাঠি দেখতে পেয়ে কৌশিকের কাছে ছুটে এসে বলল, ‘দেখ ভাই, অত মোটা লাঠি নিয়ে যাস না। অন্য লাঠি নিয়ে আয়। স্যার কেমন মারে সে তো দেখেছিস তুই। এই লাঠিতে স্যার মারলে আমরা কেউ আর বাঁচব না। এই লাঠি নিয়ে যাস না।’
কৌশিক কতকটা তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, ‘না রে, আমি ওসব জানি না। স্যার আমাকে মোটা লাঠি আনতে বলেছেন, তাই নিয়ে এসেছি। সরে যা, নইলে স্যারকে বলে দেবো।’
ভয়ে ভয়ে পথ ছেড়ে দিয়েছিল হারাধন। চন্দ্রনাথ বাবু লাঠি নিয়ে ভীষণ মেরেছিলেন ওদের। কুঁকড়ে গিয়েছিল হারাধন। তাকে দেখে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল কৌশিক। সেদিন চোখে জল চলে এসেছিল তার। এক করুণ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়েছিল হারাধন। অনুশোচনার আগুনে পুড়ে গিয়েছিল কৌশিক। ভীষণ রাগ হচ্ছিল চন্দ্রনাথ বাবুর ওপর, আর তার নিজের মূর্খামির ওপর। স্যার যে ওই রকমভাবে লাঠিপেটা করবেন কল্পনাও করতে পারেনি কৌশিক। বারবার মনের মধ্যে প্রশ্নটা ধাক্কা দিচ্ছিল, কেন সে লাঠি আনতে গেল? কেন সে হারাধনের কথায় অন্য লাঠি আনতে পারল না?
এক করুণ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়েছিল হারাধন। অনুশোচনার আগুনে পুড়ে গিয়েছিল কৌশিক। ভীষণ রাগ হচ্ছিল চন্দ্রনাথ বাবুর ওপর, আর তার নিজের মূর্খামির ওপর। স্যার যে ওই রকমভাবে লাঠিপেটা করবেন কল্পনাও করতে পারেনি কৌশিক।
ক্লাস শেষ হতে হারাধন সেই যে ব্যাগ গুটিয়ে বেরিয়ে গেল আর ফিরল না। যেতে যেতে কী করুণ অথচ তীব্র অনুযোগের দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়েছিল কৌশিকের দিকে, মাঝে মাঝে মনে পড়লে বুক কেঁপে উঠত তার। পরে বহুবার খোঁজ করেছে কৌশিক, খোঁজ পায়নি হারাধনের। তারপর প্রায় একরকম ভুলেই গিয়েছিল তার কথা। সংসার জীবনের যাঁতাকলে পিষা যেতে যেতে কে কার কথা মনে রাখে? অথচ সে তাকে ভুলে গেলেও হারাধন কিন্তু ঠিক মনে রেখেছে তাকে। হয়তো মনের ঘা শুকায় না বলেই এই ভাবেই মানুষ মানুষকে মনে রাখে বহুদিন।
কিছুক্ষণের মধ্যে একটি ছেলে ট্রেতে করে দুকাপ কফি আর দুটো গরম গরম ওমলেট এনে টেবিলে নামিয়ে দিলো। কৌশিক আর কিছু বলতে পারল না। শুধু চুপচাপ হারাধনের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। হারাধন কফিতে এক চুমুক নিয়ে ওমলেটে এক কামড় দিয়ে কৌশিকের দিকে তাকিয়ে থমকে গেল। ‘আরে কী হলো, খাসনি যে এখনো?’
‘না, মানে…’ আমতা আমতা করতে লাগল কৌশিক।
‘ও বুঝেছি কী ভাবছিস তুই।’ চিবোতে চিবোতে স্বাভাবিকভাবে বলল হারাধন। ‘সেদিনের কথা ভেবে সংকোচ করছিস? না রে সংকোচের কিছু নেই। তোর প্রতি কোনো রাগ নেই আমার। কোনো আক্ষেপও নেই। বরং চন্দ্রনাথ বাবু আর তুই আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিস সেদিন। তার জন্যই তো আমি আজ নিজের পায়ে দাঁড়াতে পেরেছি।’
‘মানে?’ বলে বিস্ময়ে কফির কাপটা হাতে তুলে নিল কৌশিক।
হারাধন বলতে শুরু করল, ‘সেদিন স্যারের মার খাওয়ার পর ঠিক করলাম আর স্কুলে যাব না। বাবারও তখন কষ্টের সংসার। তাই এক দুঃসম্পর্কের মামার সাথে কলকাতা চলে গেলাম। ধোয়াধুয়ির কাজ পেয়ে গেলাম একটা রেস্টুরেন্টে। সেখান থেকেই শুরু। ধীরে ধীরে এই লাইনের রান্নাটাও শিখে গেলাম। হয়ে গেলাম হেড কুক। তারপর কোরোনা এলো, লকডাউনে সব বন্ধ হয়ে গেল হুটহাট। কাজ হারিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। জায়গাটা যেহেতু আগেই কেনা ছিল। তাই ভাবলাম আর বাইরে যাব না। এখানেই কিছু করে খাব। আজ বছর দুয়েক হবে, এই রেস্টুরেন্টটা দাঁড় করিয়েছি এখানে। তোদের ছোটো-বড়ো সকলের আশীর্বাদে আজ আর আমার কোনো অভাব নেই।’
বলতে বলতে চুপ করে গেল হারাধন। কৌশিকের মুখে কোনো ভাষা নেই। হারাধন আবার বলতে শুরু করল, ‘তাই তো তোদের ভুলিনি আজও। শুনেছি স্যার আর বেঁচে নেই। তোরও খোঁজ করেছি কিন্তু দেখা হয়নি কোনো দিন। ফেসবুকেও তোর নামে সার্চ করেছি। পাইনি।’
‘আমি ফেসবুক করি না।’ ধরা গলায় বলল কৌশিক।
‘ও আচ্ছা, তা কী করছিস এখন? চাকরি?’
‘না।’ বলে ঘাড় নাড়ল কৌশিক। ‘চাকরি আর জুটল কই?’
‘সেকি! ঠিকমতো চেষ্টা করিসনি নাকি?’
‘চেষ্টা যে করিনি তা নয়। দেখতেই তো পাচ্ছিস, চাকরির কী অবস্থা এখন।’
‘তা ঠিক। তাও তোর মতো ছেলে চাকরি পেল না?’
‘সবই কপাল রে হারাধন।’ বলেই জোরে একটা নিশ্বাস ছাড়ল কৌশিক।
‘তাহলে কী করছিস এখন?’
‘কী আর করব বল! টুকিটাকি এদিক সেদিক টিউশনি পড়াই। ওতেই কোনো রকমে চলে যায় আরকি।’
খাবার যেন মুখে উঠতে চাইছিল না আর। একটা অব্যক্ত যন্ত্রণা ধীরে ধীরে গলা টিপে ধরছিল কৌশিকের। কোথাও যেন একটা হীনম্মন্যতা, একটা ব্যর্থতার চাপা কষ্ট মাথাচাড়া দিয়ে উঠছিল বারবার।
‘টিউশনি পড়াস। ভালোই তো।’ বলল হারাধন। তারপর হঠাৎ প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা, বাড়ি বাড়ি গিয়ে পড়াস?’
সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ল কৌশিক। কেমন যেন একটা আনন্দের ঝিলিক খেলে গেল হারাধনের চোখে মুখে। সঙ্গে সঙ্গে কৌশিকের বাম হাত চেপে ধরে বলল, ‘আমার একটা কথা রাখবি? আমার মেয়ে ক্লাস সিক্সে পড়ে। তুই পড়াবি আমার মেয়েকে?’
নড়েচড়ে উঠল কৌশিক। কিছু বলতে যাবার আগে হারাধন আবার বলতে লাগল, ‘পড়া না আমার মেয়েকে। খুব শান্ত মেয়ে। খুব মাথা আছে তা নয়, তবে আমার মতো মাথামোটা নয়। তোর মতো গুরু পেলে ঠিক উতরে যাবে। টাকাপয়সার জন্য ভাবিস না।’
বড়ো অস্বস্তিতে পড়ে গেল কৌশিক। কী বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল এ বাঁধনে বাঁধাপড়া চলবে না। হারাধনের থেকে অনেক দূরে চলে যেতে হবে। নইলে হীনম্মন্যতা, অপমানবোধ চিরকাল কুরে কুরে খাবে।
‘কী হলো, পড়াবি তো আমার মেয়েকে?’
‘আসলে আমি তো অত বাচ্চা ছেলেমেয়েকে পড়াই না। ক্লাস নাইন থেকে পড়াই।’
‘তাতে কী হয়েছে? আমার মেয়েকে নাহয় সিক্স থেকেই পড়াবি।’
‘না রে এ বছর তো আর হবে না। আমার ফাঁকা নেই, পরের সেশন থেকে ভেবে দেখব ‘
মুখটা কেমন যেন একটু গম্ভীর হয়ে গেল হারাধনের। একটুখানি হাঁ করে তাকিয়ে রইল কৌশিকের মুখের দিকে। তারপর দ্রুততার সঙ্গে বলল, ‘আচ্ছা ঠিক আছে, পরের সেশন থেকে পড়াবি তো?’
‘হ্যাঁ।’ বলে ঘাড় নেড়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে উঠে পড়ল কৌশিক। বৃষ্টি তখন থেমে গেছে। মেঘও পাতলা হয়ে এসেছে কিছুটা। কফির কাপটা শেষ করলেও প্লেটে তখনো কিছুটা অমলেট পড়েছিল। তা দেখে হারাধন বলল, ‘কী হলো, উঠলি যে? খাবারটা শেষ কর। বিরিয়ানি হচ্ছে, একটু তো মুখে দিয়ে যা।’
‘না ভাই, আজ আর নয়।’ রুমালে মুখ মুছতে মুছতে বলল কৌশিক, ‘অনেক খেয়েছি। ওসব বিরিয়ানি টিরিয়ানি আমার পেটে সহ্য হবে না। বৃষ্টিটা এ সময় থেমেছে। এখুনি একটা টিউশনি আছে। আমি বরং অন্য দিন আসব। আজ চলি।’
হারাধন মৃদু হেসে ‘ও বুঝেছি’ বলতেই পেছন ফিরে তাকাল কৌশিক। হারাধন তার চোখের দিকে সোজা তাকিয়ে বলল, ‘না কিছু না, একদিন সময় করে আসিস। দোকানের পেছনেই আমার বাড়ি।’
কৌশিক সৌজন্যতার খাতিরে ‘হ্যাঁ আসব’ বলে দরজা ঠেলে বেরিয়ে গেল বাইরে। ভেজা বাতাস চোখেমুখে লাগতেই স্বস্তি ফিরে পেল আবার। জোর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে এগিয়ে গেল বাইকের কাছে। কিন্তু বাইক আর স্টার্ট নেয় না কিছুতেই। কিকের পর কিক দিয়ে চলেছে, স্টার্ট নিচ্ছে না। বৃষ্টি হলেই বাইকটা মাঝে মাঝে এমন বাগড়া দেয়। কিন্তু আজ এখানেও এই ভাবে এমনটা হতে হয়! ভেবে মনে মনে খুব রাগ হচ্ছিল বাইকটার ওপর।
তখন হঠাৎ করে পেছন থেকে একটা মেয়ে এসে বলল, ‘কাকু, বাবা এগুলো আপনাকে দিতে বলল।’
একটা ছোট্ট মেয়ে কালো পলিথিন ব্যাগে কিছু পার্সেল করা খাবার নিয়ে হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সেদিকে দৃষ্টি নেই কৌশিকের। তার চোখ আটকে গেছে মেয়েটির চোখে। এ সে কাকে দেখছে? যার অবয়বটা মেয়েদের, কিন্তু চোখ দুটোয় হুবহু যেন হারাধন। কী নিষ্পাপ সে চাহনি! যেন ত্রিশ বছর আগেকার সেই ছেলেটা
পেছন ফিরতেই আবারও চমকে উঠল কৌশিক। একটা ছোট্ট মেয়ে কালো পলিথিন ব্যাগে কিছু পার্সেল করা খাবার নিয়ে হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সেদিকে দৃষ্টি নেই কৌশিকের। তার চোখ আটকে গেছে মেয়েটির চোখে। এ সে কাকে দেখছে? যার অবয়বটা মেয়েদের, কিন্তু চোখ দুটোয় হুবহু যেন হারাধন। কী নিষ্পাপ সে চাহনি! যেন ত্রিশ বছর আগেকার সেই ছেলেটা, যে হাত জোড় করে বলছে ‘দেখ ভাই, অত মোটা লাঠি নিয়ে যাস না, অন্য লাঠি নিয়ে আয়…’
বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল কৌশিকের। দিগ্ভ্রান্ত পথিকের মতো তখনো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে। মনের গভীর থেকে কেউ যেন বলে উঠল, ‘ভাবছিস কী কৌশিক? এই তো সুযোগ, সমস্ত অনুশোচনা, সমস্ত হীনম্মন্যতা জলাঞ্জলি দেওয়ার। সেদিন তোর আনা লাঠির ঘায়ে যে ছেলেটাকে স্কুলছুট হতে হয়েছিল, আজ ত্রিশ বছর পর যদি তার মেয়েকে স্কুলের পথে এগিয়ে যেতে সাহায্য করিস, এর চেয়ে ভালো আর কী বা হতে পারে?’
পলিথিনের ব্যাগটা হাতে নিল কৌশিক। মিষ্টি হেসে বলল, ‘যাও মামণি, তোমার বাবাকে গিয়ে বলো, কাকু কাল এসে তোমাদের বাড়িতে দেখা করে যাবে।’
মেয়েটি ঘাড় নেড়ে চলে যেতেই পলিথিনের ব্যাগটা ডিকিতে ভরল কৌশিক। আনমনে চাবিটা ঘুরিয়ে কিক মারতেই দু-একবারের মধ্যে স্টার্ট নিয়ে নিল বাইক। সঙ্গে সঙ্গে ভ্রুম ভ্রুম শব্দে কেঁপে উঠল চারপাশ। কাঁপছে কৌশিক। যার ঝাঁকুনিতে বুকের ভেতর চেপে ধরে থাকা কঠিন আবরণের কালো মরচেগুলো খসে পড়ছে ঝুর ঝুর করে। নির্ভার মেঘের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসা বিকেলের নরম রোদ তখন চারিদিক ভরিয়ে তুলেছে নতুন করে…
জন্ম ১৯৮৭ সালে পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার ইন্দপুর গ্রামে। পেশায় শিক্ষক হলেও সাহিত্যচর্চায় অনুগত প্রাণ। মূলত গল্পকার। সমসাময়িক পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি করে আসছেন এযাবৎ। নেশা: বইপড়া, ভ্রমণ।